২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

তাইওয়ান ঘিরে ত্রিশঙ্কু সংকট

চলমান উত্তেজনা ঘিরে তাইওয়ান উপকূলে চীনের নৌমহড়া
ছবি : রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক দিয়ে আজকের যুগকে চিহ্নিত করা যায়। তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে বিশ্বের দুই বড় শক্তি সংঘাত কতটা এড়াতে পারছে, সেটার ওপরেই তাদের সম্পর্কের সমীকরণ নির্ধারণ হয়। কিন্তু এখন সংঘাত বাড়ার সমস্ত চিহ্নই দৃশ্যমান। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে একটা জরুরি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেটা হলো, নিজেদের প্রয়োজনীয় স্বার্থ বিসর্জন না দিয়ে এ থেকে তারা কীভাবে বের হয়ে আসতে পারবে।

বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে প্রথাগত ধারণা সব সময়ই পর্যালোচনার দাবি রাখে। তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। বিশ্বে সমস্যা আছে, পরিস্থিতিও আছে। সমস্যার সমাধান করতে হয় নীতির আলোকে। আবার পরিস্থিতিকে যতটা পারা যায় নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। তাইওয়ানের ঘটনাবলি একটি পরিস্থিতি। এটাকে সমাধানযোগ্য বিষয় হিসাবে দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়া চলবে না। সেখানকার পরিস্থিতি যদি কোনোভাবে সংঘাতের দিকে গড়ায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, চীন ও অন্যান্য আঞ্চলিক দেশ এবং বাকি বিশ্বের জন্য সেটা হবে ভয়াবহ। এর কারণ হচ্ছে, সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়, এমন কোনো সমাধান এই সংঘাত থেকে বের হয়ে আসবে না।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা ভালো সংবাদ হচ্ছে, চার দশক আগে তারা তাইওয়ান নিয়ে চুক্তি করতে পেরেছিল। ওই চুক্তিতে দুই পক্ষই বিরোধপূর্ণ বিষয়ে নাক না গলাতে সম্মত হয়েছিল। এটি দুই পক্ষকে সংঘাতে জড়াতে বিরত রেখেছিল। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটেছিল। এটি ‘ঠান্ডা লড়াই’ থেকে তাদেরকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। ফলশ্রুতিতে দেশ দুটি গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছিল। এর অংশ হিসাবে তাইওয়ানকে ‘এশিয়ার বাঘ’ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। একদলীয় শাসন থেকে বের করে সেখানে শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছে। কিন্তু সেটা তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে হয়নি। আমার মতে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামরিক শক্তি বাড়ানো, দেশটির অন্যায্য বাণিজ্য কৌশল এবং দেশের জনগণের ওপর দমনপীড়নের কারণে, সম্পর্কটা খারাপ হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছে। কিন্তু সেটা তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে হয়নি। আমার মতে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামরিক শক্তি বাড়ানো, দেশটির অন্যায্য বাণিজ্য কৌশল এবং দেশের জনগণের ওপর দমনপীড়নের কারণে, সম্পর্কটা খারাপ হয়েছে।

যা হোক আমার মনে হয়, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তাঁর ‘চীন পুনর্জীবন’-এর লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তাইওয়ানের ওপর বলপ্রয়োগের কথা চিন্তা করতে পারেন। তাইওয়ানের রাজনীতিকে তিনি নতুন করে সাজাতে এবং চীনের মূলভূমির প্রতি অনুগত নেতাদের শক্তি বাড়াতে চেষ্টা করতে পারেন। সি-এর মনে যায় থাকুক না কেন, তাইওয়ানের ওপর অর্থনৈতিক চাপ ও সাইবার হামলার ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেখানকার গণতন্ত্রে নাক গলানো হচ্ছে। দ্বীপটির উপকূলে সেনা সমাবেশ ও সামরিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি তাইওয়ানকে আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পরামর্শক তাইওয়ানকে চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে আত্মীকরণের পর-পরিণতি কী হয়-সেটা দেখতে চাইছেন। কিন্তু তাইওয়ানের ওপর চীনের এই জবরদখল যদি বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিমত্তা সম্পর্কে নিচু ধারণা তৈরি হবে। এখন এশিয়ায় সোভিয়েত আমলের আদলে আরেকটি ‘ফিনল্যান্ড’ বানানোর চীনের যে প্রচেষ্টা, সেটার কাছে যুক্তরাষ্ট্র নতি স্বীকার নাও করতে পারে। অথবা তাইওয়ানে স্বশাসন বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে পারে। দুটি ক্ষেত্রেই সামরিক, এমনকি পারমাণবিক সংঘাতের বিস্তার ঘটতে পারে। অন্যদিকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি, সমুদ্র পথের নিয়ন্ত্রণ এবং তাইওয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সেমি-কন্ডাক্টর শিল্পে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে চীন। তাইওয়ানের দুই কোটি ৪০ লাখ মানুষের গণতন্ত্রের স্বপ্ন সে ক্ষেত্রে নিভে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক নীতি হচ্ছে, তাইওয়ানে যদি কোনো অবস্থানগত পরিবর্তন ঘটে-সেটা হতে হবে সম্মতিপূর্বক। সে ক্ষেত্রে তাইওয়ানের জনগণের সমর্থন অবশ্যই থাকতে হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এটাও বারবার করে বলে আসছে, তারা তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন দেবে না। তাইওয়ানের ওপর চীনের হস্তক্ষেপের বিষয়টা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনকেও স্পষ্ট করতে হবে যে তারা ‘এক চীন’ নীতি থেকে সরে আসেনি।

চীনের নেতারা তাইওয়ানকে যত বেশি আত্মীকরণ করে নিতে চাইবেন, তারা নিজেদের ক্ষমতা এবং কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক ক্ষমতা তত বেশি একচ্ছত্র করতে চাইবেন। তবে যুদ্ধে তাইওয়ান জয় করতে গেলে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। আবার তাইওয়ান যদি নিজ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে অথবা যুক্তরাষ্ট্র যদি তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়, তবে চীনের অনেকে তাইওয়ানে যুদ্ধ শুরু করা অত্যাবশ্যক বলে মনে করবেন। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হওয়া উচিত আগের বিষয়টাকে স্তিমিত করে দেওয়া, পরেরটা এড়ানো।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
রিচার্ড এন হাস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট