গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) তরুণদের নিয়ে এক জরিপ প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, ভালো জীবনযাপন ও পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮২ শতাংশ তরুণ নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। আর এ ক্ষেত্রে তাঁদের পছন্দের দেশগুলো যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া। এসব তরুণ মনে করেন না যে নিজের দেশে তাঁদের ভবিষ্যৎ আছে। জরিপের ফলাফলটি প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট গত মার্চ মাসে সারা বাংলাদেশে তরুণদের ওপর যে জরিপ পরিচালনা করেছে, তার সঙ্গে যথেষ্টই সংগতিপূর্ণ।
প্রথম আলোর এই জরিপেও দেখা গেছে যে বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ তরুণই উদ্বিগ্ন তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে তাঁরা নানা ধরনের অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। দুটি জরিপ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল পরিষ্কারভাবেই জানান দেয় যে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম তেমন একটা ভালো নেই এ দেশে। তরুণেরাই যখন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত, তখন তা আমাদের একটি বার্তা দেয়; আর তা হলো দেশের জন্য অপেক্ষা করছে হতাশাজনক একটি সময়।
আগে স্কুলপড়ুয়া শিশুদের যখন প্রশ্ন করা হতো, তারা ভবিষ্যতে কী হতে চায়, তারা নির্দ্বিধায় উত্তর দিত, ‘ডাক্তার হব, ইঞ্জিনিয়ার হব, শিক্ষক কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট হব।’ কেউ কেউ সাহস করে বলে বসত, ‘পাইলট হব, প্লেন চালাব।’ কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েদের প্রশ্ন করলে তাদের অর্ধেকের বেশি যে উত্তর দেয় তা তাদের দেশের বাইরে ভবিষ্যৎ গড়ারই ইঙ্গিত দেয়। ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পড়ুয়া প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থীই উত্তর দেয়, ‘এ’ লেভেল শেষ করে দেশের বাইরে যাবে। আর বাংলামাধ্যমে পড়ুয়ারা প্রায়ই বলে, ‘অনার্স শেষ করে দেশের বাইরে গিয়ে মাস্টার্স করব। তারপর ওই দেশে সুবিধা করতে পারলে দেশে আর ফিরব না।’ কী ভয়াবহ এক অবস্থা!
আগে চাকরির ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীদের প্রথম পছন্দ ছিল বিসিএস। প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার জন্য একবুক স্বপ্ন নিয়ে প্রচুর ছেলেমেয়ে অবতীর্ণ হতেন বিসিএস পরীক্ষায়। কিন্তু এখন অনেক ছেলেমেয়ে ক্যারিয়ার গড়তে বিসিএসের কথা ভাবেনও না। আবার যাঁরা বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছেন তাঁদেরও মেলাতে হচ্ছে কোটার জটিল সমীকরণ। যে দেশের সর্ববৃহৎ চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কোটার ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, সেখানে ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ না হয়ে উপায় কী মেধাবী তরুণদের!
তরুণ প্রজন্মের জন্য আরেকটি প্রকট হয়ে ওঠা সমস্যার নাম বাল্যবিবাহ। বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীই নারী এবং তাদের অর্ধেকই বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অনেক বড় প্রতিবন্ধকতার নাম বাল্যবিবাহ। কিশোরী থেকে তরুণী হয়ে ওঠার আগেই ঝরে পড়া এই সম্ভাবনাগুলোর হতাশা এই জরিপে কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে জানা নেই।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের জরিপে ৪৭ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুযোগের অসমতা তাঁদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্রথম আলোর জরিপে বেরিয়ে এসেছিল, ৫৬ শতাংশ তরুণ উদ্বিগ্ন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে। দেশের রাজনীতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে নেই তেমন কোনো আগ্রহ, সামনে নেই কোনো রোল মডেল। তরুণদের অর্ধেকের বেশি মনে করেন, তাঁদের স্বপ্ন আর প্রত্যাশা নিয়ে ভাবেন না দেশের নীতিনির্ধারকেরা। তাঁরা উৎকণ্ঠিত নীতিনির্ধারকদের বৈষম্যমূলক নীতিনির্ধারণ নিয়ে।
সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ (সিডার) ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শিরোনামে যে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে বেরিয়ে আসে, যার শিক্ষাগত যোগ্যতা যত বেশি, তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তত কম। প্রতিবেদনটি যে সমস্ত তরুণ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে চান, তাঁদের জন্য এক হতাশাজনক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। এ ধরনের নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত তরুণ প্রজন্ম হতাশা থেকে বাঁচতে নিচ্ছেন দেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত। বৈধ বা অবৈধ যেকোনো প্রকারে হোক তারা পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে।
তরুণসমাজকে বিদেশমুখী হওয়া থেকে বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ। ইদানীং অনেক তরুণই চাকরি করার পরিবর্তে ভাবছেন নিজ উদ্যোগে কিছু করার কথা। তাই তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহের বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচকভাবে ভেবে দেখতে হবে। তরুণেরা চান উদ্যোক্তা-সহায়ক একটি পরিবেশ। উদ্যোক্তা-সহায়ক পরিবেশের অভাবে তাঁরা অনেকেই এই পথে বেশি দূর হাঁটতে পারছেন না।
আজ নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের তরুণদের নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তরুণসমাজ ও তাদের চাহিদা মাথায় রেখে একদিকে যেমন নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে, অন্যদিকে তাদের দেশে ধরে রাখার জন্যও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুবা এক হতাশাজনক সময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]