রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে থাই তরুণ-তরুণীদের বিক্ষোভ এশিয়ার অনেক দেশের অভিজ্ঞতায় অভিনব কিছু নয়। কিন্তু থাইল্যান্ড যে রাজা মহা ভাজিরালংকর্ণের বিরুদ্ধে কথা বলছে সেটা বিস্ময়কর। দেশটিতে ‘রাজা’কে সমালোচনা-পর্যালোচনার ঊর্ধ্বে বিবেচনা করা হতো। এখনো বিপুল মানুষের কাছে তিনি তাই। রাজপরিবার সেখানে ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে ‘পবিত্র’ কিছু। রাজা যেন মহাপ্রভুরই ছায়া।
কিন্তু একদল কিশোর-তরুণ সেই বিশ্বাস থেকে দেশকে মুক্ত করতে রাস্তায় নেমেছে। রাজপরিবারের ক্ষমতার অসীম অভিলাষ, সম্পদের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা এবং অনির্বাচিত শাসকদের প্রশ্রয় দেওয়ার প্রথা নিয়ে প্রশ্ন তোলা গেছে দেশটিতে। থাইল্যান্ডের চলমান আন্দোলনের এক বড় দিক এটা। যুগ-যুগান্তরের ‘কর্তৃত্ব’কে চ্যালেঞ্জ করার এমন ঘটনা এশিয়ার সমকালীন ইতিহাসে বিরল। উত্তর আমেরিকায় দাসত্বের প্রতীকগুলোর বিরুদ্ধে কালোদের গর্জে ওঠার সঙ্গেই হয়তো এর তুলনা চলে। কিন্তু এই আন্দোলন রক্তপাতেরও শঙ্কা জাগাচ্ছে।
ভিন্নমতাবলম্বীদের দীর্ঘ চেষ্টার ফল আজকের ‘থাই বসন্ত’
অতীতের শিকড় বাদ দিলেও চলতি থাই রাজতন্ত্রের ইতিহাস প্রায় আড়াই শ বছরের পুরোনো। প্রায় ৯০ বছর হলো ‘রাজার নির্বাহী ক্ষমতা নেই’। তবে দাপ্তরিকভাবে তিনিই ‘রাষ্ট্রের প্রধান’, ‘সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান’ এবং ‘ধর্মের রক্ষক’। এসব পদের ‘ক্ষমতা’ কতটুকু, সেটাও রাজা ও তাঁর অনুগতরাই ব্যাখ্যা দেন। দেশটির ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১১২ ধারায় রাজবংশের ‘যেকোনো ধরনের’ সমালোচনা ১৫ বছর পর্যন্ত দণ্ডযোগ্য করে রাখা আছে। ফলে জবাবদিহিহীন বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে আছে এই পরিবার।
বিপুল ক্ষমতামাত্রই বিপুল খারাপ নজির তৈরি করে। সেসব থেকে চোখ ফেরাতে শিশুকাল থেকেই সবাইকে রাজার প্রতি শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষা দেওয়া হয়। এর মধ্যেও কিছু মানুষ রাজাদের কাজকে প্রশ্নযোগ্য ভাবতে শিখে গেছে। এ রকম ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে জেল-জুলুম চলছে নিয়মিত। কিন্তু ভিন্নমতকে একেবারে নির্মূল করা যায়নি। সেই নীরব চেষ্টাই থাইল্যান্ডকে আজকের রাজনৈতিক জটিলতায় এনে দাঁড় করিয়েছে। রাজতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ সেখানে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনা হলেও একই সঙ্গে এটা দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক, ঝুঁকিময় প্রচেষ্টারই ফল।
রাজা ও প্রাউতের পেছনে আছেন নতুন জেনারেল নারোঙপান। রাজার পছন্দে সম্প্রতি তিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান পদে আসীন হলেন। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম ভাষণেই ‘রাজতন্ত্রকে সুরক্ষা’র অঙ্গীকার করেছেন। থাইল্যান্ডে এভাবেই চলছে ‘কর্তৃত্ব’ ও ‘ক্ষমতা’র পরম্পরা। বর্তমান আন্দোলন সেই ধারাবাহিকতা বদলাতে চাইছে।
নির্বাচিত নেতাদের টিকতে দেওয়া হয় না
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের কাছে থাইল্যান্ড হলো সামরিক শাসকদের দেশ। কেউ কেউ একে সংবিধান তৈরির দেশও বলে। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের আমলে, ১৯৩২ থেকে সেখানে এ পর্যন্ত ১৩টি ক্যু হয়েছে। এই হিসাব ব্যর্থ ৯টা ক্যুর অতিরিক্ত। ২০২০ সালে সেখানে আরেক দফা ক্যুর পদধ্বনি চলছে।
প্রতি দফা সামরিক শাসনের ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে নতুন নতুন সংবিধান তৈরির ইতিহাস। গত ৯ দশকে দেশটিতে গড়ে প্রতি চার বছরে একটা সংবিধান লেখা হয়েছে। সর্বশেষটি হলো তিন বছর আগে।
নির্বাচনী সংস্কৃতির গলা টিপে অনির্বাচিতরা সেখানে গদিনশিন হতে পারে মূলত রাজপরিবারের সঙ্গে যোগসাজশে, ‘স্থিতিশীলতা রক্ষা’র নামে। এভাবে ক্ষমতাপিয়াসী সামরিক-বেসামরিক একটা আমলাচক্রের সঙ্গে রাজপরিবারের ঐতিহাসিক মৈত্রী কাজ করে থাইল্যান্ডে। রাজা পরিবার এই ধরনের শাসনে মদদ দেয় নিজ স্বার্থে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিকশিত হতে দিতে চায় না তারা। এই লক্ষ্যে সব সময় কিছু রাজনীতিবিদ এবং সামরিক কর্মকর্তাকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পাশে রাখে রাজবংশ। এ রকম ‘রাজনীতিবিদ’ ও ‘কর্মকর্তা’দের আগে থেকে চিহ্নিত করে গড়েপিটে নেওয়া হয়। এভাবেই ২০০৬-এ সরানো হয়েছিল থাকসিন সিনাওয়াত্রার সরকারকে। ২০১৪ সালে সরানো হয় ইংলাক সিনাওয়াত্রাকে। এই দুজনের ক্ষমতার ভিত্তি দেশটির দরিদ্র জনতার সমর্থন। থাকসিনের আমলেই থাইল্যান্ডে কোনো নির্বাচিত বেসামরিক সরকার প্রথমবারের মতো মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছিল। কিন্তু রাজপরিবারকে ঘিরে থাকা অভিজাততন্ত্রকে সন্তুষ্ট রাখতে পারেননি থাকসিন ও ইংলাক। ফলে যেতে হয় তাঁদের।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এভাবে নাজেহালের শুরু দেশটির ইতিহাসের প্রথম স্বচ্ছ নির্বাচন থেকেই। ১৯৭৩ ও ১৯৭৬ সালের দুটো নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েও জনপ্রিয় লোকনেতা সেন প্রামোজকে রাজনীতি থেকেই বিদায় নিতে হয়। অথচ জন্মগতভাবে রাজপরিবারেরই সদস্য ছিলেন তিনি। জনতার সার্বভৌমত্ব রাজপরিবারের সার্বভৌমত্বের ওপর ছায়া বিস্তার করলেই দেশটিতে সামরিক শাসনের গুঞ্জন শুরু হয়। এই প্রক্রিয়াতেই সর্বশেষ ২০১৪ সালে ক্ষমতা নেন জেনারেল প্রাউত চান-ওচা। বিতর্কিত এক প্রক্রিয়ায় এই ‘জেনারেল’ এখন ‘প্রধানমন্ত্রী’ হয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমাতে চাইছেন জরুরি অবস্থা জারি করে।
রাজা ও প্রাউতের পেছনে আছেন নতুন জেনারেল নারোঙপান। রাজার পছন্দে সম্প্রতি তিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান পদে আসীন হলেন। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম ভাষণেই ‘রাজতন্ত্রকে সুরক্ষা’র অঙ্গীকার করেছেন। থাইল্যান্ডে এভাবেই চলছে ‘কর্তৃত্ব’ ও ‘ক্ষমতা’র পরম্পরা। বর্তমান আন্দোলন সেই ধারাবাহিকতা বদলাতে চাইছে।
