>ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সম্পাদক পরিষদ গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। আইনটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি ১৫ অক্টোবর পরিষদের সদস্যদের নিয়ে তারা মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের পক্ষ থেকে পড়ে শোনানো বক্তব্যটি নিচে প্রকাশ করা হলো।
আমাদের মৌলিক আপত্তি, বারবার প্রতিবাদ, সরকারের সঙ্গে কয়েক দফায় আলোচনা ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে দুবার বৈঠক সত্ত্বেও মুক্ত সংবাদমাধ্যম, বাক্স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী কালাকানুন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে (ডিএসএ) আইনে পরিণত করায় আমরা যারপরনাই হতাশ, ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত।
তিনজন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর গণমাধ্যমবিষয়ক উপদেষ্টা প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, আমাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রহণযোগ্য পরিবর্তন–পরিমার্জনার লক্ষ্যে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করা হবে। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, এসবের কিছুই করা হলো না।
সম্পাদক পরিষদকে তিনজন মন্ত্রী যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমরা মনে করি, এটি সেই প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ।
আমরা আবারও স্মরণ করছি
শুরু থেকেই সম্পাদক পরিষদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল, যেগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই ধারাগুলো হলো যথাক্রমে ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩।
আমরা কয়েকবার আইনমন্ত্রী এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। আমাদের বক্তব্য সুবিবেচনা পাবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিল যখন ডাক ও টেলিযোগাযোগ–বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি–বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সামনে পেশ করা হয়, তখন সম্পাদক পরিষদ, বিএফইউজে ও অ্যাটকোর প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল; উভয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেই আমরা উপস্থিত ছিলাম।
সেসব বৈঠকে আমরা আমাদের আপত্তির জায়গাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরি এবং আমাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো বিশদভাবে বর্ণনা করি। আমাদেরকে তৃতীয় একটি বৈঠকের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, যা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে সহায়ক হতে পারত। কিন্তু সে বৈঠকটি কী কারণে অনুষ্ঠিত হয়নি, তা আমাদের কাছে আজও অজানা।
এভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া বিলটি চূড়ান্ত করা হয় এবং আমাদের চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ ও সম্মতি ছাড়াই সংসদে পেশ করা হয়।
এর ফলাফল হিসেবে, বিলটি চূড়ান্ত করা হলো এবং আমাদের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ ও সম্মতি ছাড়া তা সংসদে উপস্থাপন করা হলো। সাংবাদিকদের প্রধান উদ্বেগের বিষয়গুলো, বিশেষত, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতা–বিষয়ক ধারাগুলোতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছাড়াই আইনটি সংসদে পাস করা হয়। বরং শেষ মুহূর্তে এমন পরিবর্তন আনা হয়েছে, যার ফলে সংবাদপত্রের কার্যালয় ও সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর দপ্তরে প্রবেশ করা, তল্লাশি চালানো, বন্ধ করে দেওয়া, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক জব্দ করা, এমনকি পরোয়ানা ছাড়াই সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে পুলিশের ক্ষমতা আরও বেড়েছে।
আইনটি সংসদে পাস করার পর সম্পাদক পরিষদ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। তথ্যমন্ত্রীর অনুরোধে সেই কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। তিনি আইনটি নিয়ে আইনমন্ত্রী ও তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পাদকদের আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তথ্যমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে সম্পাদক পরিষদ মানববন্ধন কর্মসূচি স্থগিত করে এবং ৩০ সেপ্টেম্বর উল্লিখিত তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসে।
ওই বৈঠকে তিন মন্ত্রী সম্পাদক পরিষদকে প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দেন, মন্ত্রিসভার ৩ অক্টোবরের বৈঠকে অথবা ১০ অক্টোবরের বৈঠকে তাঁরা আমাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো উত্থাপন করবেন, এবং আমাদের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু করার জন্য মন্ত্রিসভার অনুমোদন চাইবেন। তিন মন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দেন যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এমন একটি সংস্করণ রচনার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে, যেটি সংশ্লিষ্ট সকল মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
দুঃখের বিষয়, সে রকম কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তিন মন্ত্রী কেন তাঁদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হলেন, তাঁদের কোনো একজনের
মাধ্যমে তা আমাদের জানানোর মতো সৌজন্যটুকুও দেখানো হয়নি।
ওপরের বিবরণ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, সকল অংশীজনের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে সম্পাদক পরিষদ সরকার ও সংসদের সঙ্গে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু আমাদের সব প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা ব্যর্থ হয়েছে।
আমরা আমাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হলো
১.সংবিধানের ৩৯ (২)(ক) ও (খ) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারসমূহের পরিপন্থী;
২. আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্নিহিত স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী;
৩. আমাদের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আন্দোলন–সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী;
৪.নৈতিক ও স্বাধীন সাংবাদিকতার মৌলিক মূল্যবোধগুলোর পরিপন্থী;
৫. তথ্য অধিকার আইনের চেতনা ও লক্ষ্য–উদ্দেশ্যের পরিপন্থী।
আমরা আবারও বলতে চাই
১. ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন প্রতিহত করা এবং ডিজিটাল অঙ্গনে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করতে গিয়ে এমন একটি আইন করা হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যমের কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি, বিষয়বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের সংবিধানপ্রদত্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের বাক্ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
২. এই আইন পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ এ আইনে দেওয়া ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
৩. এই আইনে অস্পষ্টতা আছে এবং এতে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সহজেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমন এক আতঙ্ক ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে সাংবাদিকতা, বিশেষত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কার্যত অসম্ভব
হয়ে পড়বে।
৫. এই আইন সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছাড়াও কম্পিউটার ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ইত্যাদি ব্যবহারকারী সব ব্যক্তির মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করবে।
আমাদের দাবি
১. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতা সুরক্ষার লক্ষ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা অবশ্যই যথাযথভাবে সংশোধন করতে হবে;
২. এসব সংশোধনী বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনে আনতে হবে;
৩. পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালানোর ক্ষেত্রে তাদেরকে শুধু নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু আটকে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া যাবে; কিন্তু কোনো কম্পিউটার ব্যবস্থা বন্ধ করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। তারা শুধু তখনই প্রকাশের বিষয়বস্তু আটকাতে পারবে, যখন সংশ্লিষ্ট সংবাদপ্রতিষ্ঠানের সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করে কেন ওই বিষয়বস্তু আটকে দেওয়া উচিত, সে বিষয়ে যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারবে;
৪. কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কোনো কম্পিউটার ব্যবস্থা আটকে দেওয়া বা জব্দ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই উচ্চ আদালতের আগাম নির্দেশ নিতে হবে;
৫. সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীদের সাংবাদিকতার দায়িত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমেই আদালতে হাজির হওয়ার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে সমন জারি করতে হবে (যেমনটা বর্তমান আইনে আছে) এবং সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীদের কোনো অবস্থাতেই পরোয়ানা ছাড়া ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া আটক বা গ্রেপ্তার করা যাবে না;
৬. সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীর দ্বারা সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না, তার প্রাথমিক তদন্ত প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে করা উচিত। এই লক্ষ্যে প্রেস কাউন্সিলকে যথাযথভাবে শক্তিশালী করা যেতে পারে;
৭. এই সরকারের পাস করা তথ্য অধিকার আইনকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ওপর প্রাধান্য দেওয়া উচিত। ওই আইনে নাগরিক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য যেসব স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সেগুলোর সুরক্ষা অত্যাবশ্যক।
পরিশেষে আমরা আবারও স্মরণ করছি
১. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতার প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ও দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার;
২. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের লড়াইয়ের সমুজ্জ্বল ঐতিহ্য এবং বিগত বছরগুলোর অসংখ্য লড়াই–সংগ্রামে তাদের অর্জন;
৩. বাংলাদেশে সামরিক একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালী করতে মুক্ত ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমের অতীতের সমস্ত লড়াই ও অবদান।
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিশেষত, মুক্ত ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, বাক্স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র শক্তিশালী করা—সর্বক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অগ্রগতিতে অবদান রেখে যেতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।
সম্পাদক পরিষদ
তারিখ: ১৩ অক্টোবর, ২০১৮
স্থান: জাতীয় প্রেসক্লাব