সুসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী একটা কথা প্রায়ই বলতেন, বিপদে পড়লে শয়তানেও মাছি ধরে খায়। গণতন্ত্রের আঙিনায় কোনো রাজনৈতিক দলকেই শয়তানের সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের মুখে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস ও সিপিআইএম নেতাদের দেখে ওই উপমা মনে পড়ে যেতে বাধ্য। স্বাধীনতার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি দীর্ঘদিন আবর্তিত হয়েছিল কংগ্রেস ও বামপন্থীদের তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ এবং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল—সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ বছর কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় থেকেছে। আর ১৯৭৭ সাল থেকে সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকেছে। মাঝে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল—এই পাঁচ বছরে একাধিক জোড়াতালির সরকার স্বল্প মেয়াদে ক্ষমতাসীন ছিল, কিছুটা সময় রাষ্ট্রপতির শাসনও জারি ছিল।
রাজ্য রাজনীতির এই মেরুকরণের প্রক্রিয়ায় কংগ্রেস ও বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা ক্রমেই তীব্র হচ্ছিল। তা আরও বাড়িয়ে দেয় ১৯৭৫ সালের ২৬ জুন দেশে জরুরি অবস্থা জারির পরের ২২ মাসে পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কংগ্রেস সরকারের আমলে বামপন্থীদের ওপরে নেমে আসা পুলিশি অত্যাচার। তা দুই শিবিরের সম্পর্ককে আরও তিক্ত ঘৃণায় পরিণত করে। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতি বসু কংগ্রেসি অপশাসনের কথা বলার সময় প্রায়ই দাবি করতেন, শুধু জরুরি অবস্থার সময়েই ১ হাজার ১০০ বামপন্থী কর্মীকে খুন করা হয়েছিল। অন্যদিকে, কংগ্রেসও পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি থেকে উদ্বাস্তু শরণার্থীদের পুলিশ দিয়ে উচ্ছেদের জন্য গুলি চালিয়ে গণহত্যা থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের লোকজনের ওপর ধারাবাহিক সন্ত্রাস ইত্যাদি নানা অন্যায়ের অভিযোগে সোচ্চার থেকেছে।
এর বিপরীতে কেন্দ্রে বামপন্থীরা অবশ্য মাঝেমধ্যেই কংগ্রেসের হাত ধরেছে। ১৯৬৯ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় ইন্দিরা গান্ধীর প্রার্থী ভি ভি গিরিকে জেতাতে সাহায্য করা, ১৯৯১-৯৬ সালে পি ভি নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে সংখ্যালঘু থাকা সত্ত্বেও লোকসভায় একাধিকবার অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট না দিয়ে ওয়াকআউট করে কংগ্রেস সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করার
নজির তো রয়েছেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় নজির তৈরি হয় ২০০৪ সালে। বিজেপিকে ঠেকাতে সেবার বামপন্থীরা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন
প্রথম ইউপিএ সরকারকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের এই ঘনিষ্ঠতা আগে কখনোই পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের কংগ্রেসকে কাছে টানতে উৎসাহিত করেনি।
এখন করছে। অবশ্য এখন শুধু বামপন্থীরাই নন, পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতারাও দুই পক্ষের সঙ্গে জোট বেঁধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তূণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিধানসভা নির্বাচনে লড়ার কথা বলছেন। ইতিমধ্যে জোট প্রস্তাব নিয়ে রাজনীতির জল অনেক দূর গড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কংগ্রেস প্রতিনিধিদল দিল্লিতে গিয়ে কংগ্রেস সহসভাপতি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছে। এবার সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেদিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছেন রাজ্যের নেতারা। অপেক্ষায় রয়েছে বামফ্রন্টের প্রধান শরিক সিপিআইএম দলও। তাদের রাজ্য কমিটি বৈঠকে বসছে ১২-১৩ ফেব্রুয়ারি, তারপর দিল্লিতে ১৬ তারিখ পলিটব্যুরো এবং ১৭-১৮ তারিখ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিই চূড়ান্ত করবে, বামপন্থীদের সঙ্গে কংগ্রেসের নির্বাচনী জোট হবে কি না।
