সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচিত বিষয়ের মধ্যে একটি খবর হলো, প্রস্তাবিত তিস্তা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভারতের আপত্তির মুখে সেটা অনুমোদনের জন্য একনেকে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। প্রায় তিন বছর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের বিষয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ‘চীনের দুঃখ’ হিসেবে একসময়ে বিশ্বে পরিচিত হোয়াং হো নদীকে চীন ‘আশীর্বাদে’ পরিণত করেছে। ওই একই কায়দায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনগণের জন্য প্রতিবছর সর্বনাশ ডেকে আনা তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাকেও কীভাবে একটি বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা যায়, সেটাই ছিল প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধের বিষয়। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ চীনা অর্থায়নে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পর প্রকল্প প্রস্তাবটি চীনের পক্ষ থেকে কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একই সঙ্গে চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানের প্রস্তাব দিলে বাংলাদেশ তা গ্রহণ করে।
প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতরের তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন চালিয়ে নদীর মাঝখানের গভীরতাকে ১০ মিটারে বাড়িয়ে ফেলা হবে এবং নদীর প্রশস্ততাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা হবে। একই সঙ্গে নদীশাসনের মাধ্যমে ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। উপযুক্ত স্থানে বেশ কয়েকটি ব্যারাজ-কাম-রোড নির্মাণ করে নদীর দুই তীরের যোগাযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণ করে সেচ খাল খননের মাধ্যমে নদীর উভয় তীরের এলাকার চাষযোগ্য জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। উপরন্তু, নদীর উভয় তীরের সড়কের পাশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সুবিধাদি গড়ে তোলা হবে।
ইন্টারনেটে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বর্ণনায় এটা মনে হয়েছে যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সত্যি সত্যিই তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনজীবনে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হবে। প্রকল্প প্রস্তাবের অনুমোদন-প্রক্রিয়ার অগ্রগতির বিষয়টি আগ্রহভরে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিব এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান বিভিন্ন প্রতিবেদনে আশা প্রকাশ করেছিলেন যে ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন করা হবে। কিন্তু নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি—তিন মাস প্রকল্প প্রস্তাবের কোনো নড়াচড়া না দেখে খবরাখবর নিয়ে যতটুকু জানা গেল, তা হচ্ছে ভারত এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছে।
ভারত মনে করে, এই প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণ তাদের দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হবে এবং সে কারণে বাংলাদেশকে প্রকল্প বাতিলের জন্য সরাসরি চাপ দিয়ে চলেছে বলে জানা গেছে। তিস্তা প্রকল্পে চীন যুক্ত হলে ভারতের শিলিগুড়ি করিডরের ‘চিকেন নেকের’ কাছাকাছি কয়েক শ বা হাজারের বেশি চীনা নাগরিক অবস্থান করবেন এবং তা নাকি ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সে কারণে বাংলাদেশকে এই প্রকল্প থেকে সরে আসতে বলা হচ্ছে। এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, ভারত নাকি বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে, আগামী মার্চ-এপ্রিলে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতা থেকে হটানো গেলে ২০১১ সাল থেকে আটকে থাকা ‘তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি’ স্বাক্ষরে ভারতের আর কোনো বাধা থাকবে না।
যে প্রশ্নটির জবাব আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন মহলকে দিতেই হবে, তা হলো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কি আমাদের স্বার্থে স্বাধীনভাবে প্রকল্প গ্রহণ করতে পারব না? ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র, কিন্তু ভারতের অন্যায় কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করার তো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশের (ডিকাব) এক আলোচনা সভায় দাবি করেছেন, ‘ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে ‘দাদাগিরি’ করে না। এখন বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রকল্প যদি ভারতের চাপের কারণে বাদ হয়ে যায়, তবে আমরা তাকে কী বলব? একটা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে নিয়োজিত চীনা প্রকৌশলী এবং টেকনিশিয়ানরা কেন ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবেন? যে এলাকা দিয়ে তিস্তা নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে ‘শিলিগুড়ি চিকেন নেক’ অনেক দূরে। আর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার ভেতরে প্রকল্প এলাকায় যে চীনা নাগরিকেরা অবস্থান করবেন, তারা কীভাবে ভারতে জন্য স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত হন?
আমাদের স্মরণে আছে, ভারতের বিরোধিতার কারণে চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় নির্মিতব্য গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি বাতিল হয়ে গেছে। মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে একটি ভালো বিকল্প গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সুযোগ পেয়ে যাওয়ায় এখন জাপানের অর্থায়নে ওই বন্দরের নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। কিন্তু যে প্রশ্নটির জবাব আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন মহলকে দিতেই হবে, তা হলো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কি আমাদের স্বার্থে স্বাধীনভাবে প্রকল্প গ্রহণ করতে পারব না? ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র, কিন্তু ভারতের অন্যায় কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করার তো সুযোগ নেই।
আমরা দেখছি, সীমান্ত বিরোধ সত্ত্বেও ভারত চীনের সঙ্গে প্রায় এক শ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ নিজের অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চীন থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিতে গেলেই ভারত নানা অজুহাতে এর বিরোধিতা করছে। আমাদের জানা আছে, ভারত বাংলাদেশকে নানা প্রকল্পে যে ঋণসহায়তা দিয়েছে, সেগুলো এতই কঠিন শর্ত-কণ্টকিত যে বাস্তবে বাংলাদেশ ওই ঋণ সহায়তার সামান্যই ব্যবহার করতে পারছে।
তিস্তা নদী ঐতিহাসিকভাবেই খামখেয়ালি আচরণকারী একটি নদী। প্রায় প্রতিবছর বর্ষায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এই নদীর কারণে বন্যার কবলে পড়ে। আবার শুষ্ক মৌসুমে তুলনামূলকভাবে খরাগ্রস্ত এই এলাকার মানুষ তিস্তা নদীর পানিস্বল্পতাহেতু সেচ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত থাকে। তিস্তা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় ভারত একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়ার পর তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশ বছরের বেশির ভাগ সময় পানিশূন্য থাকছে। যখন ২০১১ সালে দুই দেশ তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তির কাছে নতি স্বীকার করে ড. মনমোহন সিং চুক্তি স্বাক্ষর থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন।
ভারত দীর্ঘদিন তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ঝুলিয়ে রেখেছে। কিন্তু এখন প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প সামনে চলে আসায় তিস্তা চুক্তি সইয়ের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। এখানে যা বিবেচনায় রাখতে হবে তা হচ্ছে, তিস্তা চুক্তি আর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প মোটেও সাংঘর্ষিক নয়। তিস্তা চুক্তি হোক বা না হোক, তিস্তা প্রকল্প ওই অঞ্চলের জনগণের জীবন ও জীবিকায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে বলে মনে করা হচ্ছে। চুক্তি হলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহ খানিকটা হয়তো বাড়বে, কিন্তু বর্ষায় গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেওয়ায় এই অঞ্চলের জনগণ যে বন্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তার তো কোনো সমাধান হবে না!
প্রস্তাবিত প্রকল্পের জলাধারগুলোর সংরক্ষিত পানি পরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হলে এই সমস্যার টেকসই সমাধান মিলতে পারে। এই প্রকল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার পর ওই এলাকার জনগণের মধ্যে প্রকল্পের ব্যাপারে উৎসাহ ও উদ্দীপনা বেড়েছে। প্রকল্পটির আশু বাস্তবায়নের জন্য দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি মানববন্ধন ও মিছিল হয়েছে। তিস্তা প্রকল্প অনুমোদনে আর বিলম্ব না করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সবিনয় অনুরোধ করছি।
ড. মইনুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক