কয়েক বছর ধরে চীন সরকার ধারাবাহিকভাবে এমন কিছু ঘোষণা দিচ্ছে এবং নতুন নতুন এমন আইন বানাচ্ছে, যাতে স্পষ্ট হচ্ছে, চীন সরকার তিব্বতি শিশুদের তিব্বতি ভাষা শিখতে দিতে চায় না। সর্বশেষ ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, চীন সরকার তাদের চতুর্দশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দিয়েছে। ওই পরিকল্পনার ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা, বিশেষ শিক্ষা এবং পেশাদার শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেব এবং প্রাক্-প্রাথমিকে ভর্তির হার ৯০ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাব। আমরা আদিবাসী সংখ্যালঘু অঞ্চলের শিশুশিক্ষার মানকে আরও অনেক উন্নত জায়গায় নিয়ে যাব এবং তাদের মধ্যে জাতীয় সাধারণ ভাষার পঠন ও লিখনকে জনপ্রিয় করব।’
এ পরিকল্পনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, চীন সরকার তার ‘জাতীয় সাধারণ ভাষা’ (মান্দারিন) সর্বস্তরে বিস্তৃত করতে চায় এবং এ ভাষায় সব শিশুকে পড়ালেখা শেখাতে চায়। এর মধ্য দিয়ে চীন মূলত তিব্বতের শিশুদের নিজস্ব পরিচয় ও ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দিয়ে তাদের মধ্যে চীনা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
চীন সরকার তিব্বত বা ইনার মঙ্গোলিয়ার মতো স্বায়ত্তশাসিত ভূখণ্ডগুলোকে শিগগিরই নিজের অভিন্ন প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করতে চাইছে। তার প্রস্তুতি হিসেবে এসব এলাকার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করতে তারা পরিকল্পনা হাতে নিয়ে থাকতে পারে
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তিব্বতি পরিচয় ধরে রাখার মূল অনুঘটক হচ্ছে তিব্বতি ভাষা। এ কারণে তিব্বতি ভাষাকে মুছে দিয়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে চীন মান্দারিন ভাষা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
রেডিও ফ্রি এশিয়ার (আরএফএ) খবর অনুযায়ী, গত মাসে কিংহাই প্রদেশের (তিব্বতিরা যেটিকে তাদের ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের সোঙ্গন প্রদেশ হিসেবে জানে) সব নগর ও শহরে চীন সরকার থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শীতকালীন ছুটিতে বাচ্চাদের কোনো ব্যক্তি বা কোনো সংগঠন অনানুষ্ঠানিকভাবেও তিব্বতি ভাষা শেখাতে পারবে না।
আরএফএ এক প্রতিবেদনে বলেছে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র তাদের জানিয়েছে, এমনিতে কোনো প্রাক্-প্রাথমিকে তিব্বতি ভাষা বা বর্ণ পরিচয় বাচ্চাদের শেখাতে দেওয়া হয় না। এ কারণে ছুটির সময় বাড়িতে অভিভাবকেরা বাচ্চাদের তিব্বতি বর্ণপরিচয় শেখাতেন। কিন্তু এবারের শীতকালীন ছুটিতে তা যাতে শেখানো না হয়, সে জন্য চীন সরকার তিব্বতিদের কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে।
মাস কয়েক আগে চীনা কর্তৃপক্ষ সোঙ্গন এলাকার কয়েকটি বেসরকারি স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে। যেসব স্কুলে তিব্বতি ভাষা শেখানো হয় এবং তিব্বতি সংস্কৃতিচর্চায় উৎসাহ দেওয়া হয় বলে চীনা কর্তৃপক্ষ খবর পাচ্ছে, সেগুলো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
গত মাসে সিচুয়ান প্রদেশের কারজে এলাকায় দ্রাগো মঠ পরিচালিত একটি স্কুলকে ভেঙে ফেলার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে তিন দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। তাদের বলে দেওয়া হয়, স্কুল ভবনটি ভেঙে না ফেললে চীনা কর্তৃপক্ষ তা ভেঙে ভবনের ইট-রড-কাঠ নিয়ে যাবে। পরে সত্যিই তা ভেঙে ফেলা হয়।
ইতিমধ্যে তিব্বতের যাবতীয় নথি, নোটিশ, যোগাযোগ এবং চিঠিপত্র লেখায় চীনা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে তরুণ প্রজন্ম এ ভেবে দুশ্চিন্তায় আছে যে খুব ঠান্ডা মাথায় তাদের মাতৃভাষাকে চীনা কর্তৃপক্ষ মেরে ফেলছে। তারা বুঝতে পারছে, মাতৃভাষায় মনের ভাব যত সহজে প্রকাশ করা যায়, চীনা ভাষায় তা সম্ভব হয় না।
২০১০ সালে মাতৃভাষায় আঘাত আসার প্রতিবাদে সোঙ্গন প্রদেশের তোগরেন এলাকায় প্রায় সাত হাজার তিব্বতি তরুণ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছিলেন। মনে করা হচ্ছে, চীন যদি তিব্বতি ভাষাকে কোণঠাসা করা অব্যাহত রাখে, তাহলে তা তিব্বতি জনসাধারণকে আন্দোলনমুখী করে তুলতে পারে।
গত বছর ইনার মঙ্গোলিয়ায় মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে মঙ্গোলিয়ান ভাষার পাশাপাশি চীনা ভাষা রাখায় চীনা কর্তৃপক্ষ বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। এতে মঙ্গোলিয়ার মানুষ নানাভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
ধারণা করা হচ্ছে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তিব্বত, পূর্ব তুর্কিস্তান ও ইনার মঙ্গোলিয়ায় চীনা মতাদর্শ চাপানোর ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ বাড়াতে থাকবেন। এর প্রাথমিক ধাপ হিসেবে চীনের সংবিধান থেকে আদিবাসীদের ভাষার অধিকার সংরক্ষণের ধারাগুলো বাতিল করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চীনের ভাষা শিক্ষার অ্যাপ টকমেট এবং অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট বিলিবিলি থেকে গত মাসে তিব্বতি ও উইঘুর ভাষা মুছে ফেলা হয়েছে।
জাপানের শিজুকা ইউনিভার্সিটির সাংস্কৃতিক প্রত্নবিজ্ঞানী ইয়াং হাইয়িং মনে করছেন, চীন সরকার তিব্বত বা ইনার মঙ্গোলিয়ার মতো স্বায়ত্তশাসিত ভূখণ্ডগুলোকে শিগগিরই নিজের অভিন্ন প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করতে চাইছে। তার প্রস্তুতি হিসেবে এসব এলাকার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করতে তারা পরিকল্পনা হাতে নিয়ে থাকতে পারে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● কারমা তেনজিং তিব্বত পলিসি ইনস্টিটিউটে শিক্ষানীতি বিষয়ে গবেষণা করছেন