এত দিনের বৈরিতা সরিয়ে রেখে দুই শিবিরেরই রাজ্যস্তরের নেতারা যে এখন পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলাতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন, তা এক কথায় তাঁদের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার ফসল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বাম ও কংগ্রেস উভয়েরই অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। অবশ্যই এ পরিস্থিতি তৈরিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় অবদান রয়েছে। তিনি ২০১১ সালে নির্বাচনে জেতার পর বলেছিলেন, ‘বদলা নয়, বদল চাই’। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ঠিক উল্টোটাই ঘটল। ভোটের পরপরই পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ায় মমতার দলের লোকজন সিপিএমের কয়েকজনকে নৃশংসভাবে খুন করে। সেই আক্রমণ এখনো চলছে। ২০১১ সালের নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত সিপিএমের অন্তত ১৭০ জন রাজনৈতিক হিংসার শিকার হয়েছেন, বেশির ভাগই তূণমূল কংগ্রেসের হাতে। তূণমূলের সশস্ত্র গুন্ডা বাহিনীর হামলার শিকার হয়ে গ্রামাঞ্চলের কয়েক হাজার সিপিএম কর্মী ও সমর্থক বছরের পর বছর গ্রামছাড়া। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আরও বহু মানুষ কারাবন্দী। রাজ্যের প্রতিটি জেলায় সিপিএমের অসংখ্য দলীয় কার্যালয় গায়ের জোরে তূণমূল কংগ্রেসের লোকজন দখল করে নিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকদের ওপর তূণমূল কংগ্রেসের অত্যাচার এতটাই বেশি যে বহু সিপিএম কর্মী জান ও জীবিকা বাঁচাতে তূণমূলের কাছে আত্মসমর্পণ করে তাঁদের ঝান্ডা হাতে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
তূণমূল কংগ্রেসের এই লাগামছাড়া আক্রমণের হাত থেকে কংগ্রেসও রেহাই পায়নি। কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা আবদুল মান্নান হিসাব দেন, অন্তত ২৫ জন কংগ্রেস কর্মী এই পাঁচ বছরে শাসক দলের গুন্ডাদের হাতে খুন হয়েছেন। বহু জায়গায় দলীয় কার্যালয় জোর করে দখল করা হয়েছে। কংগ্রেসের বিধায়ক, পুরসভার প্রধান ও অনেক কর্মীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তূণমূলে যোগ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে কংগ্রেস করার ‘অপরাধে’ বহু টাকা জরিমানা আদায় করছেন তূণমূল কংগ্রেসের সশস্ত্র কর্মীরা, এমনকি বামপন্থীদের কাছ থেকেও।
গত পাঁচ বছরে রাজ্যে তিন স্তরের পঞ্চায়েত, পুরসভা ও লোকসভার নির্বাচন হয়েছে। তার মধ্যে লোকসভা নির্বাচন বাদে বাকি দুটিই পরিচালনা করে থাকে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গেল, রাজ্য পুলিশের সক্রিয় সহযোগিতা ও নির্বাচন কমিশনের উদাসীনতার সুযোগে অসংখ্য জায়গায় গায়ের জোরে বিরোধী পক্ষের প্রতিনিধিদের নির্বাচনী বুথের বাইরে বের করে দিলেন তূণমূল কংগ্রেস কর্মীরা। বুথ দখল ও জাল ভোট তো চললই, তার সঙ্গে নতুন উপাদান হিসাবে যুক্ত হলো বিরোধী সমর্থক বেশি
এমন সব গ্রামে সশস্ত্র মোটরবাইক বাহিনী পাঠিয়ে ভোটদাতাদের ভোটদানে নিরস্ত রাখা। ফলে, তূণমূলের জয়ের ধারা অব্যাহত থাকলেও তাতে কতটা জল মেশানো, তা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ল।
