অর্থনীতি ও জনসংখ্যার অনুপাতে রাশিয়ায় হয়তো ভাটার টান দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কৌশলগত দিক থেকে তার পুনর্জাগরণ ঘটছে। এই মুহূর্তে তারা সামরিক বাহিনীকে আবারও ব্যাপক অস্ত্রে সজ্জিত করছে, যার মাধ্যমে তাদের বৈশ্বিক প্রভাব বাড়বে। ক্রেমলিনের সর্বশেষ ভূকৌশলগত লক্ষ্য হচ্ছে আফগানিস্তান, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।
তিন দশক আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছে, যে যুদ্ধে তার অর্থনীতি দুর্বল হয়েছে এবং কমিউনিস্ট রাষ্ট্র কমজোর হয়েছে। এখন রাশিয়া আবার আফগানিস্তানের মূল খেলোয়াড় হতে যাচ্ছে। আফগান তালেবানদের বুকে টেনে নিয়ে ক্রেমলিন অনেককেই বিস্মিত করেছে। অথচ পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি এই অশুভ শক্তিকে রাশিয়া একসময় বিশ্বের প্রধান সন্ত্রাসবাদী হুমকি হিসেবে দেখত। মার্কিনদের নেতৃত্বে যে আন্তর্জাতিক শক্তি আফগানিস্তানের মাটিতে তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার মাটি ছিল সেই বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ পথ।
আফগান তালেবানদের প্রসঙ্গে রাশিয়ার এই যে অবস্থান পরিবর্তন, তার সঙ্গে মূলত দেশটির বৃহত্তর নিরাপত্তার ব্যাপারটি জড়িত। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে তার যে দ্বৈরথ, তার সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ খেপে গিয়ে দেশটির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তখন থেকেই এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হতে শুরু করে। বস্তুত, রাশিয়া এখন আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা নিচ্ছে।
১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সোভিয়েত কর্তৃক আফগানিস্তান দখলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়তে ইসলামকে আদর্শিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সিআইএ এই যুক্তিতে হাজার হাজার আফগান মুজাহিদীনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল যে শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়। পরবর্তীকালে এই জিহাদি বাহিনীর ভেতর থেকেই আল-কায়েদা ও তালেবানদের উদ্ভব হয়।
আজ রাশিয়া ঠিক সেই যুক্তিতে আফগান তালেবানদের সহযোগিতা করছে। তারা চায়, এরা মার্কিন-সমর্থিত দুর্বল আফগান সরকারের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাক। তালেবানরা স্বীকার করেছে, মার্কিনদের হটানোর জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে তারা সব ধরনের সহায়তাই নেবে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আশা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র যে আফগানিস্তানে সামরিক ঘাঁটি গেড়ে মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাতে চায়, তার জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভূত মূল্য দিতে বাধ্য করবে। আফগান সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৪ সালের নিরাপত্তা চুক্তি অনুসারে আশপাশের দেশগুলোর ওপর নজরদারি করতে যুক্তরাষ্ট্র সেখানকার অন্তত নয়টি ঘাঁটিতে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ায়ও নজরদারি চালাতে পারবে। আফগানিস্তানে রাশিয়ার বিশেষ প্রতিনিধি জমির কাবুলভের কথায়, রাশিয়া কখনোই এটা ‘সহ্য করবে না’।
আরও বৃহৎ পরিসরে বললে, পুতিন তাঁর ভূরাজনৈতিক দাবার বোর্ড আরও বড় করতে চান। তিনি আশা করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে শ্বাসরুদ্ধকর অর্থনৈতিক অবরোধ থেকে কিছুটা ছাড় আদায় করতে পারবেন। পুতিন বিশ্বাস করেন, রাশিয়া আফগানিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র সেখানকার যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে রাশিয়ার সাহায্য নেবে। সিরিয়া–বিষয়ক পুতিনের অবস্থানের সঙ্গেও এই মনোভাবের মিল রয়েছে। রাশিয়া ইতিমধ্যে ইসলামিক স্টেট উৎখাতে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে।
তালেবানদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে পুতিন এই বার্তা দিতে চাচ্ছেন যে যুক্তরাষ্ট্র যে কায়দায় সিরিয়ার বিদ্রোহীদের মদদ দিয়ে রাশিয়া-সমর্থিত বাশার আল-আসাদের সরকারকে দুর্বল করে দিচ্ছে, তাঁরাও একই কায়দায় আফগান সরকারকে অস্থিতিশীল করতে পারবেন। ইতিমধ্যে ক্রেমলিন ঠারেঠোরে সতর্ক করে দিয়েছে, পশ্চিমারা যদি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র দেয়, তাহলে রাশিয়াও আফগান তালেবানদের একই জিনিস দেবে। এতে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। কারণ, ২০০১ সালে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর এই প্রথম দেশটির সিংহভাগ ভূমির নিয়ন্ত্রণ তালেবানদের হাতে।
রাশিয়া এই কৌশলের খেলায় আরও বিভিন্ন দেশকে যুক্ত করছে। আফগান তালেবানদের সঙ্গে কয়েকটি সরাসরি বৈঠক করা ছাড়াও রাশিয়া পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে মস্কোতে ত্রিপক্ষীয় আফগান–বিষয়ক আলোচনা করেছে। আফগান তালেবানদের সহায়তা করার জন্য ইরানসহ ওই তিন দেশের জোট হলো বলে।
আফগানিস্তানের মার্কিন সামরিক কমান্ডার জেনারেল জন নিকোলসন আরও কয়েক হাজার অতিরিক্ত মার্কিন সেনা মোতায়েন করতে চান। সম্প্রতি তিনি আফগানিস্তানে রাশিয়াসহ অন্যান্য শক্তির ‘ক্ষতিকর প্রভাবের’ কথা উল্লেখ করেছেন। গত বছর তিনি মার্কিন সিনেট আর্মড ফোর্সেস কমিটির কাছে বলেছেন, রাশিয়া ‘ন্যাটোর প্রচেষ্টা খাটো করতে প্রকাশ্যেই তালেবানদের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।’
নিকোলসনের ভাষ্যমতে, বাস্তবতা হচ্ছে, রাশিয়া ঠুনকো অজুহাতে তালেবানদের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করতে চায়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিমান হামলা ও অভিযানের কারণে আইএস যোদ্ধাদের আফগানিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা গেছে। যেভাবেই হোক, এই আইএসের সঙ্গে সিরিয়ার আইএসের যোগাযোগ খুবই কম। আফগান আইএস মূলত পাকিস্তানি ও উজবেক চরমপন্থীদের নিয়ে গঠিত। যারা ‘পুনরায় সংগঠিত’ হয়ে পাকিস্তান সীমান্তের ধার ঘেঁষে ভূমি করতলগত করেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র নিজেই রাশিয়ার এই আফগান কৌশলের দ্বার খুলে দিয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তালেবানদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার জন্য কাতারে অনানুষ্ঠানিক কূটনৈতিক কার্যালয় খুলেছিলেন। এরপর একজন গ্রেপ্তারকৃত মার্কিন সার্জেন্টকে ছাড়ানোর জন্য গুয়ানতানামো বে কারাগারে আটক পাঁচজন জ্যেষ্ঠ তালেবান নেতাকে ছেড়ে দেন।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে তালেবানদের অভয়াশ্রম উৎখাতে আপত্তি জানিয়েছে। যদিও নিকোলসন স্বীকার করেছেন, ‘শত্রুপক্ষ যখন ময়দানে বাইরের শক্তির সাহায্য পায় বা তাদের নিরাপদ আশ্রয় থাকে, তখন যুদ্ধে সফল হওয়া খুবই কঠিন।’ কিন্তু বৈপরীত্য হলো, পাকিস্তান সবচেয়ে বেশি মার্কিন সাহায্য পাওয়া দেশগুলোর একটি। আরেকটি ব্যাপার চোখ এড়িয়ে যায় না, সেটা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় তালেবানরা নেই। ফলে তারা তালেবানদের সঙ্গে রাশিয়ার শান্তি প্রস্তাব ও পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা করলে তা বিশ্বাসযোগ্য হয় না।
মার্কিনদের পক্ষে তালেবানদের সমঝোতার আহ্বান করা কঠিন। এখন আবার রাশিয়া আফগানিস্তানে ‘মহান খেলার’ পুনরুত্থান ঘটিয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপারটা এখন অসম্ভব হয়ে যেতে পারে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক।