দেশের এক-তৃতীয়াংশ যখন বন্যায় আক্রান্ত, উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় বিধ্বস্ত, ঘরবাড়ি ও খেতের ফসল হারিয়ে লাখ লাখ মানুষ নিঃস্ব ও রিক্ত; তখন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান কর্তব্য ছিল সেই দুর্গত ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সাধ্যমতো তাদের সহায়তা দেওয়া। এখানে সরকার বা প্রশাসনকে টানছি না, তারা তো তাদের কাজ করবেই। কিন্তু জনগণের জন্য ‘জীবন উৎসর্গকারী’ রাজনৈতিক দলগুলো কী করছে? সরকারি দল ও বিরোধী দল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে এতটাই দিওয়ানা যে বন্যাদুর্গত মানুষের কথা ভাবার ফুরসত পাচ্ছে না, পেলেও ফটোসেশন করে ঢাকায় ফিরে এসে রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে বুলন্দ আওয়াজ তুলছে। বিপন্ন ও দুর্গত মানুষের প্রতি রাজনীতি যে এতটা অসংবেদনশীল হতে পারে, কখনো ভাবিনি।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন রীতিমতো ঝড় বইছে, তখন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের কেউ কেউ এর মধ্যে এক এগারোর কষ্টকল্পিত আলামত খুঁজছেন। কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নয়, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেও অনেক সময় ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব হাজির করা হয়। কিন্তু সত্যি সত্যি ষড়যন্ত্র যখন আসে, তখন ক্ষমতাসীনেরা মালুম করতে পারেন না। এটি যেমন আমরা পঁচাত্তরে দেখেছি, তেমনি প্রত্যক্ষ করেছি ১৯৮১ ও ২০০৭ সালেও। ষড়যন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে বিএনপি থেকেও। তাদের অভিযোগ, সরকার বিএনপিকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার জন্যই ক্ষমতাসীনেরা নানা বাহানা করছে।
কয়েক মাস আগেও বিএনপির নেতাদের যতটা ম্রিয়মাণ দেখা গেছে, এখন সেটি মনে হচ্ছে না। পোশাকের পাশাপাশি তাঁদের চোখে-মুখেও একধরনের ঔজ্জ্বল্য ফিরে এসেছে। বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ ইশারা-ইঙ্গিতে এমন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে তাঁরা ক্ষমতার কাছাকাছি চলে এসেছেন। এ রকম চিন্তা তাঁরা করতেই পারেন। যে রাজনৈতিক দল জনগণের রায় নিয়ে একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল, তারা ফের ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষমতায় কীভাবে যাবে? সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনই হলো ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা থাকার একমাত্র সংবিধানস্বীকৃত পথ। আমাদের নেতা-নেত্রীরা সুবিধামতো প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ বলে বেশ আহ্লাদ বোধ করলেও তাঁদের হাতে ক্ষমতা দূরে থাক, ভোটের অধিকারটিও ফিরিয়ে দিতে চান না।
সংবিধানে যে নির্বাচনের কথা আছে, সেটি নিশ্চয়ই সামরিক শাসক উদ্ভাবিত ‘গণভোট’ কিংবা গণতান্ত্রিক শাসক-প্রবর্তিত ‘নিয়মরক্ষার’ নির্বাচন নয়। জনগণ যে নির্বাচনে নির্বিঘ্নে ও নির্দ্বিধায় পছন্দসই প্রতিনিধি বাছাই করতে পারবে, সেই নির্বাচনের কথাই সংবিধানে বলা হয়েছে। একসময় নির্বাচনে কালোটাকা ও পেশিশক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার ছিলেন। এখন ভোট দিতে পারা না-পারাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৪৬ বছরে আমরা গণতন্ত্রকে এই পর্যায়ে নামিয়ে এনেছি। ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশনকে বাড়িয়ে পাঁচ সদস্যের করেছি। নানা আইন ও বিধি সংস্কার করেছি। কিন্তু শিশু গণতন্ত্র আর পূর্ণবয়স্ক হলো না। দেশে শান্তিপূর্ণ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের চেয়ে সংঘাতের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের নজিরই বেশি।
আগামী নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন মহলে যেমন অস্থিরতা লক্ষ করা গেছে, তেমনি জনগণের মধ্যেও শঙ্কা-উদ্বেগ আছে। ক্ষমতা বদলের জন্য নির্বাচন অপরিহার্য। কিন্তু সেই নির্বাচন কীভাবে হবে? কারা করবে? বিএনপি কি নির্বাচনে আসবে? এলে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হবে। কিন্তু সুষ্ঠু হওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে কি না? আর না এলে কি আগামী নির্বাচনও ২০১৪ সালের মতো একতরফা হবে?
এসব প্রশ্নের হ্যাঁ-না উত্তর দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে বিএনপির মধ্যেও মতভেদ রয়েছে। দলের একাংশ মনে করে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না। কেননা সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। তাদের মতে, রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে নির্বাচন করতে হবে (যেমনটি আওয়ামী লীগ করেছে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন)। বর্তমানে দেশে যে পরিবেশ-পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা অনেকটা বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে বলা মানে হাত-পা বেঁধে কাউকে সাঁতার কাটতে বলার শামিল। সাঁতারের প্রতিযোগিতায় নামাতে হলে প্রথমেই বিএনপির হাত-পা খুলে দিতে হবে।
অপরাংশ মনে করে, তত্ত্বাবধায়কের দাবি আদায় করে নির্বাচন করার পরিবেশ-পরিস্থিতি এখন নেই। বরং নির্বাচনের ন্যূনতম পরিবেশ নিশ্চিত হলে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাওয়া উচিত। কেননা জনগণ বিএনপির পক্ষে আছে। এ ক্ষেত্রে তারা ১৯৭০ সালে এলএফওর (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক) অধীনে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনে যাওয়ার যুক্তি তুলে ধরেন। তারা এও মনে করে যে নির্বাচনে বড় ধরনের কারচুপি হলে তার বিরুদ্ধে মানুষই রাজপথে নেমে আসবে। আর নির্বাচনে না গেলে আওয়ামী লীগ এবারও ফাঁকা মাঠে গোল দেবে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন ও ঠেকানোর চেষ্টা করে বিএনপি লাভবান হয়নি।
তবে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার পেছনে আরও অনেক হিসাব–নিকাশ আছে। বিএনপির নেতাদের ভয়, নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় হতে পারে এবং তাঁর শাস্তি হতে পারে। অনেকের মতে, সেটিও নির্বাচনে না যাওয়া বা বর্জনের অজুহাত হতে পারে না। দুর্নীতির মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ই চূড়ান্ত নয়। বর্তমান মন্ত্রিসভার কোনো কোনো সদস্য যদি দুর্নীতির মামলার রায় মাথায় নিয়ে মন্ত্রিত্ব করতে পারেন, খালেদা জিয়া কেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না? যদিও বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিষয়টি ভিন্ন। তিনি পলাতক আসামি হিসেবে শাস্তিপ্রাপ্ত বলে দেশে এসে তাঁকে আদালতে হাজির হয়েই জামিন চাইতে হবে।
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী কী করবে, সেই পরিকল্পনা জনগণকে কয়েক মাস আগেই জানিয়ে দিয়েছে। ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছে। বিএনপির নেতারা নিশ্চয়ই মনে করেন, তাঁদের ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়ন করতে হলে ক্ষমতায় যেতে হবে। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র পথ হলো নির্বাচন। প্রশ্ন হলো, সেই নির্বাচনের বিষয়ে মনে হচ্ছে বিএনপির মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। তারা একবার বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে, আরেকবার বলে সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। দলটি ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করলেও সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেয়নি। সেই সহায়ক সরকার কি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেখে হবে, নাকি তাঁকে বাদ দিয়ে? আওয়ামী লীগ সাফ বলে দিয়েছে, সংবিধানের বাইরে তারা এক পা-ও যাবে না।
এ অবস্থায় নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিএনপি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ দিতে বিএনপি কতটা প্রস্তুত? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলই ছায়া সরকার হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বর্তমান সংসদে যে দলটি বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে, সেটি দোআঁশলা বলেও চালানো যায়। সরকার যে কাজই করুক না কেন, তাতে হ্যাঁ বলা ছাড়া উপায় নেই। এরশাদের মাথার ওপর জেনারেল মঞ্জুর হত্যাসহ বেশ কিছু মামলা খড়্গ হিসেবে ঝুলছে। এ অবস্থায় সরকারের ভুলত্রুটি, দুর্বলতা, ব্যর্থতা চিহ্নিত করে জনগণের কাছে যেতে পারত যে দলটি, সেটি হলো বিএনপি। কিন্তু তারা সরকার সভা-সমাবেশ করতে দেয় না, এই অজুহাতে জনগণের স্বার্থরক্ষার আন্দোলন-সংগ্রাম থেকেও বিরত রয়েছে।
দেশে এত সব ঘটনা ঘটছে, আর বিএনপির নেত্রী লন্ডনে বসে আছেন। তিনি চিকিৎসার জন্য সেখানে গেলেও তাঁর পুত্র ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করবেন। কিন্তু একটি দলের শীর্ষ নেত্রী কীভাবে এত দিন কর্মীদের থেকে, জনগণ থেকে দূরে থাকেন। এমনকি তিনি কাউকে দায়িত্বও দিয়ে যাননি।
কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে, যাতে অংশীজন তথা রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছেও। কিন্তু এ পর্যন্ত যে আলোচনা হয়েছে, তাতে আশাবাদী হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। কমিশনের কর্মপরিকল্পনায় আছে, জাতীয় পর্যায়ের এ নির্বাচন নিয়ে জনমানুষের প্রত্যাশা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা। এর মধ্যে নির্বাচনী মাঠে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণ, সর্বোপরি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান, আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন, অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার দমন ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে।
বাস্তবে সেটি সিকি ভাগ প্রয়োগ করলেও নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে। সেই অনুকূল পরিবেশটি তারা কখন তৈরি করবেন? তফসিল ঘোষণার পর। তাহলে নির্বাচন কমিশনকে আইন করে বলে দিতে হবে, তফসিলের আগে কোনো দলের পক্ষে কেউ ভোট চাইতে পারবে না। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বা অন্যান্য দল সভা-সমাবেশ করতে পারলে বিএনপি কেন পারবে না? একই সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলোও প্রত্যাহার করতে হবে।
একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সুস্থ ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। নির্বাচনের জন্য আবশ্যিক শর্ত, সবার জন্য মাঠ সমতল করা। এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু মতবিনিময় সভায় পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। নির্বাচন কমিশন যদি দেড় বছর আগে কর্মপরিকল্পনা করে থাকেন, তাতে সুষ্ঠু ও সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের বিষয়টি কেন গুরুত্ব পাবে না?
বাতাসে নানা গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছে। দেশের মানুষ সেসব গুঞ্জনে কান দিতে চায় না। তারা পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিতে চায়। সেই ক্ষেত্রটি তৈরি করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আর প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। বিএনপি নেত্রী নিশ্চয়ই সেটি মনে রাখবেন।
আওয়ামী লীগ যদি চায় বিএনপি নির্বাচনে না আসুক, তাহলে বিএনপির উচিত হবে ‘জোর’ করেই নির্বাচনে অংশ নেওয়া।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।