অন্যদিকে, কলকাতায় ও বিভিন্ন জেলার স্কুল-কলেজের পরিচালন সমিতিতে দলীয় লোকজনকে বসিয়ে সেখানকার পরিবেশ এখন এতটাই কলুষিত করে তোলা হয়েছে যে আবার পরীক্ষার হলে গণটোকাটুকি ফিরে আসছে। তূণমূল কংগ্রেসের রাজত্বে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সঙ্গে সমাজজীবনেও অসহিষ্ণুতার বাড়াবাড়ি এখন এতটাই যে একটা দমবন্ধ করা অবস্থায় পড়েছে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীসমাজও। কোনো সন্দেহ নেই, এই অসহিষ্ণুতার পরিবেশ ঘনিয়ে তোলার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন মমতা নিজে সবচেয়ে বেশি। ব্যঙ্গচিত্র-কাণ্ডে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বরীশ মহাপাত্রকে বেআইনিভাবে জেলে পুরে রাখা, ঝাড়গ্রামে জনসভায় সারের দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়া কৃষককে মাওবাদী বলে ধরিয়ে দেওয়া, টিভি টকশোতে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে অস্বস্তিকর প্রশ্ন করার অপরাধে প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতী ছাত্রীকে মাওবাদী আখ্যা দেওয়ার মতো বহু কাজ করে দলীয় কর্মীদেরও বিরোধী দল ও বিরুদ্ধমতের পোষকদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করতে উৎসাহিত করেছেন তিনি। অন্যদিকে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন করে ক্ষমতায় আসার পর মমতার আমলে কোনো বড় বা মাঝারি শিল্পে নতুন বিনিয়োগ হয়নি। ফলে একদিকে রাজ্যে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়ছে, অন্যদিকে খুন–ডাকাতি থেকে শুরু করে নানা অপরাধ সমাজে নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে তুলছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের এপ্রিল-মে মাসে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন ঘিরে রাজ্যে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়তে শুরু করেছে। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে তূণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেস জোট বেঁধে লড়ে। মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে তূণমূল কংগ্রেস পায় ১৮৪টি, কংগ্রেস ৪২টি। অন্যদিকে বামফ্রন্ট মাত্র ৬২টি। মোট বৈধ ভোটের ৪৩ শতাংশ তূণমূল কংগ্রেস পায়, কংগ্রেস ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে ৫২ শতাংশ। বামপন্থীরা পায় ৩৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০১৪ সালে কংগ্রেস একা লড়ে মোট ভোটের ৯ দশমিক ৬ শতাংশ পায়, অর্থাৎ নিজেদের ভোট তারা প্রায় পুরোটাই ধরে রাখে। অন্যদিকে, মোদি হাওয়ায় বিজেপি নাটকীয়ভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৭ শতাংশ ভোট পেয়ে যাওয়ায় তূণমূল কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট উভয়েরই ভোট কমে। তূণমূল কংগ্রেস পায় ৩৯ দশমিক ৯০ শতাংশ, বামপন্থীরা ৩০ শতাংশ। এখন নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা জোট বেঁধে লড়লে তূণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একটা জোরদার লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা, এটা মাথায় রেখেই কংগ্রেস ও বামপন্থীরা কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে। যদি নির্বাচন কমিশন এবার তাদের দেওয়া আশ্বাস অনুযায়ী ঠিকমতো ভূমিকা পালন করে, তাহলে যে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে শাসক দলকে জবরদস্ত মোকাবিলার সামনে পড়তে হবে, সেটা বুঝেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল কিছুটা শঙ্কিত। তাই তিনি নিজে একবার এই জোট সম্ভাবনাকে অনৈতিক কাজ বলে আক্রমণ শাণাচ্ছেন, কখনো একে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন।
রজত রায়: ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক।