তালেবানের কাবুল পুনর্দখলের পাঁচ মাসও পেরোয়নি। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে তার হানিমুন কাল শেষ হয়ে গেছে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। ইসলামাবাদের জন্য বিষয়টা উদ্বেগের, কিন্তু ইতিহাসের পুরোনো ক্ষতগুলো ধামাচাপা দিয়ে সামনে এগোনো প্রকৃতই মুশকিল।
বিরোধ বেধেছে সীমান্তপ্রাচীর নিয়ে
বিশ্বজুড়ে তালেবানের বন্ধুরাষ্ট্র বলতে এখনো কেবল পাকিস্তান। অথচ পাকিস্তান সরকারের সীমান্তপ্রাচীর নির্মাণের বিরোধিতায় নেমেছেন তালেবান সৈনিকেরা। কেবল মৌখিক বিরোধিতা নয়, সীমান্তের কিছু জায়গায় নির্মাণাধীন কাঁটাতারের বেড়া উপড়েও ফেলেছেন তাঁরা। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ কোরেশি এ ঘটনাকে ‘দুষ্কৃতকারীদের কাজ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে সঙ্গে এ–ও বলেছেন, ‘সমস্যাটি কূটনৈতিকভাবে সমাধান’ করা হবে। পাকিস্তান এ বিষয়ে তালেবানের সঙ্গে বিবাদ এড়াতে চায়, সেটা কোরেশির বক্তব্যে আঁচ করা যাচ্ছে। কিন্তু তালেবানের দিক থেকে এ নিয়ে খোলামেলাই পাকিস্তানকে দোষারোপ করা হয়েছে। তালেবান প্রতিরক্ষা বিভাগের মুখপাত্র এনায়েতুল্লাহর এ রকম ভিডিও বহুল প্রচার পেয়েছে, যেখানে তিনি বলছেন, ‘পাকিস্তানের কোনো অধিকার নেই সীমান্তপ্রাচীর তৈরি করে ওই এলাকাকে বিভক্ত করার।’
পাকিস্তান যে কারণে কাঁটাতার বসাচ্ছে
পাকিস্তান মনে করে, তারা যে সীমান্তপ্রাচীর বানাচ্ছে, সেই ‘ডুরান্ড লাইন’ দুই দেশের পুরোনো ‘সীমানা’। প্রায় ১ হাজার ৬০০ মাইল দীর্ঘ এ সীমান্তে অন্তত আড়াই শ ক্রসিং আছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ‘সন্ত্রাসী’দের চলাচল থামানো যাবে না। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য এ মুহূর্তে জরুরি এটা। আফগানিস্তানের দিক থেকে পাকিস্তানে বহুমাত্রিক নিরাপত্তা–হুমকি আছে, এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই। ‘টিটিপি’ ছাড়াও বালুচ জাতীয়তাবাদীরাও সীমান্তের অপর দিকে লুকিয়ে থাকে বলে ইসলামাবাদের দাবি আছে। এ ছাড়া মাদকের প্রবাহ রুখতেও এ সীমান্তকে নিয়ন্ত্রণ জরুরি। চীন-পাকিস্তান করিডরকে চোরাগোপ্তা হামলা থেকে বাঁচাতেও পাকিস্তান-আফগান সীমান্তকে অবৈধ চলাচলমুক্ত রাখতে হবে। এ সীমানায় প্রাচীর বসানো পাকিস্তানের দিক থেকে নিজ ভূখণ্ডের মালিকানাগত কারণেও দরকার। আবার এ কাজ থামানো তালেবানের দিক থেকেও অনিবার্য এক জাতীয় দায়িত্ব।
তবে ইতিমধ্যে সীমান্তের প্রায় ৮০ ভাগ জায়গায় দুই স্তরে কাঁটাতার বসানো হয়ে গেছে। উচ্চতায় ১২-১৩ ফুট প্রতিটি প্রাচীর। কিছু দূর পরপর বসেছে প্রায় এক হাজার উঁচু টাওয়ার। ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে এসব কাজে। বলা হচ্ছে, প্রাচীর নির্মাণ শেষ হলে দুই দেশের মধ্যে কেবল ১৬টি নির্ধারিত জায়গা দিয়ে আসা-যাওয়া করা যাবে। দুই দিকের বাসিন্দাদের জন্য এ রকম এক নিয়ন্ত্রিত ভবিষ্যৎ মেনে নেওয়া কঠিন, যেখানে তারা শত শত বছর ধরে এসব জনজাতি অবাধে আসা-যাওয়া করেছে।
প্রাচীর নির্মাণে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আছে
ডুরান্ড লাইনে তালেবান কাঁটাতার উপড়ে ফেলায় পাকিস্তানে প্রতিবাদ উঠেছে তাৎক্ষণিক এবং বেশ সরাসরি ভাষায়। দেশটির সেনা আমলাতন্ত্রের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত আইএসপিআর ৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, এ প্রাচীর তৈরিতে শহীদদের রক্ত মিশে আছে, পরিকল্পনামতোই চলবে এর নির্মাণ। আইএসপিআরের মহাপরিচালক জেনারেল বাবর ইফতারের এ বক্তব্য যে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীরই কথা, তাতে সন্দেহ থাকার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য এটা বিব্রতকরই বটে, এমন হুংকার দিতে হচ্ছে সেই সরকারকে, যাদের গড়েপিটে বড় করে করেছে তারা। বাবর ইফতেখার এ–ও বলেছেন, সীমান্তপ্রাচীর গড়ার কাজটি এ মুহূর্তে বেশ ‘চ্যালেঞ্জিং’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আশ্বস্ত করেছেন, কোনো জাতিসত্তাকে বিভক্ত করার জন্য নয়, সীমান্তের উভয় দিকের মানুষকে সুরক্ষিত করার জন্য এ প্রাচীর। মুশকিল হলো, আইএসপিআর যাকে ‘সীমান্ত’ বলছে, আফগানিস্তান ঐতিহাসিকভাবে সেটাই স্বীকার করছে না। ফলে বিবাদের মূল জায়গার ফয়সালা হচ্ছে না এ সংবাদ সম্মেলন শেষে। তবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সমর্থন আছে পাকিস্তানের অবকাঠামোগত এ উদ্যোগে।
পাকিস্তান কাঁটাতারের মাধ্যমে আফগান সীমান্তে শুধু সশস্ত্রতা থামানো নয়, একই সঙ্গে এই সীমান্তকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার চেষ্টাও করছে। পশতু ও বালুচদের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আফগানিস্তানের আপত্তির জায়গাটা সেখানেই। তারা মনে করে, ব্রিটিশদের তৈরি এ সীমান্ত অন্যায্য, অমানবিক। এটা তাদের বিভক্ত করে দুর্বল করেছে। এর ফলে প্রতিপক্ষ জাতিসত্তাগুলো তাদের সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে।
পশতু ও বালুচরা যে কারণে এ ‘সীমান্ত’-এর বিরুদ্ধে
পাকিস্তান-আফগান সীমান্ত নিয়ে বিবাদের শুরু ঔপনিবেশিক আমল থেকে। ভারতবর্ষের দখলদার ব্রিটিশ শক্তি একাধিক যুদ্ধের পরও আফগানিস্তান পুরোপুরি দখল করতে পারেনি, বরং আফগান শাসকদের তার ঠিক করে দেওয়া সীমানা মেনে চলতে বাধ্য করেছিল। তাদের কর্মকর্তা হেনরি মর্টিমার ডুরান্ড কাবুলে ‘পলিটিক্যাল এজেন্ট’-এর দায়িত্ব পালন করতেন। এই লোককে দিয়ে তারা ১৮৯৩-এ এই সীমানা এঁকে নেয়। স্বভাবত এতে আফগানদের স্বাধীন মতামত প্রাধান্য পায়নি, ভারতবর্ষের মালিক হিসেবে ব্রিটিশদের স্বার্থই মুখ্য বিষয় ছিল। ১৯৪৭-এর পর ডুরান্ডের এই ‘লাইন টানা’র সুবিধা পায় নতুন রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’।
মর্টিমার ডুরান্ডের এই সীমান্তরেখার মূল মানবিক ক্ষতি হলো এটা পশতু ও বালুচদের জনপদগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে ভাগ করে দুই দিকে ফেলে দিয়েছে। যে জনপদ মর্টিমার ডুরান্ড ভাগ করেছেন, সেটা ঐতিহাসিকভাবে পশতু আর বালুচ এলাকা। সংগত কারণেই এসব জাতি প্রথম থেকে এই কৃত্রিম রেখার তীব্র বিরোধী। পাকিস্তান কাঁটাতারের মাধ্যমে আফগান সীমান্তে শুধু সশস্ত্রতা থামানো নয়, একই সঙ্গে এই সীমান্তকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার চেষ্টাও করছে। পশতু ও বালুচদের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আফগানিস্তানের আপত্তির জায়গাটা সেখানেই। তারা মনে করে, ব্রিটিশদের তৈরি এ সীমান্ত অন্যায্য, অমানবিক। এটা তাদের বিভক্ত করে দুর্বল করেছে। এর ফলে প্রতিপক্ষ জাতিসত্তাগুলো তাদের সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। এ মুহূর্তে পাকিস্তানে জনসংখ্যার প্রায় ১৫ ভাগ পশতু। দেশটির প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় বেলুচিস্তান। কিন্তু দেশটিতে প্রভাবের দিক থেকে এগিয়ে অবশ্যই পাঞ্জাবি ও সিন্ধিরা। ভৌগোলিক বিভক্তি পশতুদের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পাকিস্তানে যেমন দুর্বল করেছে, তেমনি তাদের অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষাও খাটো করেছে। পাকিস্তানের প্রভাবশালী দলগুলো এবং রাষ্ট্রকাঠামো কোনোভাবেই চলতি এই ‘স্থিতিশীলতা’র নড়চড় চাইবে না। ফলে চলতি ‘সীমান্ত’ থেকে পিছু হটে আসার রাজনৈতিক ঝুঁকিও নেবে না তারা। আবার এ–ও সত্য, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে জাতীয়ভাবে জনপ্রতিনিধিত্বশীল কোনো রাজনৈতিক সরকার বা শক্তি ডুরান্ড লাইনকে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা-পর্যালোচনার পর অনুমোদন করেছে, এমন ঘটেনি।
তালেবানের দিক থেকে ডুরান্ড লাইনে প্রাচীর নির্মাণ ঠেকানোর ভিন্ন দায়ও আছে। ‘টিটিপি’ নামে তাদের রাজনৈতিক মিত্রশক্তি আছে পাকিস্তানে। সেই পাকিস্তানি-তালেবানের মাঝেমধ্যেই আফগানিস্তানে আশ্রয় নিতে হয়। টিটিপি কোনোভাবেই এ সীমান্তে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দেখতে চাইছে না। কাবুলের শাসকদের কণ্ঠে টিটিপির সেই চাওয়াই ধ্বনিত হচ্ছে। তা ছাড়া ১৯৪৯ সালে আফগানিস্তানে ট্রাইবাল প্রধানদের যে সম্মেলন (জিরগা) হয়, তাতে ডুরান্ড লাইনকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। আজকের তালেবানের সে সিদ্ধান্তের বিপক্ষে দাঁড়ানো কঠিন, যদিও একদা দাউদ খান এ ‘লাইন’কে সীমান্ত হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।
সংকটের সমাধান কী
ডুরান্ড লাইন নিয়ে বিবাদের সমাধান হলো, এ সীমান্তের ব্যবস্থাপনায় পশতু ও বালুচ সামাজিক নেতৃত্বকে চালকের আসন দেওয়া। একই সঙ্গে সীমানার জমিজমা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আফগানদের ছাড় দেওয়া। এতে পাকিস্তানকে কিছু এলাকা হারাতে হতে পারে। এ মুহূর্তে এ রকম ছাড় পাকিস্তানের দিক থেকে প্রায় অসম্ভব। ফলে এ বিরোধের আপাত–সমাধান নেই।
কাবুলে গত ৭৫ বছরে এখনকার মতো পাকিস্তানবান্ধব সরকার আর আসেনি। তালেবান নেতৃত্বকে আস্থায় নিয়ে পাকিস্তানের বর্তমান সরকারের সামনে সীমান্ত সমস্যা সমাধানের ঐতিহাসিক এক সুযোগ এসেছে বলা যায়। কিন্তু আফগানদের কোনোরূপ ভৌগোলিক ছাড় দেওয়ার জন্য যে জাতীয় ঐকমত্য দরকার, সেটা ইমরান সরকারের পক্ষে জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। ফলে শক্তির জোরেই ডুরান্ড লাইনে প্রাচীর তৈরির কাজ দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হবে। বলা যায়, এই প্রাচীর আফগানদের মেনে নিতে চাপ দিয়ে যাবে পাকিস্তান। তালেবান নেতৃত্বও টিকে থাকার সংগ্রামে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আপাতত পাকিস্তান সরকারের চাওয়াকে সম্মান দেখিয়ে যাবে। এ মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মুখে পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ করা ও ক্ষুব্ধ রাখা তাদের পক্ষে খারাপ বিলাসিতাই হবে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে এ নিয়ে বিবাদ যে তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকবে, সেটা অস্বীকার করা যায় না।
ডুরান্ড লাইন পশতু জাতীয়তাবাদের প্রধানতম এক অ্যাজেন্ডা। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের আগামী দিনের কোনো নেতৃত্বের পক্ষে একে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই।
● আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক