একটা জাতিকে যদি জাগতে হয়, যদি আকাশ ছোঁয়ার বাসনায় হাতটা বাড়াতে হয়, তখন সবাইকে এই জাগরণে-উদ্যোগে শামিল হতে হয়। যদি একটি বা দুটি জনগোষ্ঠীও তাতে যোগ দিতে না পারে, যদি সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, আদিবাসী, শহুরে দরিদ্র অথবা খেতমজুরদের অংশগ্রহণ না থাকে, তাহলে জাগরণ থাকবে অসমাপ্ত, আকাশ ছোঁয়াটা থাকবে কল্পনার অঞ্চলে। অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নতি হচ্ছে, ৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে দেশটি, মাথাপিছু আয় বেড়ে সাড়ে তেরো শ ডলারে পৌঁছেছে। কিন্তু এই অর্জনের ফল কি সবাই সমানভাবে ভোগ করছে? একজন মানুষকে তখনই স্বাস্থ্যবান বলব আমরা, যখন সেই স্বাস্থ্যের চিহ্ন ধারণ করবে তার সব অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ। দুই বাহু বলশালী মানুষটার বুকের ছাতিও স্ফীত, শরীরটাও পেটানো, কিন্তু একটি পা অচল। তাহলে ওই একটি পা-ই তাকে পেছনে টেনে রাখবে।
আর যদি মানুষটার অস্বাস্থ্য থাকে শরীরের গভীরে-হৃদ্যন্ত্রে, ফুসফুসে, তাহলে তার ঠিকানা কাজের ভূগোলে নয়, ক্লিনিক-হাসপাতালের বিছানায়, বারান্দায়।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সমীহ জাগানো একটি নাম। অমর্ত্য সেন অনেক দিন থেকেই পৃথিবীকে জানাচ্ছেন এ দেশের অনন্য সব অর্জনের কথা। তাঁর বিস্ময় উৎপাদন করেছে সামাজিক ও মানব উন্নয়নের নানা সূচকে আমাদের অগ্রগতি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় মডেল; দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য হ্রাসে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে আমাদের সফলতা এবং বিশ্বমন্দার কালে আমাদের অর্থনীতির চাকা সবলে ঘোরার কারণে বিশ্ব এখন আমাদের প্রশংসা করে।
এত সব অর্জনের পেছনে আছে জাতি হিসেবে আমাদের প্রত্যয়: আমরাও পারি।
এর শেষতম উদাহরণ জুনের ২১ তারিখ রাতের মিরপুর। আমি বসে টিভিতে দেখছি ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় দাপট এবং ভাবছি, এটি কী করে সম্ভব? খেলা দেখছি, কিন্তু মোবাইল ফোনে কিছুক্ষণ পর পর যে মেসেজ আসছে, সেদিকেও চোখ রাখছি, দ্রুত উত্তরও দিচ্ছি এবং কোথায় যেন একটা সুর শুনছি আরও বড় জাগরণের। মেসেজ পাঠাচ্ছে আমার ছাত্রছাত্রীরা। মুস্তাফিজ একটা উইকেট নিল, একজন লিখে পাঠাল, ‘এনাদার ওয়ান বাইটস দ্য ডাস্ট’। তার আগে সৌম্য ছয় মারলে একজন লিখল, ‘বলটা সাতক্ষীরায় পাঠিয়ে দিল, স্যার।’ এই তরুণ ক্রিকেট দল ২১ তারিখে দেখাল, তারা শুধু জাগেনি, এখন আকাশটাও ছুঁতে জানে।
এই জাগরণটা যে শুধু আমরা দেখছি তা নয়, বিশ্বও দেখছে। নেটে কলকাতার কাগজগুলো পড়লাম। দেখলাম, উচ্ছ্বাস তাদেরও। ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ লিখেছে এক কাগজ; ‘সোনার বাংলার জয়গাথা’ লিখেছে আরেকটি। আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম, ‘এগারো বাঙালি হারাল ভারতকে’। ‘বাঙালি’ কথাটায় কোথায় জানি একটা তুষ্টির ছোঁয়া। আমার খুব ভালো লাগল, যখন কাঠমান্ডু থেকে এক বন্ধু ফোনে অভিনন্দন জানাল। বলল, নেপালের দর্শক বাংলাদেশের পক্ষে। আমি জানি কেন তারা ভারত ছেড়ে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছে, এখন বাংলাদেশ অর্জনের এক উদাহরণ তাদের সামনে। বাংলাদেশ পারলে নেপালও পারবে। শুধু ক্রিকেটে নয়, অর্থনীতি-সমাজ-শিক্ষা—সব ক্ষেত্রে।