করোনাকালের অর্থনৈতিক মন্দা আন্দোলনকে উসকে দিল
জেনারেল প্রাউত চান-ওচা ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর রাজতন্ত্রের মহিমাকীর্তনের জন্য সিনেমা তৈরি, সংগীত প্রতিযোগিতা ইত্যাদির পেছনেই কেবল ৫৪০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেন। এ বছর এ রকম বাজেট আরও অনেক বেড়েছে। ‘রাজতন্ত্র সম্পর্কে জনগণকে সঠিক ধারণা’ দিতে ‘শিক্ষা কর্মসূচি’র নামে এভাবে অর্থ ঢালা হয় মূলত অনির্বাচিত শাসকদের পেছনে রাজার মদদের বিনিময়ে।
মহা ভাজিরালংকর্ণ হলেন চক্রী রাজবংশের দশম রাজা। তাঁর বাবা ভূমিবল অত্যুলতেজ প্রায় ৭০ বছর রাজা ছিলেন। বিশ্বের অন্যতম ধনী রাজপরিবার এটা। তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সম্পদ বাড়ছে তুমুল গতিতে। ব্যাংক থেকে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি পর্যন্ত সবই আছে তাঁদের। ক্রাউন প্রোপার্টি ব্যুরো (সিপিবি) নামের একটা সংস্থাই আছে এই সম্পদের ব্যবস্থাপনায়। এই ব্যুরোর সম্পদ, বিনিয়োগ ও ব্যবসাপাতি কর ব্যবস্থার আওতাবহির্ভূত থাকায় জনগণের একাংশ ক্ষুব্ধ। এসব সম্পদ রাজার ব্যক্তিগত হলেও তাঁর পরিবারের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিতদের বেতন–ভাতা জনতার কর থেকেই দিতে হয়। বছরে ১৫ থেকে ২০ কোটি ডলার ব্যয় হয় রাজপরিবারের জন্য নিয়োজিত কর্মীদের পেছনে।
যেহেতু রাজপরিবার নিয়ে প্রশ্ন তোলা বেআইনি, তাই সিপিবির কাজ-কারবারও থাকছে স্বচ্ছতা-জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। খুবই রক্ষণশীল হিসেবে ভাজিরালংকর্ণের রয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ। সচরাচর এই রাজা জার্মানিতে একটা বিশেষ হোটেলে থাকেন বছরের দীর্ঘ সময়। সেখানে থাকাকালে দেশে কাউকে যাতে তাঁর ক্ষমতার অস্থায়ী দায়িত্ব দিয়ে ‘রিজেন্ট’ নিয়োগ দিতে না হয়, সেটাও তিনি সংবিধানে লিখিয়ে নিয়েছেন ২০১৭ সালে। এভাবেই থাইল্যান্ড দেশটি বছরের কিছু সময় জার্মানি থেকে শাসিত হচ্ছে। খোদ জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস অভাবনীয় এক বিবৃতির মাধ্যমে ‘জার্মান ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাইল্যান্ড শাসনের জন্য’ ভাজিরালংকর্ণকে হুঁশিয়ার করেছেন গত ৭ অক্টোবর। তবে এই রিমোট কন্ট্রোল শাসন কায়েমে সামরিক বাহিনী ভাজিরালংকর্ণের পাশেই আছে। আবার তিনিও প্রাউত চান-ওচাকে জেনারেল থেকে প্রধানমন্ত্রী হতে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। সংগত কারণেই জার্মানিতে তাঁর বিলাসী জীবনযাপনের জ্বালানিও জাতীয় বাজেট থেকে নির্বিঘ্নে যাচ্ছে। কিন্তু করোনায় দেশজুড়ে যখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, আর বেকার বাড়ছে তখন এভাবে অর্থ খরচে করদাতারা আপত্তি তুলছেন। ব্যাংককে বিক্ষোভকারীদের জিজ্ঞাসা ছিল: ‘দেশটা কি রাজপরিবারের? নাকি সমগ্র জনতার?’
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যে কারণে থাই রাজার পাশে
থাইল্যান্ডে দশকের পর দশক ধরে যা হচ্ছে ভেনেজুয়েলা, ইরান, কিউবা বা এ রকম অন্য দেশে সেসব হলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এত দিনে বিশ্বজুড়ে হুলুস্থুল বাধিয়ে ফেলত। কিন্তু থাইল্যান্ডে যে ৯০ বছরে ১৩টা অভ্যুত্থান নির্বিঘ্নে হতে পারল, তাতে পশ্চিমের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আহত হয়েছে সামান্যই। এর কারণ থাইল্যান্ডের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্পর্কের ঐতিহাসিক পরম্পরা। থাইল্যান্ডে যে সম্প্রতি নতুন করে সামরিক বাহিনী ও রাজার কর্তৃত্ব বাড়িয়ে সংবিধান লেখা হলো, তাতেও যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো আপত্তি দেখা যায়নি। ইউরোপও থাইল্যান্ডের সঙ্গে বহুল আলোচিত ‘মুক্ত বাণিজ্য সংলাপ’ বন্ধ করেনি।
একদা কমিউনিস্ট ভিয়েতনাম, লাওস, কম্পুচিয়া ও গণচীনকে মোকাবিলায় থাইল্যান্ড ছিল এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য-গোপন বহু তৎপরতার কেন্দ্রস্থল। যুক্তরাষ্ট্র এখন সেই সম্পর্ককে নবায়ন করে নিতে চাইছে চীনের বিরুদ্ধে। থাইল্যান্ডের উ-থাপাও বিমানঘাঁটিটিও যুক্তরাষ্ট্রের সময় সময় বিশেষ দরকার হয়। এসব কারণে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুই দফা সামরিক অভ্যুত্থানের পরও ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হওয়া উভয় দেশের ‘কোবরা গোল্ড’ সামরিক মহড়া বন্ধ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। তবে থাই অভিজাতেরা তাদের পুরোনো ধাঁচের শাসন চালাতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনকে সুবিধাজনক মিত্র মনে করছে এখন। এই পটভূমিতেই এবারের থাই গণতান্ত্রিক আন্দোলন পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমে কিছুটা সহানুভূতি পাচ্ছে। সেটা হংকংয়ের তরুণ-তরুণীদের জন্য ওয়াশিংটনের সোচ্চার সংহতির মতো না হলেও থাই অভিজাতদের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে ব্যাংককের বিকল্প খুঁজছে ইদানীং।
তবে ব্যাংককের রাস্তায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেমে আসা কিশোর-তরুণেরা এসব ভূরাজনৈতিক হিসাবের তোয়াক্কা করছে সামান্যই। তারা জানে, বিজয় সন্নিকটবর্তী নয়। হংকংয়ের অভিজ্ঞতাও দেখেছে। কিন্তু ভিন্নমতের প্রলম্বিত এক ঢেউ তুলতে পেরেছে তারা। আপাতত ফেসবুক-টুইটার যাদের একমাত্র ব্যালট পেপার। এসব মাধ্যম ব্যবহার করেই ব্যাংককের এখানে-সেখানে হুট করে জমায়েত হচ্ছে তরুণেরা। যাদের কোনো সুপরিচিত ‘নেতা’ নেই। প্রথাগত কোনো ‘রাজনৈতিক দল’ও নয় তারা। অথচ বীজ বপন করে চলেছে কর্তৃত্ববিরোধী মূল্যবোধের।
অতীতের দীর্ঘ কালো ছায়া
থাইল্যান্ডের এই আন্দোলনের প্রথমে শুরু হয় স্বচ্ছ নির্বাচন এবং বিতর্কিত সংবিধান পাল্টানোর দাবিতে। রাজতন্ত্রের ক্ষমতা সংস্কারের দাবি যুক্ত হয় তাতে পরবর্তী সময়ে। দেশের অনেকে মনে করছেন, তৃতীয় দাবির কারণে প্রথম দুটির আদায় কঠিন হয়ে গেল।
এটা সহজেই বোধগম্য, বর্তমান থাই সরকারের পক্ষে বিক্ষোভকারীদের দাবি অনুযায়ী রাজার ক্ষমতা খর্ব করা কঠিন। মহা ভাজিরালংকর্ণ যেকোনো মূল্যে বর্তমানের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চাইবেন। প্রয়োজনে সশস্ত্র শক্তিকে নির্মমভাবে ব্যবহার করা হবে। পুরো সশস্ত্র বাহিনীর আইনি ‘হুকুমদাতা’ তিনি। অন্তত দুটি সেনা ইউনিট আছে সরাসরি তাঁর তত্ত্বাবধানে। গত বছরের অক্টোবরে এক ডিক্রির মাধ্যমে তিনি এই দুই ইউনিটকে ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। পরিস্থিতি খারাপ দেখলে এদেরই হয়তো তিনি সেসব তরুণ-তরুণীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইবেন, যারা তাঁর বংশের আড়াই শ বছরের কর্তৃত্বের ইতিহাসে বাদ সাধছে।
তবে ও রকম কিছু মানেই বর্তমানের ছদ্ম বেসামরিক শাসনের অবসান এবং প্রধানমন্ত্রী জেনারেল প্রাউত চান-ওচার বিদায়। একই সঙ্গে ব্যাংককে ১৯৭৬-এর অক্টোবরের মতো গণহত্যারও শঙ্কা আছে। দেশটির পুরোনো ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে, নির্বাসিত স্বৈরশাসক থামম কিটিকাচর্নের দেশে ফেরার বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-তরুণদের বিক্ষোভ থামাতে ওই সময় পুলিশদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল সশস্ত্র যুদ্ধের অস্ত্র। শতাধিক ছাত্র ও শ্রমিককে হত্যা করে ভিয়েতনামপন্থী ‘কমিউনিস্ট নিধন’-এর উল্লাসে মেতে উঠেছিল জেনারেলরা। রাজপরিবারের অজ্ঞাতসারে সেসব হয়নি। হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়াদের ধরতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে সেদিন বিভিন্ন আধা সামারিক শক্তিকে মোতায়েন করা হয় সাদাপোশাকে। এরা অধিকাংশ ছিল ভিয়েতনাম ও লাওসে কমিউনিস্টবিরোধী যুদ্ধে আমেরিকার হয়ে ভাড়ায় খাটা থাই সৈনিক। এদের হাতে শত শত ছাত্র-তরুণ আটক হয় ওই দিন। যাদের অনেককে গাছে ঝুলিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। রাজতন্ত্র, ধর্ম এবং দেশ বাঁচানোর কথা বলে এই বর্বরতাকে ন্যায্যতা দেওয়া হচ্ছিল। পরদিনই দেশটিতে নতুন করে সামরিক অভ্যুত্থান করে ক্ষমতায় এসেছিলেন মহা ভাজিরালংকর্ণের পিতা তখনকার রাজা ভূমিবলের প্রিয়ভাজন অ্যাডমিরাল সংগদ চালারো। ১৯৭৬-এর ৮ অক্টোবর নিউইয়র্ক টাইমস এই অ্যাডমিরালের ক্ষমতারোহণের যে সংবাদটি ছাপে (‘নিউ লিডার ইন থাইল্যান্ড’ শিরোনামে) তার শেষ দুটি বাক্য ছিল বিশেষভাবে কৌতুককর: ‘তাঁর (সংগদের) রাজনৈতিক দর্শন স্পষ্ট নয়, তবে ধরে নেওয়া হয়, তিনি দক্ষিণপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল মধ্যপন্থী। ব্যাংককের পশ্চিমা কূটনীতিকেরা তাঁকে আমেরিকার সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।’
সে রকম আরেক অক্টোবর পেরোচ্ছে এখন থাইল্যান্ড। থামাসাত গণহত্যার ৪৪তম বার্ষিকীতে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ব্যাংককের রাস্তায় প্রায় দিনই জমায়েত হচ্ছে পরিবর্তনবাদীরা। এসব দৃশ্যের বার্তাটি স্পষ্ট: গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকে পরাজিত করা কঠিন।
আলতাফ পারভেজ রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ে গবেষক