সম্প্রতি গ্লোবাল ব্রাইবারি রিস্ক ইনডেক্স কান্ট্রি র্যাঙ্কিং ২০২১ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবছর ‘ট্রেইস ইন্টারন্যাশনাল’ নামের আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা এ সূচক প্রকাশ করে। ২০২১ সালের র্যাঙ্কিংয়ে ১৯৪টি দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৭ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে ঘুষের ঝুঁকির বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন (মানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত), আফগানিস্তানের অবস্থান সর্বনিম্ন ১৭৪ নম্বরে। পাকিস্তানের অবস্থান তৃতীয় সর্বনিম্ন ১৫০ নম্বরে, মালদ্বীপের অবস্থান ১১৮ নম্বরে, নেপাল ১১২ নম্বরে, শ্রীলঙ্কা ৯২ নম্বরে, ভারত ৮২ নম্বরে ও ভুটান ৬২ নম্বরে। এর মানে ঘুষ দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে নির্ণীত হয়েছে, আফগানিস্তান সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। ভুটান দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ।
এর আগে বার্লিনে অবস্থিত দুর্নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স ২০২০ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বিশ্বের ১৭৯টি দেশের দুর্নীতির র্যাঙ্কিং প্রদত্ত হয়েছে। ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬, পাকিস্তানের অবস্থান ১২৪, নেপালের ১১৭, শ্রীলঙ্কার ৯৪ ও ভারতের ৮৬। এ সূচক অনুসারেও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ আফগানিস্তান, যার অবস্থান ১৬৫ নম্বরে। টিআইয়ের মতে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ নির্ণীত হয়েছে সোমালিয়া ও সাউথ সুদান। উল্লিখিত দুটো সূচকে দেশের সংখ্যা এবং ঘুষ-দুর্নীতিতে দেশগুলোর অবস্থান আলাদা হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনামূলক ঘুষ-দুর্নীতির চিত্রে খুবই উল্লেখযোগ্য সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। দুটো সূচকই দেখাচ্ছে, বাংলাদেশ এ অঞ্চলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ঘুষ-দুর্নীতির দিক থেকে এখনো একেবারে নিচের (মানে খারাপ অবস্থানের) দেশগুলোর কাতারেই রয়ে গেছে।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের গবেষণা মোতাবেক দুর্নীতিতে বাংলাদেশ পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত। ২০০১ সালে সরকারে ক্ষমতাসীন ছিল আওয়ামী লীগ আর ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০০৭-২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবাজদের ‘প্রবল ঝাঁকি’ দেওয়ায় বাংলাদেশের ভাগ্যে দুর্নীতির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আর না জুটলেও আমাদের অবস্থান এখনো দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ৩০ থেকে ৩৫টি দেশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
দুঃখজনক হলো, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়েই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দুদককে অকার্যকর করার যাবতীয় প্রয়াস জোরদার করেছে। অথচ ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পালে প্রবল হাওয়া লেগেছে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে বাড়তে বাড়তে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলেও তা ধনাত্মক রয়ে গেছে, যেটা ভারতের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির তুলনায় অবশ্যই প্রশংসনীয়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফলের সিংহভাগ দেশের ধনাঢ্যদের কাছে গিয়ে জমা হয়ে যাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে দেশের সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষমতাসীন মহলের ভ্রান্ত নীতির কারণে।
কিন্তু দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সর্বনাশা বিস্তৃতির কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধির এ সাফল্যের সুফল যে সমাজের কয়েক হাজার ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, দুর্নীতিবাজ আমলা এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জমান সামরিক কর্মকর্তারাই একতরফা দখলে নিয়ে যাচ্ছেন, তারই অকাট্য প্রমাণ ফুটে উঠেছে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের আরেকটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের মাধ্যমে ধনাঢ্য ব্যক্তি সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করেছে বাংলাদেশ, যেটা বিশ্বের সর্বোচ্চ হার। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জাজনক অর্জন। কারণ, ধনকুবেরদের সম্পদের প্রবল স্ফীতির অর্থই হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফলের সিংহভাগ দেশের ধনাঢ্যদের কাছে গিয়ে জমা হয়ে যাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে দেশের সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষমতাসীন মহলের ভ্রান্ত নীতির কারণে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির মধ্যে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ২০১১ সালে পাস হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন মহাজোট সে রায়কে সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও বর্তমান সরকার এখনো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ এবং ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’-এর মধ্যেই ডুবে আছে। এ হতাশাজনক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের পরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের টনক নড়ছে না। দেশের বর্তমান সাংসদদের ৬২ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী, সরকারের মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আয়বৈষম্য এভাবে বাড়তেই পারে না, যদি শাসকেরা সমাজতন্ত্রকে ‘বাত কা বাত’ বানিয়ে না ফেলে! এসব ‘রবার ব্যারন’ সৃষ্টির জন্য কি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম আমরা? আমি দৃঢ়ভাবে বলছি, সরকারের এহেন ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম-প্রীতি’ অসাংবিধানিক ও অনৈতিক।
পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে দুর্নীতি ক্রমেই বিস্তার লাভ করলেও বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে দুর্নীতি ছিল ব্যতিক্রমী আচরণ, রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে তখনো ওটা নিয়মে পরিণত হয়নি। কিন্তু সেনাশাসক জিয়া নিজেকে সততার পরাকাষ্ঠা হিসেবে জাহির করলেও তাঁর সচেতন আশকারা পেয়েই তাঁর শাসনামলে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেছিল। তাঁর আমল থেকেই এগুলো বাড়তে বাড়তে বর্তমানে সর্বনাশা স্তরে পৌঁছে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রক্রিয়াগুলো স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ১৯৯১ সালে ভোটের রাজনীতি চালু হওয়ার পর গত ৩০ বছর একই প্রক্রিয়াগুলো আরও জোরদার হয়েছে। বর্তমান সরকারের শাসনামলে দেশে অনেকগুলো ‘মেগা প্রজেক্ট’সহ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের মহাযজ্ঞ চলছে আর ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতা-কর্মীরা এ সরকারি প্রকল্পগুলো থেকে বেধড়ক পুঁজি লুণ্ঠন করেছেন। দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা অকার্যকর থাকায় এ ৪৬ বছর ধরে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতিও বেড়ে পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠেছে।
এ সরকারব্যবস্থাকেই উন্নয়ন ডিসকোর্সে ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’ বা চৌর্যতন্ত্র কিংবা ‘পুঁজি লুণ্ঠনমূলক সরকার’ আখ্যায়িত করা হয়। দুঃখজনক হলো যে ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রায় ১৩ বছর হয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ এ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সদিচ্ছা দেখায়নি। অথচ ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছিলেন। ফলে সরকারি দলের সব স্তরের নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশই লুটেরা পুঁজির ফায়দাভোগী হয়ে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছের’ রূপ ধারণ করেছে। তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ জনমনে ভীতি সঞ্চারকারী ‘গডফাদারে’ পরিণত হয়েছে। তাদের স্বার্থে আঘাত লাগলে সরকার বা সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে তারা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভূমিকা পালনে দ্বিধা করবে না। সে জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতৃত্ব দিয়ে আপনি ইতিহাসে যে স্থান করে নিয়েছেন, সেটাকে টেকসই করতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক প্রতিরোধযুদ্ধেও আপনাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।
মইনুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক