ঢাকার দুঃখ যানজট
বিশ্বের উন্নত-অনুন্নতনির্বিশেষে বহু দেশে যানজট একটি বহুল আলোচিত সমস্যা। যানজট আরও দু-দশটি, এমনকি এক শটি সমস্যার জন্ম দেয়। উন্নয়নশীল দেশের নগরসমূহে এ সমস্যা তীব্র, বিশেষ করে অর্থনীতিতে এর প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। ইউরোপে বছরে ২০০ বিলিয়ন ইউরো, যুক্তরাষ্ট্রে ১০০ বিলিয়ন ডলার নষ্ট হচ্ছে যানজটের ফলে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ১১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির ৭ শতাংশের সমান। বলার অপেক্ষা রাখে না, আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সমাজ ও পরিবেশের ওপরও যানজট বিরূপ প্রভাব ফেলে।
ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধমান একটি নগর, যেখানে বিবিধ উন্নয়ন ও পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। রাজধানীর পাশাপাশি ঢাকা দেশের প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। দেশের সব প্রান্ত থেকে মানুষ তার বিবিধ প্রয়োজনে ছুটছে ঢাকা অভিমুখে, বাড়িয়ে তুলছে নগরীর জনসংখ্যাকে। এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা নগরীতে নানা কৃত্রিম সমস্যার সৃষ্টি করছে, যার মধ্যে অন্যতম যানজট।
সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), নগর পরিস্থিতিসংক্রান্ত বার্ষিক গবেষণা প্রতিবেদন ২০১৬: ‘ট্রাফিক কনজেশসন ইন ঢাকা সিটি গভর্ন্যান্স পার্সপেক্টিভ’ প্রকাশ করে। এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল যানজট-সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত শাসনব্যবস্থা পর্যালোচনা করা এবং যানজটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়সমূহ খতিয়ে দেখা, সমস্যার উত্তরণ ও ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ শক্তিশালীকরণে সুপারিশ তুলে ধরা।
গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা বিগত ৩৫ বছরে ৫ গুণ বেড়েছে। সারা দেশে শহরে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ মানুষ এই নগরে বাস করছে। প্রতিদিন নতুন করে গড়ে ১ হাজার ৭০০ মানুষ ভাগ্যান্বেষণে ঢাকায় আসছে, বছর শেষে যার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখ ২০ হাজার। নগরীতে যানবাহনের চাহিদার তুলনায় জোগান অত্যন্ত সীমিত। একটি শহরে সুষ্ঠুভাবে জনগণের চলাচলের জন্য নগরীর আয়তনের ২৫ শতাংশ রাস্তাঘাট থাকা আবশ্যক, কিন্তু এই নগরীতে আছে মাত্র ৮ শতাংশ। অন্যদিকে, প্রধান সড়কের তুলনায় সরু রাস্তার দৈর্ঘ্যই বেশি, যা যানজটকে আরও তীব্রতর করে তুলেছে। রাষ্ট্রীয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, নগরীর রাস্তায় প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৪০০ নতুন গাড়ি নামছে। গত দুই দশকে এর মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লাখ, যার অধিকাংশই ব্যক্তিগত গাড়ি। গণপরিবহনের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত সীমিত। অর্থাৎ ব্যস্ত সময়ে গণপরিবহনের স্বল্পতা যাত্রীদের ভোগান্তির অন্যতম প্রধান কারণ। বর্তমানে নগরীর ১৬৮টি রুটে ১৫৭টি কোম্পানির ৫ হাজার ৪০৭টি বাস এবং মিনিবাসের চলাচলের অনুমতি রয়েছে, যার মধ্যে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার বাস ১৫ লাখ মানুষ পরিবহন করে। এই সংখ্যা চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত কম। যানবাহনের চাহিদা পূরণের জন্য যাত্রীরা বাসের পাশাপাশি লেগুনা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, সাইকেলরিকশা ইত্যাদি ব্যবহার করে। বর্তমানে ঢাকা শহরে ৮ থেকে ১০ লাখ রিকশা আছে এবং রিকশা চালনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১৬ থেকে ২০ লাখ মানুষ জড়িত। কিন্তু সিটি করপোরেশন-অনুমোদিত রিকশার সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। নগরীর প্রধান সড়কে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি।
(লেখকেরা ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকদের নিজস্ব, প্রতিষ্ঠানের নয়)