তিস্তা নদীর পানিতে এ বছর কার্তিক মাসে বন্যা হলো। যদিও কার্তিক মাসে বন্যা অস্বাভাবিক। সেই বন্যা অতীতের বর্ষা মৌসুমের বন্যার চেয়ে বেশি। লালমনিরহাট জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, তিস্তায় সর্বোচ্চ পানির উচ্চতা রেকর্ড হয়েছে এই বন্যায়। এ বছর গড় সমুদ্র সমতল থেকে পানির উচ্চতা ছিল ৫৩ দশমিক ৩০ মিটার। অতীতে এই উচ্চতা ছিল ৫৩ দশমিক ১৫ মিটার। আগে বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে তিস্তার পানি প্রবাহিত হয়েছিল। এ বছর হয়েছে ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে।
বাংলাদেশ সরকারকে তিস্তা নিয়ে ভাবতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে ভারত। বর্ষা মৌসুমে পানি আটকে রেখে ভয়াবহ বন্যায় ঠেলে দিচ্ছে বাংলাদেশকে। বছরে কয়েক দফা বন্যার কারণও ভারতের এ আচরণ। শুষ্ক মৌসুমে ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে যেমন পানি চাই, তেমনি বর্ষা মৌসুমে চাই ন্যায়সংগত পানি ব্যবস্থাপনা।
বাংলাদেশে বৃষ্টি ছাড়াই ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানিতে অনেকবারই বন্যা হয়। এ বছর সেই পানি এত বড় বন্যা ডেকে আনবে, তা কল্পনাতীত।
গত শুক্রবার কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নে তিস্তা নদীর পাশে সরিষাবাড়ী বাজারে কথা হচ্ছিল ইরাজ আলীর সঙ্গে। ইরাজ আলীর বয়স প্রায় ৬০ বছর। ছোটবেলা থেকে নদী দেখে বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু এত পানি একসঙ্গে আসতে দেখেননি কোনো দিন। তার পাশে ছিলেন মতলুব আলী। মতলুব আলীর বাড়ি মাস দু-এক আগে তিস্তাগর্ভে বিলীন হয়েছে। এখন বাড়ি তিস্তার মাঝচরে। তিনি বলছিলেন, ‘বুধবার সকালে পানি আসা শুরু হয়। স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি নাই পানি এত হইবে। দেখতে দেখতে কয়েক ঘণ্টায় নদী ভরি উঠিল। চরগুলা ডুবি গেইল। নদী উছলি পানি জমিত গেইল। পানি আর পানি। এক দিন পর পানি নামি গেইচে।’
বাংলাদেশে বৃষ্টি ছাড়াই ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানিতে অনেকবারই বন্যা হয়। এ বছর সেই পানি এত বড় বন্যা ডেকে আনবে, তা কল্পনাতীত। মতলুব আলী আরও বলছিলেন, ‘মরিচের খেত, আলুর জন্য চাষ করা জমি, ধানখেত আরও অনেক ফসল সোগ পানিত ডুবচে। শুধু মাঝের চরেই পানি স্রোতে ১০-১২টা বাড়ি ভাসি গেইচে। কয়েকটা ভাঙা ঘরের ওপরে বালু জমেছে। অনেক মানুষের কাটা পাকা ধান ভাসি গেইচে।’
একজন আঙুল উঁচু করে সামান্য দূরে দেখিয়ে বলেন, ‘ওই যে পুকুরটা, ওটার সোগ মাছ বের হইচে। পুকুরওয়ালা বুঝবার পায় নাই এত পানি হইবে। শত শত পুকুরের মাছ এবার এক দিনের বন্যায় নাই হয়া গেইচে।’ যে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম সেই দোকানি বলেন, ‘যদি আগেই জানা যেত তাহলে ক্ষতি কিছুটা কম হইত। বান শুরু হইচে সকালে, মাইকিং হইচে বিকেলে। ততক্ষণে সোগ শ্যাষ।’
চলতি বছরে বর্ষা মৌসুমে অন্তত অর্ধলাখ মানুষ তিস্তার ভাঙনে গৃহহীন হয়েছে। এদের অনেকেরই এখনো বাড়িঘর হয়নি। কেউ কেউ চরে গিয়ে কোনোরকম ঠাঁই সন্ধান করেছে। আর কিছুসংখ্যক নদীর পাড়ে মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তিস্তা নদীর পাড়ে গত শুক্রবারও দেখলাম সড়কের দুধারে অসংখ্য টিনের চাল, বেড়া রাখা আছে। ধান কাটা শেষ হলে সেখানে মাটি ভরাট করে তারপর বাড়ি হবে। নদীর কাছেই বাড়ি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোর্শেদুল আলমের। সে বলল, ‘নদী ভাঙা মানুষ জমি কিনতে গেলেই জমির দাম দ্বিগুণ-তিন গুণ হয়। বাধ্য হয়ে তাদের অনেক বেশি দামে সেই জমি কিনতে হয়। গরিবরা জমি কিনতে পারে না। তারা চরেই কোনোরকম থাকে।’
