কথায় আছে পৌষের শীতে বাঘও পালায় কিন্তু কয়েক দিন ধরে রাজধানী ঢাকার যে খবর গণমাধ্যমে আসছে, তাতে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। জানা যায়, এই শীতে বাঘের পালানোর পরিবর্তে রাজধানীবাসীরই পালানোর দশা। ভরা শীতে যেখানে চাকরিজীবীরা এবং অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ স্যুট-টাই আর গরম কাপড় পরে অফিস ও সভা করবেন—রাজপথে দেখা যাবে হরেক রকমের ফ্যাশন, তার পরিবর্তে নগরবাসী এই শীতে একপ্রকার নাকাল। দেশের উত্তরাঞ্চলের তুলনায় রাজধানীতে চলছে বসন্তের আমেজ, এতে দৈনন্দিন জীবনে যেমন চলছে অস্বস্তিকর অবস্থা তেমনি ভরা শীতে মানুষ ঢাকায় পাচ্ছে গরমের অনুভূতি। শীতকালেও সচল রাখতে হচ্ছে বাড়িঘরের বৈদ্যুতিক পাখা বা অফিসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রক।
শহর ও নগরীয় জীবনযাপন আমাদের অনেক কিছুই দিয়েছে, কিন্তু পরিবর্তে মানুষ দিয়েছে বিস্তর অভিঘাত। আদিকাল থেকে মানুষ একবার নগরের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে গ্রামে ফিরে যেতে চায় না, গেলেও সেটা কর্মজীবনের শেষে। আর তাই বিশ্বব্যাপী পরিবেশ অবক্ষয়ের নতুন একটি উপাদান হচ্ছে নগরীয় আকার ও জনসংখ্যার দ্রুততর বৃদ্ধি। ২০১৯ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, নগরীয় জনসংখ্যার তুলনায় শহরের অনুভূমিক বৃদ্ধির হার বিশ্বব্যাপী বার্ষিক ১ দশমিক ৬৪ গুণ অর্থাৎ দ্রুতলয়ে বাড়ছে নগরের সীমা ও সংখ্যা, তবে সর্বাধিক বৃদ্ধির হার এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে। পৃথিবীতে মানুষই সম্ভবত একমাত্র জীব, যে তাঁর নিজের কল্যাণের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশের যেকোনো উপাদানকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন এমনকি নিঃশেষ করে দিতে একটুও পিছপা হয় না। বিশ্বব্যাপী দ্রুত নগরায়ণকে এমন একটা উদাহরণ বললে ভুল হবে না। যদিও নগরায়ণকে অনেকেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন বলে থাকে কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাবও কম নয়। যেমন কৃষিজমির হ্রাস, জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় দ্রুত নগরায়ণের ফসল।
জলবায়ু পরিবর্তন ও অস্বাভাবিক নগরায়ণ বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করছে কিন্তু বিশ্বে নগরায়ণের প্রথম দিকে নগর জলবায়ুর অভিঘাতের বিষয়টি ছিল চরম উপেক্ষিত। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লুক হাওয়ার্ড ১৮২০ সালে লন্ডন শহরে নগর জলবায়ুর পরিবর্তনের বিষয়টি প্রথম তুলে ধরলেও প্রায় শতাধিক বছর পরে অর্থাৎ ১৯৩৫ সালের দিকে নগর জলবায়ুবিষয়ক গবেষণা নতুন মাত্রা পায়। এক সময় নগরীয় উষ্ণতা মধ্য অক্ষাংশের সমস্যা হলেও বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৫ হাজারটি বড় ও মাঝারি শহরে এই সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে, যা দ্রুত নগরায়ণ ও ক্রমবর্ধমান মনুষ্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। স্থানীয় ও আঞ্চলিক জলবায়ুর ওপর এই অভিঘাতের প্রভাব এখন সুস্পষ্ট। ফলে যেমন বাড়ছে জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা তেমনি বাড়ছে এনার্জির বা শক্তিসম্পদের ওপর চাপ। নগর জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন সামনের দিনগুলোতে সামাজিক সংঘাতসহ আরও বহুবিধ সমস্যার উদ্রেক ঘটাবে বলে আশঙ্কা।
বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও নগর জনসংখ্যার তুলনায় শহরের সংখ্যা ও প্রাকৃতিক প্রসারণের হার অত্যধিক, তবে বড় শহর যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম বা খুলনার বার্ষিক বৃদ্ধির হার গড়ে ২০০ শতাংশের বেশি বলে গবেষণায় জানা যায়। কিন্তু দেশের শহরগুলোর বিশেষ করে ঢাকায় নগর জলবায়ুর অভিঘাতের মাত্রা ও তীব্রতা কেমন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই, ফলে নগর উষ্ণতা থেকে বাঁচার উপায় কী হবে, সে সম্পর্কে কোনো বেসলাইন তথ্য নেই।
ঢাকার বিল্ডিংগুলো জলবায়ু সংবেদনশীল নয়, এগুলো দিনেরবেলা সূর্য থেকে প্রাপ্ত আলো ট্রাপ করে ফলে রাতে যে হারে ঠান্ডা হওয়ার কথা, তা না হয়ে উল্টোটা হয় অর্থাৎ বিল্ডিংগুলো তাপ ধরে রাখে। আর এই উদ্বৃত্ত তাপ আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে স্থানীয় জলবায়ুকে করছে উত্তপ্ত।
বলা বাহুল্য, নগরের উষ্ণতা দুই প্রকার: এক. বাতাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, যা সরাসরি মানুষের আরাম বা স্বস্তির সঙ্গে জড়িত; দুই. ভূপৃষ্টের/নগরের ত্বকের উষ্ণতা, যা কোনো অঞ্চলের শক্তি বা এনার্জির স্থিতাবস্থার নিয়ন্ত্রক। দুটোরই বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’। যেহেতু উত্তপ্ততা নগরের বিভিন্ন অংশে বিক্ষিপ্তভাবে দেখা যায়, তাই এমন নামকরণ। দুই প্রকারের উষ্ণতার একটি বা দুটোর সম্মিলিত প্রভাবে নগরের মাইক্রো-ক্লাইমেট পরিবর্তিত হয়। যেহেতু তাপমাত্রা মানবীয় ও প্রাকৃতিক পরিবেশের নিয়ন্ত্রক, সেহেতু এর সামান্যতম পরিবর্তন নগরের অধিবাসীদের জন্য বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন রোগবালাইয়ের আবির্ভাব তো বটেই, হিটওয়েভের তীব্রতা ও সংখ্যা, বিল্ডিংয়ের উত্তপ্ত বা শীতলতাও এর সঙ্গে সম্পর্কিত।
২০১৮-২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, দিবাভাগে নগরের ত্বকের বার্ষিক তাপমাত্রা গ্রামের তুলনায় ঢাকা মহানগরে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি, রাতে ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি হতে পারে। পারিসরিকভাবে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি এলাকার পরিমাণ ঢাকায় ২০০৩ সাল থেকে দ্রুত বাড়ছে। ঋতুভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, শীতকালে দিবা-রাত্রির তাপমাত্রার তারতম্য কমে আসছে, তাই শীতের সময়ে গরম বেশি অনুভূত হয়। মাইক্রো-ক্লাইমেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে বাতাসের উষ্ণতা গ্রামের তুলনায় গড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। ভৌগোলিক এবং স্যাটেলাইট উপাত্ত থেকে দেখা যায়, কংক্রিটের আচ্ছাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে তাপ সিঙ্কের ভূমি যেমন কৃষি, জলাভূমি ও সবুজ ভূমির আচ্ছাদন।
একই গবেষণায় উঠে আসে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সবুজ ভূমির আচ্ছাদন মোট ভূমির তুলনায় মাত্র ২ দশমিক ৪১ শতাংশ (১০ মিলিয়নের বেশি নগরবাসীর জন্য অবশ্যই অপ্রতুল)। মোটাদাগে অস্বাভাবিক জন ঘনত্ব, কংক্রিটের আচ্ছাদনের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি, অফিস-আদালত/কলকারখানা/পরিবহনের বর্জ্য তাপ এবং অত্যধিক বিল্ডিংয়ের আধিক্য ঢাকার বাতাস ও ভূপৃষ্ঠের ত্বকের উষ্ণতাকে ত্বরান্বিত করছে। তা ছাড়া ঢাকার বিল্ডিংগুলো জলবায়ু সংবেদনশীল নয়, এগুলো দিনেরবেলা সূর্য থেকে প্রাপ্ত আলো ট্রাপ করে ফলে রাতে যে হারে ঠান্ডা হওয়ার কথা, তা না হয়ে উল্টোটা হয় অর্থাৎ বিল্ডিংগুলো তাপ ধরে রাখে। আর এই উদ্বৃত্ত তাপ আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে স্থানীয় জলবায়ুকে করছে উত্তপ্ত।
তাই নগরবাসী বিদ্যমান বহুবিধ সমস্যার সঙ্গে অতিমাত্রায় উষ্ণতাও অনুভব করছে। একদিকে মানবজীবনে বাড়ছে অস্বস্তি, অন্যদিকে শক্তিসম্পদের ওপর বাড়ছে চাপ, দেখা দিচ্ছে নিত্যনতুন রোগবালাই। যেমন ২০০০ সালের পূর্বে ঢাকার তথা দেশের মানুষ ডেঙ্গুর সঙ্গে মোটেই পরিচিত ছিল না, কিন্তু এখন ডেঙ্গু একটা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা উষ্ণায়নের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত। একইভাবে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করছে শীতলতা বজায় রাখতে, যা অদূর ভবিষ্যতে বাড়াবে পানিসম্পদের ওপর চাপ।
নগর-পরিকল্পনার অন্যতম একটা নির্ণায়ক হচ্ছে ফ্লোর এরিয়া অনুপাত বা এফএআর। প্রস্তাবিত ড্যাপে এই নির্ণায়ককে ঢাকা মহানগরের ক্ষেত্রে সর্বজনীন ধরে জন ঘনত্ব হ্রাসের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা কল্পনাপ্রসূত।
ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য নানমূখী পরিকল্পনা ১৯৪৭ সাল থেকে হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫৯ সালের ‘দ্য ঢাকা মাস্টারপ্ল্যান’ অন্যতম, যাতে ছোট একটা ভুলের (জনসংখ্যার ভুল প্রাক্কলন এবং মানুষের অভিগমনকে ধর্তব্যে না নেওয়া) মাশুল-পরবর্তী কয়েক দশক ধরে দিতে হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। হালের নতুন পরিকল্পনা ড্যাপ নানা কারণে সমালোচিত। নগর-পরিকল্পনার অন্যতম একটা নির্ণায়ক হচ্ছে ফ্লোর এরিয়া অনুপাত বা এফএআর। প্রস্তাবিত ড্যাপে এই নির্ণায়ককে ঢাকা মহানগরের ক্ষেত্রে সর্বজনীন ধরে জন ঘনত্ব হ্রাসের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা কল্পনাপ্রসূত।
তা ছাড়া জলাশয় সম্পর্কিত প্রস্তাবনা বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, স্থানীয় নগর জলবায়ুর কোনো বিষয়ই এতে নেই। বিশ্বব্যাংকের উপরিউক্ত তথ্য বলছে, ঢাকার তাপমাত্রার ভয়াবহতা ভবিষ্যতে মারাত্মক রূপ নিতে পারে, অথচ এমন একটা বিষয় ড্যাপ আমলেই নিল না! শুধু ড্যাপ কেন, দেশের জলবায়ু সম্পর্কিত নীতিমালা যেমন বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যানেও (২০০৯) নগর জলবায়ুর বিষয়টি উপেক্ষিত। সাম্প্রতিক বদ্বীপ পরিকল্পনায় বিষয়টি এলেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব সুস্পষ্ট।
আমাদের সংস্কৃতির অংশ কি না জানি না, আমরা যেকোনো বিষয়েই গোঁজামিলে অভ্যস্ত, যা দিন দিন বাড়ছে। অবিভক্ত ভারতে একসময় প্রচলিত কথা ছিল বাংলা আজকে যা চিন্তা করে বাকি ভারতবর্ষ করে দুদিন পরে। কিন্তু এই ধারণা এখন মনে হয় বিলীন হয়ে গেছে, যেমন নেই বিশ্বব্যাপী নিশ্চল জলবায়ুর ধারণা। আর তাই নগর হিসেবে ঢাকা ৪০০ বছর পার করলেও ২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক বাসযোগ্যতার সূচকে এর অবস্থান এখনো তলানিতে (১৩৮তম)। বিবিএসের ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৯ সালে দেশের নগরের জনসংখ্যা হবে ৮১ দশমিক ৪ মিলিয়ন, মানে বাংলাদেশ হবে অন্যতম নগররাষ্ট্র। তাই নগরের উষ্ণতাকে এখনই আমলে না নিলে ঢাকার তথা দেশের নগরগুলোর সমস্যা দিন দিন জটিল হবে, হারাতে পারে বাসযোগ্যতা।
বিশ্বব্যাংকের ২০১৩ সালের এক প্রকাশনায় বলা হয়, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে নগরের টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ঘনত্ব বাড়াতে হবে, যা বর্তমানে নিতান্তই অপ্রতুল। নগরের উষ্ণতা রোধে গবেষণাভিত্তিক পরিকল্পনা না নিলে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অধরাই থেকে যেতে পারে। বাড়তে পারে বিভিন্ন পরিবেশসংক্রান্ত সমস্যা, কেননা বাতাসের এবং নগরের ত্বকের তাপমাত্রা আমাদের সব কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা এবং সুষ্ঠু পারিসরিক পরিকল্পনাই কেবল পারে নগরের উষ্ণায়নের সঙ্গে অভিযোজনের পথকে সহজ করতে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া যা আকাশকুসুম চিন্তা ছাড়া কিছু নয়।
আশরাফ দেওয়ান অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের গবেষক।