তাকসিম, ওয়াসাকে ক্ষমা করুন
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান ভাগ্যের বরপুত্র। তিনি রাজনীতিবিদ নন। কিন্তু প্রমাণ করে চলেছেন, তিনি আসলে রাজনীতিরই বরপুত্র। তবে সেই রাজনীতিটা রুগ্ণ। ২০০৯ থেকে বহু ঝানু রাজনীতিবিদ দৃশ্যপট থেকে নাই হয়েছেন। বাধ্যতামূলক অবসরে গেছেন। সবাই যে ব্যর্থতা নিয়ে গেছেন, তা-ও নয়। অনেকে সাফল্য দেখিয়েছেন, কিন্তু রাজনীতির বিবেচনায় তাঁকে পর্দার আড়ালে চলে যেতে হয়েছে। তাকসিম খান এখানে মহা ব্যতিক্রম। পঞ্চমবারের মতো তিনি একটি পদে তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর প্রথম নিয়োগ থেকে প্রতিটি নবায়ন প্রশ্ন, দ্বন্দ্ব ও সন্দেহ তৈরি করেছে। সেদিক থেকে তিনি অতুলনীয়।
দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি অনেক সংস্থারই সমালোচনা করে। কিন্তু ওয়াসার এমডি সম্পর্কেই সম্ভবত তারা সব থেকে কঠোরতম বাক্যটি ব্যবহার করেছে। তারা তাকসিম খানের আমলে ‘দুর্নীতির অভূতপূর্ব বিস্তার’ দেখেছে এবং এ জন্য খানের ‘এককেন্দ্রিক আধিপত্যবাদ উৎখাতে’র আহ্বান জানিয়েছে।
গণতন্ত্রের রীতিনীতির কথা বাদ দিলে শোভন-অশোভনের ব্যাপার বলেও তো একটি কথা রয়েছে। পশ্চিমা সমাজের সঙ্গে আমাদের বড় তফাত সংস্কৃতির। অন্তত পদ-পদবির বিষয়ে। পরপর দুই মেয়াদের পর তৃতীয় মেয়াদ আইনত নিষিদ্ধ করার অর্থ কী? তৃতীয় মেয়াদে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তো আরও অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। তিনি হতে পারেন অত্যন্ত জনপ্রিয়, সৎ ও যোগ্যতম নেতা। তাহলে নিষিদ্ধ করা কেন? এর একটা কারণ অবশ্যই এটা যে নতুনদের জন্য জায়গা করে দেওয়া। সমাজে তো আরও যোগ্য লোক আছে, তাঁদের সুযোগ দেওয়া। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বৈধতা সব সময় চ্যালেঞ্জযোগ্য। কারণ, এটা অন্য মেধাবীদের উৎকর্ষ অর্জনের পথ রুদ্ধ করে দেয়।
আর তাকসিম খান নিজেও কি মানেন যে ওয়াসার নেতৃত্ব অবশ্যই কেবল তাঁকেই দিতে হবে। নিয়মকানুন, রেওয়াজ সব চুলোয় যাক। নন্দলালের কথা মনে পড়ছে। তিনি চলে গেলে ওয়াসার কী হবে—এই ভাবনাতে কি তিনি অস্থির? নন্দলালের মতো তিনি কি তবে ওয়াসার জন্য প্রাণত্যাগের পণ করলেন? তিনি হতে পারেন ক্ষমতাসীন দলের পরীক্ষিত মিত্র। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের মিত্রের তো আকাল পড়েনি। তাঁর নতুন মেয়াদে ওয়াসা আরও কতটা ডুবে যাবে, সেটা তাঁর সমালোচকদের আগ্রহের বিষয়। তবে এটা এখনই হলফ করেই বলা যায়, তিনি ক্ষমতাসীন দলের জন্য একটা বিরক্তিকর বোঝা হিসেবেই গণ্য হবেন।
ওয়াসার ওয়েবসাইটে গেলে তাঁর কিছু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দেখা মিলবে। যেমন টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন। খতিয়ে না দেখলে মনে হবে, টাইমস অব ইন্ডিয়ার নিজেরই বুঝি তাকসিম-সাফল্যে তাক লেগে গিয়েছিল। শিরোনাম, ‘পানির ক্ষতি কমাতে ঢাকা থেকে শিক্ষা নিতে পারে বেঙ্গালুরু’। আসল ঘটনা হলো, ২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার লস সামিট হয়েছিল বেঙ্গালুরুতে। সেই কনফারেন্সে তিনি দাবি করেছিলেন, ‘শুধু ৪৭ ভাগ পুরোনো পাইপ বদলেই বড় সাফল্যের মুখ দেখেছে ওয়াসা। ২০০৩ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ২৯ ভাগ থেকে ৫৩ ভাগ পানির লোকসান কমাতে পেরেছেন এবং ২০১৫ সালের মধ্যে আরও ২২ ভাগ পানির লোকসান কমাতে সক্ষম হন।’
অথচ তাঁর মেয়াদজুড়ে ওয়াসা সব থেকে বেশি সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে, পানির নিম্নমান, দূষণ, ব্যাকটেরিয়া, পানির সরবরাহ সংকট, ভুতুড়ে বিল, ১২ বছরে ১৩ বার মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয়ে। পানির লোকসান কমানোর মতো বিষয়ে তিনি টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রশংসা পেয়েছেন। আর সেসবও তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ওয়াসার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করছেন। এই সাফল্যের জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতেই পারেন। কিন্তু কথা হলো, এসবের কোনো কিছুই তাঁকে এমডি পদে ‘অমরত্ব’ লাভের অধিকার দিতে পারে না।
পাঁচ দফায় তাঁকে কী প্রক্রিয়ায় এমডি পদে মেয়াদ বাড়ানো হলো, সে জন্য প্রচুর নথি চালাচালি হয়েছে। কার্যকর সংসদ থাকলে এই নথিগুলো স্থায়ী কমিটিতে তলব করার দাবি তোলা যেত। ওয়াসার বোর্ড তার নিয়োগদাতা। তার নিয়োগ বিষয়ে এই পাঁচবারে বোর্ড কী প্রস্তাব পাস করেছে, সেগুলো পাবলিক রেকর্ড। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনের সঙ্গে এসব নথির মূল ইমেজ আমরা ওয়াসার ওয়েবসাইটে দেখতে চাই।
তাঁর বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘন করে মন্ত্রণালয়কে অগ্রাহ্য করে দুই পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এটা শুধু ক্ষমতার অপব্যবহার নয়, তাঁর আধিপত্যবাদের অন্যতম চরম নিদর্শন। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো রয়েছে, তার দুটি বড় দিক আছে। একদিকে সুপেয় পানি, পয়ঃপ্রণালি বা জলাবদ্ধতার সংকট বিষয়ে তাঁর নিজের বা ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতা। অন্যদিকে ওয়াসা নামের একটি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো ধ্বংস করে দেওয়া। আইন ও রীতিনীতির পথ থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে বিচ্যুত করা। এর ফল দাঁড়িয়েছে, তাঁর আমলটি না পেরেছে কোনো একটি বিষয়ে নগরবাসীর চাহিদা সর্বোচ্চ পূরণ করতে; না পেরেছে, ওয়াসার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ন্যূনতম পর্যায়ে ধরে রাখতে। ওয়াসা ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রক্রিয়া তাঁর আমলেই হয়তো সব থেকে বেশি রক্তাক্ত জখম হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো কমতি নেই। মানুষের সেবা দিতে না পারলেও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। সেই অভিযোগ আর যা-ই হোক, গুজব যে ছিল না, তার প্রমাণ দুদক কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি আমলে নেওয়া। তাঁর কীর্তিকলাপের বিষয়ে নানা সময়ে হাইকোর্টের নজরে নেওয়া হয়েছে। আদালত অবমাননার রুলও তাঁর ওপর জারি হয়েছে। এমনকি একবার তিনি আদালতকে বলেছিলেন, ওয়াসার কোনো বর্জ্য নিঃসরণ পাইপ বুড়িগঙ্গায় মেশেনি। পরে আদালতে সরকারই তথ্য দেয় যে ওয়াসার এ রকম বর্জ্যের পাইপ ৫০টির বেশি বুড়িগঙ্গায় মিশেছে। আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বুধবার জানান, ‘এ বিষয়ে হলফ করে মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় আদালত তাঁকে দুবার তলব করে আনেন।’
তবে আদালত মোকাবিলা ও ওয়াসার বোর্ড মোকাবিলার কৌশলে একটা চমকপ্রদ মিল পেলাম। হাইকোর্ট থেকে নেমেই তিনি পাইপ না সরিয়ে পাইপের মুখে কাপড় গুঁজে বর্জ্য বন্ধের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তাঁর নিয়োগ নবায়নেও ওয়াসার বোর্ডের মুখে কাপড় গুঁজেই পরিস্থিতি ঠেকা দিয়ে চলেছেন।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে এই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে যোগ্যতা নয়, অদৃশ্য শক্তি তাঁকে বারবার এই পদে ধরে রাখছে। সব আইনকানুন ভেঙে যাচ্ছে। তিনি আইনের ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। এভাবে আমাদের সবার চোখের সামনে একটি চরিত্র তৈরি হয়ে গেল। তিনি এখন একটি পরাক্রমশালী চরিত্রের নাম। তাঁর আয়ু সরকারের মেয়াদের সমান। টিআইবি আগামী ১৪ অক্টোবর সবশেষ মেয়াদ ফুরানোর আগে তাকসিমের প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ ও অব্যাহত পুনর্নিয়োগ বিষয়ে ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নিরীক্ষার আহ্বান’ জানিয়েছে। যেহেতু সোনার পাথরবাটি হয় না। তাই এমনটাও হয়তো হবে না। এমন অসহায় পরিস্থিতিতে আমরা এখন তাকসিম খানের প্রতি অনুরোধ রাখতে পারি, আপনি ওয়াসাকে ক্ষমা করুন। সরে দাঁড়ান।