ভাটিতে যে একটি দেশ আছে, পানি হঠাৎ ছেড়ে দিলে তাদের যে ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে, এই চিন্তা অতীতের মতো না করে ভারত গজলডোবা ব্যারাজের সব জলকপাট এবারও একসঙ্গে খুলে দেয়। মুহূর্তেই পানিতে ভরে যায় বাংলাদেশ অংশের তিস্তা। তিস্তায় তখন পানি এতটাই যে ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজের সব জলকপাট খুলে দিয়েও পানি বের করা সম্ভব হচ্ছিল না।
এ বছর কার্তিকের এই পানি প্রাকৃতিক। কিন্তু বন্যা প্রাকৃতিক নয়। সিকিম ও জলপাইগুড়িতে কয়েক দিন টানা বৃষ্টি হয়েছে। এই পানি যদি কোথাও আটকে রাখা না হতো, তাহলে ধীরে ধীরে এই পানি নেমে যেত। সেটি হয়নি। প্রথমে পশ্চিমবঙ্গে গজলডোবা ব্যারাজের সব জলকপাট বন্ধ করে পানি আটকে রাখা হয়। মৌসুমের শেষ বৃষ্টি হিসেবে তারা পানি ধরে রেখে তাদের সেচ প্রকল্পে লাগাতে চেয়েছিল। বৃষ্টি এত বেশি হচ্ছিল যে পানি ছেড়ে না দিলে তাদের ওখানে বন্যা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করত। ভাটিতে যে একটি দেশ আছে, পানি হঠাৎ ছেড়ে দিলে তাদের যে ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে, এই চিন্তা অতীতের মতো না করে ভারত গজলডোবা ব্যারাজের সব জলকপাট এবারও একসঙ্গে খুলে দেয়। মুহূর্তেই পানিতে ভরে যায় বাংলাদেশ অংশের তিস্তা। তিস্তায় তখন পানি এতটাই যে ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজের সব জলকপাট খুলে দিয়েও পানি বের করা সম্ভব হচ্ছিল না। উত্তরের সংযোগ সড়কটি ভেঙে পানি প্রবাহিত হতে থাকে। ব্যারাজ এলাকায় লাল সংকেত জারি করা হয়। কার্তিকের এই বন্যায় রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলায় শেখ হাসিনা তিস্তা সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে গেছে। এখন রংপুর-লালমনিরহাট সেতুনির্ভর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
কার্তিকের বন্যায় লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হলো, শত শত পুকুরের মাছ চলে গেল, বাড়িঘরের ক্ষতি হলো। সরকার না পেরেছে ভারতের সঙ্গে পানি চুক্তি করতে, না পেরেছে তিস্তা নিয়ে যৌথ ব্যবস্থাপনার কাজ করতে। এমনকি ভারতের কারণে যে বাংলাদেশে এত বড় ক্ষতি হলো, সে বিষয়েও টুঁ শব্দ শোনা গেল না। কার্তিকের বন্যা হওয়ার কারণে ক্ষতিও আর তারা পুষিয়ে নিতে পারবে না। দেশের দারিদ্র্য মানচিত্রে নতুন গরিব হিসেবে যুক্ত হবে হাজার হাজার পরিবার।
বন্যা রোধে আগাম তেমন কোনো প্রস্তুতি সরকার গ্রহণ করে না। এ বছর কুড়িগ্রামের গতিয়াশামে নদী বাঁক নিয়ে জনপদের অনেক ভেতরে চলে গেছে। যদি জনপদ রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না যায়, তাহলে আগামী বছর ১০-১৫ হাজার বাড়ি আর লাখ লাখ হেক্টর জমি শুধু একটি উপজেলাতেই নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা আছে।
কুড়িগ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘গতিয়াশামসহ বিভিন্ন স্থানে তিস্তার ভাঙন রোধে আমরা প্রকল্প দাখিল করছি। আশা করি ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) কারিগরি সহায়তায় প্রকল্প অনুমোদন পাবে। তাহলে তিস্তার ভয়াবহ ভাঙন থেকে তীরবর্তী জনপদকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।’ বন্যা মৌসুম শেষ, তাই এবারও যদি সরকার ঘুমায়, তাহলে আগামী বছর তিস্তা ও তিস্তাতীরবর্তী লাখ লাখ মানুষের কান্নাই দেখতে হবে।
শুধু দেশীয় ব্যবস্থাপনায় তিস্তা সুরক্ষা হবে না। আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনে অনুসমর্থন করা জরুরি। ভারত চাইবে না, কিন্তু বাংলাদেশের তো চেষ্টা করতে হবে। এখনো কি দেয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকেনি? ভারত তার নিজ স্বার্থে পানি প্রত্যাহার করবে আবার পানি ছেড়ে দিয়ে ভয়াবহ বন্যার দিকে বারবার বাংলাদেশকে ঠেলে দেবে, এটি হতে পারে না।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক। [email protected]