আমি এই কথাটা জোরের সঙ্গে বলি: বাংলাদেশকে শুধু নিজের দিকে তাকালে চলবে না; এটি ভাবলে শেষ ভাবাটা হয়ে যাবে না যে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা অথবা পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ, যার উন্নতি হবে নিজের ভূগোলের ভেতরে। বাংলাদেশ একটি দেশ বটে, কিন্তু ভারতের মতোই এর বাইরেও কিছু। ভারত এখন এশিয়ার অর্থনীতির পরাশক্তি। বাংলাদেশকেও হতে হবে আঞ্চলিক একটি শক্তি, যার উন্নতি স্পর্শ করবে এবং যার দিকে পথ দেখানোর জন্য তাকিয়ে থাকবে নেপাল, ভুটানসহ ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলো। কিছুদিন আগে ত্রিপুরা ও মিজোরামের দুই সমাজকর্মীর সঙ্গে আমার দেখা দিল্লিতে। তাঁরা জানালেন, তাঁদের কাছে দিল্লি সত্যি সত্যি দূরের। বাংলাদেশের সঙ্গে বরং অর্থনৈতিক সম্পর্কটা হতে পারে অনেক কাছের। চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে ভাগ্য বদলাতে পারে উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যের। ত্রিপুরা তো তার উন্নয়নে আমাদের সহায়তা দাবিই করতে পারে—একাত্তরে ত্রিপুরা যেভাবে দাঁড়িয়েছিল আমাদের পাশে, তার কোনো তুলনা হয় না।
বাংলাদেশকে বিশ্ব সমীহ করছে। বাংলাদেশের গত নির্বাচন নিয়ে অখুশি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। কিন্তু কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র প্রশংসা করেছে উগ্রবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্যকে। নির্বাচন সর্বদলীয় না হওয়াটা আমাদের গণতন্ত্রের একটি ব্যর্থতা। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতাকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা এবং কাজ-অকাজ গণতন্ত্রের জন্য দুঃসংবাদ। একইভাবে স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক তোলা, স্বাধীনতার স্থপতিকে খাটো করে দেখা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগুলোকে অবজ্ঞা-অমান্য করা গণতন্ত্রের সুস্থতার লক্ষণ হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কেন্দ্রে ছিল মানুষ, সাম্য, মুক্তি এবং দেশের ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন—এই আদর্শ ধরে কেউ কি এগোচ্ছে?
তারপরও মানুষ হাল ছেড়ে দেয়নি, নিজেদের মতো কাজে নেমে পড়েছে। দরিদ্র পরিবারগুলো সামান্য উপার্জন করে সন্তানকে এবং কন্যাসন্তানকেও স্কুলে পাঠিয়েছে। তরুণেরা দেশে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিদেশে উপার্জনের একটা রাস্তা খুঁজে নিয়েছে। গ্রামের মেয়েটি শহরের মধ্য-উচ্চবিত্তের বাড়িতে গৃহস্থালির কাজ না নিয়ে পোশাক কারখানায় চাকরি খুঁজে নিয়েছে। কৃষক তাঁর পরিশ্রমে উদ্ভাবনী শক্তিতে নিরন্তর সোনা ফলিয়েছেন মাঠে, প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক স্বল্প বেতনে, পেটেভাতে মানুষ গড়ার সংগ্রামে নেমে পড়েছেন। তরুণ উদ্যোক্তা সামান্য পুঁজি সঞ্চয় করে ব্যবসা-বাণিজ্য-উৎপাদনে ব্রতী হয়েছেন। যোগাযোগপ্রযুক্তি যখন এল, মোবাইল ফোন কিছুটা সহজলভ্য হলো, তরুণেরা এর দেশীয় রূপান্তর ঘটালেন, বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করলেন। আমার এক অর্থনীতিবিদ বন্ধু বললেন, গ্রামের যে মধ্যস্বত্বভোগী—মাঝের মানুষ—দালাল ছিল, তাদের দাপট কমিয়ে দিল মোবাইল ফোন। না, আইন না, পুলিশ না; প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে অনেক তরুণ; উগ্রতা, আগ্রাসী অন্ধকার ছড়াচ্ছে, নানা অপকর্ম করছে। কিন্তু নতুন নতুন অসুখের ওষুধটাকেও হতে হয় নতুন। ওষুধ তৈরি হচ্ছে, তরুণেরাই করছে। ফলে প্রযুক্তি-রোগও একদিন নির্মূল হবে, সন্দেহ নেই।
অর্থনীতিবিদ-সমাজবিদেরা অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন। যা ঘটেছে, ঘটছে তা নিয়ে, যা ঘটতে পারে তা নিয়ে। এখন সময় দেশটা বদলাবার এবং এ জন্য কিছু মন্ত্রের জন্য আমাদের যেতে হবে দুই কবির কাছে। কবিরা ত্রিকালদর্শী হন, তাঁদের তৃতীয় একটা চোখ থাকে, যা দিয়ে তাঁরা অসম্ভবকে দেখেন। কাজী নজরুল দেখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জমিদার ছিলেন, ইউরো-শিক্ষিত পরিবারের সন্তান ছিলেন, কিন্তু তাঁর বিশ্বদর্শনের কেন্দ্রে ছিল গ্রাম। গ্রাম জাগলে দেশ জাগবে, তিনি বলতেন। আরও বলতেন আত্মশক্তির কথা। নজরুলের দর্শনের কেন্দ্রে ছিল মানুষ, তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল সাম্যের প্রতিষ্ঠা দেখা। তিনি মানুষের ইতিহাসের একটি সত্যকে তুলে ধরে বলেছিলেন। জগতের যা কিছু সুন্দর ও কল্যাণকর, তার অর্ধেক করেছে নারী। আমরা যদি এ দুই কবিকে মাথায় রাখি, তাহলে আত্মশক্তিতে আমরা জাগব; গ্রাম জাগবে, সাম্য প্রতিষ্ঠা পাবে; মানুষ থাকবে সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে; নারীদের কাজের আর অবদানের ক্ষেত্রটা হবে উন্মুক্ত, বাধাহীন; এবং তারুণ্যের ওপর থাকবে আমাদের ভরসা।
