গত ২৮ সেপ্টেম্বর ছিল ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর ইউনিভার্সাল অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন; সব মানুষের তথ্য পাওয়ার অধিকারবিয়ষক আন্তর্জাতিক দিবস। আগে দিনটি রাইট টু ইনফরেমশন ডে বা ‘তথ্য অধিকার দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হতো। জনসাধারণের জানার অধিকার, প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকার—এই ধারণাগুলো বাংলাদেশে খুব পুরোনো নয়। শুধু বাংলাদেশে কেন, পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই এসব ধারণা বেশ নতুন। ঔপনিবেশিক শাসন আর সামন্তবাদী সমাজের সাংস্কৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক ঐতিহ্যের রেশ ধরে উনিশ-বিশ শতকে এসেও আমাদের এই উপমহাদেশে সাধারণভাবে মনে করা হতো জ্ঞান ও তথ্য হলো রাষ্ট্র, সরকার ও ক্ষমতাধর মানুষদের অধিকারে ও নিয়ন্ত্রণে থাকার বিষয়; এগুলো সর্বসাধারণের অধিগম্য নয়। তথ্য থাকবে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে, সাধারণ নাগরিকদের নাগালের বাইরে। নাগরিকেরা কেবল তখনই সেইটুকু তথ্য জানতে পারবে, যখন রাষ্ট্র তাদের যেটুকু তথ্য জানানোর সিদ্ধান্ত নেবে।
একুশ শতকে এসেও যে এ মানসিকতার খুব বড় পরিবর্তন ঘটেছে এমন নয়। এখনো গোপনীয়তার সংস্কৃতি থেকে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ মুক্তি ঘটেনি। সাধারণ মানুষের মনেও এমন বোধ দৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠেনি যে জনসাধারণের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত সব ধরনের তথ্য জানার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে তথ্য গোপন রাখার প্রবণতা এখনো প্রবল।
২৮ সেপ্টেম্বর ইউনিভার্সাল অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন দিবসে এক ভার্চ্যুয়াল সভায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের জন্য বর্তমান সরকারকে ‘সাধুবাদ’ জানিয়ে মন্তব্য করেন, এই আইনের বাস্তবায়নে সরকারের একাংশের মানসিকতা হলো, ‘তথ্য হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি’। এর নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতেই থাকবে এবং যেভাবে যতটুকু তথ্য প্রকাশ করতে চাইবে, ততটুকুই প্রকাশিত হবে।
সাধারণ মানুষের মনেও এমন বোধ দৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠেনি যে জনসাধারণের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত সব ধরনের তথ্য জানার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে তথ্য গোপন রাখার প্রবণতা এখনো প্রবল।
ইফতেখারুজ্জামান স্মরণ করিয়ে না দিলে সম্ভবত আমাদের স্মরণে আসত না যে এই দেশে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি আইন বলবৎ আছে; তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ নামের আইনটি প্রণীত ও গৃহীত হয়েছিল বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের উদ্যোগেই। তখন এই দেশে ‘তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন’, তার ৫৭ ধারা কিংবা ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নামের কালাকানুনের কথা আমাদের কল্পনায়ও ছিল না।
আমাদের মনে আছে, ২০০২ সালে ভারতে ‘ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্ট’ নামের একটি আইন পাস হওয়ার পর থেকে আমরা বাংলাদেশেও সে রকম একটি আইনের দাবিতে লেখালেখি, সভা-সেমিনারে আলোচনা শুরু করি। সে সময় পৃথিবীর অনেক দেশে নাগরিকদের তথ্য পাওয়ার অধিকার আইনগতভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছিল, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে বিষয়টির পক্ষে মতামত গঠনের চেষ্টা চলছিল। তা ছাড়া গণতান্ত্রিক অধিকারবিষয়ক নানা সূচকে দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসও লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। এমনকি পাকিস্তানে পারভেজ মোশাররফের সামরিক সরকারও ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অর্ডিন্যান্স নামের একটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল।
আমাদের লেখালেখি, আলোচনা এবং নাগরিক সমাজ ও এনজিও মহলের ধারাবাহিক আন্দোলনের একপর্যায়ে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশেও তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি আইনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ২০০৭-২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি আইনের খসড়া তৈরি করা হয় এবং সেটি জনসমক্ষে প্রকাশ করে সে বিষয়ে নাগরিকদের মতামত আহ্বান করা হয়; আইনের খসড়া তৈরির কাজে এনজিওগুলোর পক্ষ থেকেও সহযোগিতা করা হয়। বিপুলসংখ্যক নাগরিক আইনের খসড়াটি সম্পর্কে মতামত দেয় এবং সেগুলো পর্যালোচনা করা খসড়াটি আরও পরিমার্জন করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার দু-তিন মাসের মধ্যেই ‘তথ্য অধিকার আইন ২০০৯’ সংসদে পাস হয়; একটি তথ্য কমিশন গঠিত হয় এবং একজন প্রধান তথ্য কমিশনারের নেতৃত্বে সেটি কাজ শুরু করে।
তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের অংশগ্রহণের যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছিল, এই বাংলাদেশে তা একটি বিরল ব্যাপার। সে জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান সঠিক কাজই করেছেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের পরবর্তী অংশটিই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং সে কারণে সেটাই সংবাদ শিরোনামে স্থান পেয়েছে: তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের একাংশের মানসিকতা হলো এমন যে তথ্য হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি।
এর অর্থ হলো, তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে নাগরিকদের তথ্য পাওয়ার অধিকারের তাত্ত্বিক স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছে, কিন্তু আইনটির স্পিরিট বা মূল চেতনা আন্তরিক উপলব্ধিতে আসেনি। সে কারণেই তথ্য অধিকার আইন বাস্তব ক্ষেত্রে সব নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না। তথ্য কমিশনও এই ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না বা করতে সক্ষম হচ্ছে না। দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা চলমান কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য প্রদানের ব্যবস্থার কথাটি বলতে পারি। মহামারির শুরু থেকেই এ বিষয়ে সঠিক ও পর্যাপ্ত তথ্য যথাসময়ে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়ার বিষয়ে অনীহা লক্ষ করা গেছে।
প্রথম দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকেরা নানা রকমের প্রশ্ন করে অনেক তথ্য বের করে আনতেন; কিন্তু একপর্যায়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তারপর থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিজের মর্জিমাফিক যেটুকু তথ্য সংবাদমাধ্যমকে দিত, সংবাদমাধ্যম সেটুকুই জনসাধারণের সামনে উপস্থাপন করতে পারত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ আচরণে তথ্য অধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটেছে।
তথ্য অধিকার আইনের একটি শক্তিশালী বিধান হলো, সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো সর্বোচ্চ পরিমাণ তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করবে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে (ভলান্টারি ডিসক্লোজার); অর্থাৎ নাগরিক বা সাংবাদিকদের চাওয়ার অপেক্ষায় না থেকে সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো নিজ নিজ দপ্তরের কাজকর্ম–সম্পর্কিত অধিকাংশ তথ্য নিজ নিজ ওয়েবসাইটে এবং অন্যান্য মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রকাশ করবে এবং নাগরিকদের তরফ থেকে যেকোনো তথ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য আন্তরিকভাবে প্রস্তুত থাকবে; সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানাবে না; বরং প্রশ্নের উত্তরের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক আরও তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করবে। সরকারের নীতিনির্ধারক ও জনপ্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে তথ্য অধিকার আইনের মর্মকথা সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি জাগলে তাঁরা কখনোই তথ্যকে সরকারি সম্পত্তি মনে করতে পারতেন না, বরং স্বাকীর করতেন যে তথ্যের মালিক জনগণ; তা গোপন রাখার অধিকার সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষের নেই।
তথ্য অধিকার আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের ক্ষমতায়ন ঘটানো, সরকারের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, দুর্নীতি প্রতিহত করা; সর্বোপরি রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি যাতে জনগণের স্বার্থে কাজ করে, তা নিশ্চিত করা। এই সবকিছুর জন্য প্রয়োজন সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুকূল মানসিকতা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশে সেটাই অনুপস্থিত। সে কারণেই তথ্য অধিকার আইনের মতো জনমুখী আইনকে অর্থহীন করে দিতে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালাকানুনগুলো জারি করা হয়।
মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক