পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সমুদ্র সীমানা নিয়ে কয়েক মাস ধরেই গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। উভয় দেশই নিজেদের দল ভারী করতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে। শুরুর দিকে দুপক্ষের মধ্যকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকলেও যুদ্ধের বিউগল বাজতে শুরু করেছে। গ্রিস ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধজাহাজের মহড়া দিয়েছে। তুরস্ক ঠেকিয়েছে গ্রিসের কয়েকটি যুদ্ধবিমানকে। নেমেছে নৌশক্তি প্রদর্শনে। কাছেই অপেক্ষা করছে মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ। সমুদ্রের তলার তেল-গ্যাসের মালিকানা নিয়ে বিরোধে জড়িয়েছে এই দুই প্রতিবেশী দেশ।
তবে এ কেবল তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যকার সংঘাতই নয়; এর রয়েছে বৈশ্বিক মাত্রা। এর মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তুরস্কের ভাগ্যও এর সঙ্গে জড়িত। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ভাগ্যবিধাতা কে হবে, তা-ও নির্ধারণ করবে এ যুদ্ধ। যার দরুন বিশ্বের তাবৎ প্রধান শক্তিগুলো ভূমধ্যসাগরের এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।
গত শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্য যেভাবে পৃথিবীর জ্বালানির অন্যতম উৎস ছিল, ঠিক একই ভাবে ভবিষ্যতে ভূমধ্যসাগর এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগর ইউরোপের জ্বালানির অন্যতম উৎস হতে পারে বলে মনে করেন জ্বালানিবিশেষজ্ঞরা। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক সংস্থা (ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে) পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ব্যারেল তেল এবং প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস মজুত থাকার কথা বলছে। যদি ইউরোপ এই তেল-গ্যাস নিজেরদের দখলে নিতে পারে, তাহলে রাশিয়ার ওপর তাদের জ্বালানি-নির্ভরতা কমবে। একই সঙ্গে ইউরোপ রাশিয়ার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে। তেল-গ্যাসের দখলদারি নিয়ে ইউরোপের এ পরিকল্পনা ঠিকঠাকভাবেই চলছিল।
তবে বাগড়া বাধে যখন তুরস্ক আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুযায়ী পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিজেদের জন্য এবং তুর্কি সাইপ্রাসের জন্যও ২০০ মাইল স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক এলাকা (ইইজেড) দাবি করে। তুরস্ক এবং ইউরোপের মধ্যকার এ উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায় যখন তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে ফ্রান্সের টোটাল এবং ইতালির এনা কোম্পানির তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী জাহাজকে বের করে দেয়।
এই ঘটনার ধারাবাহিকতায় গত নভেম্বরে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে আঙ্কারা লিবিয়ার জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের সঙ্গে এক চুক্তি করে। এই চুক্তির ফলে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে আঙ্কারা এবং ত্রিপোলির একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে ইউরোপ নড়েচড়ে বসে। চুক্তি নিয়ে ইউরোপ প্রকাশ্যে তার অস্বস্তির কথা জানায় এবং আঙ্কারাকে এ চুক্তি বাতিলের আহ্বান করে। চুক্তির বিষয়ে আঙ্কারা তার অনড় অবস্থানের কথা জানালে, লিবিয়ায় নতুন করে হাঙ্গামা শুরু হয়।
পশ্চিমাদের ঘনিষ্ঠ বিদ্রোহী জেনারেল হাফতার ত্রিপোলি দখলে নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। এ হাঙ্গামার উদ্দেশ্য ছিল লিবিয়ার জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের পতন ঘটিয়ে আঙ্কারার সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমুদ্রচুক্তি বাতিল করা। তুরস্কের হামলার দরুন হাফতার ত্রিপোলি দখলে ব্যর্থ হন, তবে ইউরোপীয়রা থেমে থাকেননি। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ মদদে কোনো ধরনের সামুদ্রিক সীমানা না থাকা সত্ত্বেও গ্রিস ও মিসরের মধ্যে স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক এলাকা নির্ধারণের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ চুক্তি ভূমধ্যসাগরের এমন কিছু অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা তুরস্ক ও লিবিয়ার মধ্যকার চুক্তিতেও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আগ্রহী পাঠকেরা খেয়াল করবেন, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি রকেটের মতোই দ্রুত পরিবর্তনশীল। অনেক সময় এ-সংক্রান্ত খবরের পশ্চাদ্ধাবনে পাঠকের নাভিশ্বাস ওঠে। কয়েক মাস আগ পর্যন্ত সবার নজর ছিল সিরীয় কুর্দিদের ওপর তুরস্কের হামলা নিয়ে। তারপর হুট করেই নজর চলে গেল লিবিয়ায়। তারপর এখন পূর্ব ভূমধ্যসাগরে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্ক-গ্রিসের চলতি যুদ্ধাবস্থাকে আদতে সিরিয়া বিষয়ে পশ্চিমের নীতি মেনে নিতে তুরস্ককে বাধ্য করার কৌশল হিসেবে দেখছেন।
সিরিয়ায় পশ্চিমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, কুর্দি পিকেকের নেতৃত্বে সিরীয় কুর্দিদের জন্য তুরস্কের সীমান্ত-ঘেঁষে একটি রাষ্ট্র গঠন করা। আর সিরিয়ায় নতুন এ রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ মজবুত হলে সময় বুঝে পরবর্তী সময়ে বর্তমান ইরাকে অবস্থিত কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলকে একত্র করে এক বৃহৎ কুর্দি রাষ্ট্র গঠন করা। এমনকি ‘সন্ত্রাস দমনের’ নাম করে ইরানকে ভেঙে ইরানি কুর্দিদেরও সংযুক্ত করা যাবে এই নতুন রাষ্ট্রে—এটাই পরিকল্পনা। অন্যদিকে ন্যাটো সদস্য তুরস্ককে ভাঙা সম্ভব না হলেও কুর্দি ইস্যু দিয়ে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিধি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
কিন্তু তুরস্কের সীমান্ত ঘেঁষে বর্তমান সিরিয়া এবং ইরাকের সীমান্তে পিকেকের অধীনে একটি কুর্দি রাষ্ট্র গঠনে পশ্চিমের কেন এত আগ্রহ? এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
মিসর, লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা যেভাবে ইসরায়েলের ওপর নির্ভর করছে, ঠিক একইভাবে ইরান ও তুরস্কের আগামীর নিরাপত্তা পরিকল্পিত এ কুর্দি রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করবে। আগত কুর্দি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবহার করে পশ্চিমারা পুরো মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। রাষ্ট্র ভাঙা-গড়ার এই খেলায় কোনো দলই ছাড় দিতে নারাজ। আঙ্কারা যে রকম নিজস্ব সীমানা ঘেঁষে কোনো ভাবেই পিকেকের অধীনে কোনো স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র মানতে রাজি নয়, ঠিক একই ভাবে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিজেদের সমুদ্র সীমানায়ও ছাড় দিতে রাজি নয়। আঙ্কারা নিজস্ব সীমানা সুরক্ষিত করতে সিরিয়া ও ইরাকে নিয়মিত হামলা করে যাচ্ছে। এর ফলে তুরস্ক এবং পশ্চিমাদের মধ্যে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী।
অবশ্যম্ভাবী এ সংঘর্ষে পশ্চিমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ধীরে ধীরে স্বৈরাচার হয়ে ওঠা এরদোয়ান ও তার দল একেপি। অতীতে পশ্চিমারা সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে এবার একটি আপাত বৈধ পন্থা বেছে নিয়েছে। আর এ ‘বৈধ’ পন্থাটি হলো অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে তুরস্কের জনমানুষকে খেপিয়ে তোলা আর এর মাধ্যমে একেপিকে ভেঙে আঙ্কারার রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল করা। এটা সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেনের এক ভিডিও বার্তায় ফাঁস হয়েছে। আর এ কাজে ইতিমধ্যে অনেকটাই এগিয়ে গেছে পশ্চিমারা। বৈশ্বিক করোনা মহামারি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের অভাবে তুরস্কের অর্থনীতি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, ডলারের বিপরীতে কয়েক শ ভাগ অবনতি হয়েছে তুর্কি লিরার। আর একেপি থেকে বেরিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতঅলু এবং সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী আলী বাবাজান নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন,যা নিশ্চিতভাবেই আগামী সাধারণ নির্বাচনে একেপিকে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
তবে যদি রাশিয়া ও চীনের সহযোগিতায় এরদোয়ান এ চ্যালেঞ্জকে কাটিয়ে উঠতে পারেন, তাহলে আগামীর মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ভূমধ্যসাগর এবং উত্তর আফ্রিকার চেহারা হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বদলে যাবে এ অঞ্চলের বর্তমান ক্ষমতা কাঠামো। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিনদের প্রভাব ক্ষীণ করে চীন ও রাশিয়াকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা বদল করে দিতে পারে তুরস্ক। পরিবর্তনের এ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোও। ব্রেক্সিট, করোনা মহামারি মোকাবিলায় সামষ্টিক ব্যর্থতা, ইউরোপের রাজনীতিতে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং মার্কিনদের ইউরোপ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া সম্ভবত আগামীর পরিবর্তনের কথাই বলছে।
রাহুল আনজুম: আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক গবেষক।