এই লক্ষ্যে যে আমরা যাচ্ছি না তা নয়, যাচ্ছি। কিন্তু যাত্রার গতি বাড়াতে হবে, সবাইকে শামিল করতে হবে সেই যাত্রায়। যদি সুবিধাবঞ্চিতরা সমান সুযোগ না পায়, যদি মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা না পায়, যদি প্রান্তিক অধিবাসী এবং অন্যান্য উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীর পায়ে শক্তি না জোগানো যায়, আমরা চলব খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
গ্রাম জাগছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট-ফুটবল দলের কথাই ধরি। ছেলেগুলোর অনেকে এসেছে গ্রাম থেকে, অথচ তাদের চোখে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। একটি মেয়ে, সাবিনা, মালদ্বীপে গিয়ে তাক লাগানো ফুটবল খেলল। শুনলাম, সে-ও সাতক্ষীরার। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী আসছে গ্রাম থেকে। এটি যুগ পরিবর্তনের লক্ষণ। এরা গ্রাম-শহরের ব্যবধান ঘোচাবে। দীর্ঘদিন গ্রাম অবহেলিত ছিল, এখন গ্রাম নিজে থেকেই সেই অবহেলার জবাব দিচ্ছে। কিন্তু প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন শিক্ষার—প্রকৃত, সাংস্কৃতিক, মননশীল, সৃজনশীল—শিক্ষার প্রসার। দারিদ্র্য নির্মূল করা। স্বাস্থ্য ও পুষ্টিচিত্রের উন্নতি। আরও অনেক কিছু। এর জন্য কাজে নামতে হবে তারুণ্যকে।
আমাদের দুই কবি বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের উন্নতিতে খুশি হতেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দুঃখ পেতেন আত্মশক্তি বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো আমাদের রাজনীতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দেখে। তিনি এক প্রবন্ধে লিখেছেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কর্জ করা শেখায়, উৎপাদন করা নয়। অবস্থাটা কি বদলেছে? নজরুল ব্যথিত হতেন তারুণ্যের অপচয় দেখে। তরুণদের জন্য কী উদাহরণ আমরা রাখছি? আমাদের রাজনীতি তাদের শেখাচ্ছে ক্ষমতার মারামারি, সহিংসতা, টেন্ডার-বাণিজ্যের মতো অসৎ উপায়। তাদের শেখাচ্ছে ঔদ্ধত্য, অসহিষ্ণুতা। তারুণ্যকে ধ্বংস করার জন্য চলছে মাদকের ব্যবসা। এই মাদকসম্রাটদের তো নামেই চেনে দেশের মানুষ, কিন্তু তাদের কেউ স্পর্শ করে না। কাগজে দেখলাম, ইয়াবা-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন পুলিশের কিছু কর্মকর্তাও! একদিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাফল্য উদ্যাপন করছি আমরা, অন্যদিকে মাদকের অবসাদে নিষ্প্রাণ পড়ে আছে তরুণদের এক বড় অংশ। এই বিপরীত চিত্র কি দেখেই যাব আমরা?
আবার ভরসা তরুণদের ওপর। মাঝে মাঝেই দেখি, প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি নিয়ে, নারীদের বিরুদ্ধে সহিংস যৌন অপরাধের প্রতিবাদে, বাজেটে শিক্ষার অবনমনের বিরুদ্ধে কিছু তরুণ রাজপথে মিছিল করে। এবং অবাক, পুলিশ তাদের দেখলেই পেটায়। আমার তো মনে হয়, পুলিশের কনস্টেবলদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে পথে নামলেও পুলিশ তাদের পেটাবে। এটা ক্ষমতার একটি অভ্যাস। তবে এ-ও বদলাবে, মিছিলে ছেলেগুলোকে দেখি আমাদের মুস্তাফিজের মতোই লিকলিকে। তাহলে ক্ষমতা কেন ভয় পাবে তাদের? কারণ তাদেরও আছে মুস্তাফিজের মতো কাটার। অফ, লেগ—সব ধরনের কাটার।
যত বেশি তরুণ এই কাটার নিয়ে বেরোবে রাস্তায়, মাঠে, গ্রামে, শহরে, দেশে, বিশ্বে; ততই জায়গা ছেড়ে দেওয়ার দৌড়টা শুরু হবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।