রাঙামাটির সাংবাদিক ফজলে এলাহী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট) আওতায় আটক হওয়ার এক দিন পর গত বুধবার জামিন লাভ করেছেন। এলাহীর আটক হওয়ার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ নাগরিকেরা এবং সাংবাদিক নেতারা যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, দ্রুত জামিন লাভ তারই ফলাফল বলে আমরা অনুমান করতে পারি।
২০১৮ সালের অক্টোবরে চালু হওয়া ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে আটক হওয়া ব্যক্তিদের বিবেচনায় এলাহীর আটক হওয়া কোনো ব্যতিক্রমী বিষয় নয়, তাঁর এত দ্রুত জামিন পাওয়াই একার্থে অস্বাভাবিক ঘটনা। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে যে নির্বিচারে নাগরিকদের গ্রেপ্তার করা হয়, তা সর্বজনবিদিত। ২০১৮ সালের গোড়া থেকে এই আইন প্রণয়ন এবং তার ব্যবহারের দিকে নজর রাখার সুবাদে এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে মতপ্রকাশের কারণে এই আইনে গ্রেপ্তার না হওয়াই এখন একধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) পৃষ্ঠপোষকতায় করা গবেষণায় আমরা দেখেছি যে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে কমপক্ষে ১ হাজার ৪২৪ জন এই আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন।
এর সঙ্গে ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে সংখ্যা যোগ করলে কী দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। ছাব্বিশ মাসের হিসাবেই আমরা দেখেছিলাম যে ২০৭ জন সাংবাদিক এই আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন। আমাদের সংগৃহীত তথ্যে দেখা গেছে যে কমপক্ষে ৮৪২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদের পেশা আমরা জানতে পেরেছি, তার প্রায় ১৯ শতাংশ (৫৯ জন) সাংবাদিক (আলী রীয়াজ, ‘দ্য আনএন্ডিং নাইটমেয়ার’, সিজিএস, এপ্রিল ২০২২)।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জামিন পাওয়া যে কত দুরূহ, সেটা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারাগারে গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর সবাই জানতে পেরেছেন। তাঁর জামিন নাকচ হয়েছিল ছয়বার। এ রকম অবস্থায় কতজন আছেন, তা আমরা জানি না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ধরনের তথ্য দিতে অস্বীকার করেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মন্ত্রী এবং তাঁদের সমর্থকেরা, যাঁরা বারবার বলেন, এই আইনের দরকার আছে, তাঁরা কিন্তু বলেন না ২০১৮ সাল থেকে কতজন অভিযুক্ত হয়েছেন, কতজন গ্রেপ্তার আছেন, কতজনের বিরুদ্ধে আইনের আওতায় দেওয়া সময়সীমার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এই সমর্থকদের মধ্যে সাংবাদিকও আছেন, তাঁরা এই বিষয়ে অন্যদের তদন্তের সমালোচনা করেন, কিন্তু নিজেরা তদন্ত করে দেখান না বাস্তবে এর প্রয়োজনটা কোথায়। অধিকাংশ ধারা জামিন অযোগ্য করার কারণে বিচারের আগেই শাস্তি প্রদানের এক অবারিত ব্যবস্থা হচ্ছে এই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট।
সাংবাদিক ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং তাঁকে গ্রেপ্তার অবশ্যই নিন্দনীয়; তিনি জামিন পেয়েছেন, সেটা আমাদের জন্য নিশ্চয় স্বস্তিদায়ক। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়াই যথেষ্ট নয়, এই আইনের ভয়াবহতা কেবল সাংবাদিকরাই মোকাবিলা করছেন, তা নয়। এর শিকার বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরাও।
ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে মামলা এবং তাঁকে গ্রেপ্তারের ঘটনা আরও অনেক ঘটনার মতো হলেও এ ঘটনার মধ্য দিয়ে এত দিন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের যেসব ভয়াবহ দিকের কথা বলা হয়েছে, তার অন্তত চারটি দিক আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব বিষয়ে গত তিন বছরে বারবার বলা হয়েছে।
প্রথমত, এই মামলার মেরিট; প্রায়ই দেখা যায় যে এই আইনে এমন মামলাও হয়, যেগুলো প্রচলিত আইনের আওতায়, এমনকি অভিযোগেরও বিষয় নয়। এলাহীর বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে জানা যাচ্ছে, ডিসি পার্কের অনিয়ম বিষয়ে ২০২১ সালে তিনি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। এতে রাঙামাটির সাবেক সংরক্ষিত সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু এবং তাঁর মেয়ে নাজনীন আনোয়ারের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ ছিল। তাঁরা এই নিয়ে থানায় অভিযোগ করেন। ‘পুলিশ অভিযোগ দুটি তদন্তের অনুমতি চাইলে আদালত প্রমাণ না পাওয়ায় খারিজ করে দেন’ (যুগান্তর, ৭ জুন ২০২২)। অথচ এই একই অভিযোগ নিয়ে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে গেলে ট্রাইব্যুনাল সেই মামলা গ্রহণ করেছে এবং এই মর্মে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে। এ ধরনের ঘটনা যে কেবল এক আদালত থেকে অন্য আদালতে গেলেই হচ্ছে, তা নয়।
দেখা গেছে, এই আইনে আনা অভিযোগের একটি বড় অংশ আদালত খারিজ করে দিচ্ছে। তার মানে হচ্ছে, এই আইনে এমন ধরনের মামলা করা হচ্ছে, যেগুলোর উদ্দেশ্যই হচ্ছে হেনস্তা করা। এগুলোর মেরিট না থাকলেও মামলা করার ব্যবস্থা আছে। আর সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে মাসের পর মাস কারাগারে বন্দী থাকার ঘটনা ঘটছে। এলাহী ভাগ্যবান যে তাঁকে এক রাতের বেশি হাজতে কাটাতে হয়নি, কিন্তু তাঁকে এই মামলায় কত দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হবে, তা অনিশ্চিত। কোটা বাতিল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেককেই এখনো আদালতে হাজিরা দিতে হয়। এর চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, যা ঘটেছে তা সবাইকে জানানো বা মতপ্রকাশ কোনো অবস্থাতেই অপরাধ হতে পারে না। এই আইন মতপ্রকাশকে অপরাধে পরিণত করেছে।
দ্বিতীয়ত, এই আইন ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। আমরা আমাদের গবেষণায় দেখেছি, ছাব্বিশ মাসে করা মামলাগুলোর ৮১ শতাংশ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। ক্ষমতাসীন দলের লোকজন তাঁদের ক্ষমতা দেখিয়ে যে কত সহজেই এ ধরনের মামলা করতে পারেন, তার আরও অনেক উদাহরণের সঙ্গে এটিও যুক্ত হলো। ক্ষমতার (অপ) প্রয়োগ যে কত দূর বিস্তার লাভ করেছে, তা এই ঘটনায় সুস্পষ্ট। ইদানীং কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, এই আইনের কিছু অপপ্রয়োগ হয়েছে (প্রথম আলো, ২২ মে ২০২২)। বাস্তবে এই আইনের কাঠামো এমনভাবে করা হয়েছে, যা কিছু ব্যক্তিকে সুরক্ষা দেবে, তাঁরা ইচ্ছেমতো তা ব্যবহার করবেন।
বাংলাদেশে এখন এমন এক শাসন জারি আছে, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের সর্বনিম্ন পর্যায়ের এক সদস্যের কথাও প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারী যদি ক্ষমতাসীন দলের লোক না হতেন, তবেও ট্রাইব্যুনাল একইভাবে আচরণ করত কি না, সেই প্রশ্নও তোলা যায়।
তৃতীয়ত, এই আইন থাকলে মন্ত্রী কী বললেন তাতে কিছু আসে যায় না। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের খসড়া নিয়ে সম্পাদক এবং সাংবাদিকদের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় মন্ত্রীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, খসড়া সংশোধন করা হবে। কিন্তু কারও কথাই শোনা হয়নি। এলাহীকে গ্রেপ্তারের পর অনেকেই মনে করিয়ে দিয়েছেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, এই আইনে সাংবাদিকের তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করা হবে না; তাঁর বক্তব্য ছিল সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হলে তাঁকে সমন দিতে হবে।
মামলা হওয়ার পর সাংবাদিক আদালতে জামিন চাওয়ার সুযোগ পাবেন (প্রথম আলো, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১)। গত মাসে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুর রহমান নির্দেশনা জারি করেছিলেন, এই আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে ডিএমপির একজন অতিরিক্ত কমিশনার পদের কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে (প্রথম আলো, ১৬ মে ২০২২)।
আইনমন্ত্রী এবং পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা এমন কথা বলেছেন না জানলে এগুলোকে আইন নিয়ে ছেলেখেলা বলেই মনে হতো। আইনে কোনো ব্যক্তি বা পেশাকে ছাড় দেওয়ার কোনো বিধান থাকতে পারে না। আইন প্রয়োগে ক্ষমতাসীন দলের ব্যক্তিদের ছাড় দেওয়ার যে অভ্যাস ও রীতি গড়ে উঠেছে সেই মানসিকতা থেকেই এ ধরনের কথাবার্তা বলা হয়। অন্যথায় এর উদ্দেশ্য আরও হীন-সাংবাদিকদের বশে রাখা যেন তাঁরা এই নিয়ে কথা না বলেন। প্রায়ই মন্ত্রীদের বলতে শুনি, গত তিন বছরে বড় মাপের কোনো সাংবাদিক এই আইনে গ্রেপ্তার হননি, ফলে আইনের প্রয়োগ ঠিক আছে। সব সাংবাদিকই সমান, সব নাগরিকই সমান—এটাই হচ্ছে আইনের শাসনের ভিত্তি, এর কোনো ভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে না।
চতুর্থ বিষয় হচ্ছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে অভাবনীয় দ্রুত গতিসম্পন্ন কার্যকারিতা। ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে মঙ্গলবার দুপুরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পুলিশের হাতে আসার পর সন্ধ্যার মধ্যেই তিনি গ্রেপ্তার হন। পুলিশের এই তৎপরতা অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রেও, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এমনকি ভিডিও চিত্র থাকলেও, লক্ষ করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, কাউকে আটক করার পর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
এগুলো প্রমাণ করে যে আইনের বাস্তবায়ন নয়, লক্ষ্য হচ্ছে শায়েস্তা করা।
সাংবাদিক ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং তাঁকে গ্রেপ্তার অবশ্যই নিন্দনীয়; তিনি জামিন পেয়েছেন, সেটা আমাদের জন্য নিশ্চয় স্বস্তিদায়ক। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়াই যথেষ্ট নয়, এই আইনের ভয়াবহতা কেবল সাংবাদিকরাই মোকাবিলা করছেন, তা নয়। এর শিকার বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরাও। গত শনিবার সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এমদাদুর রহমান ইনজাদ এই আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগের এক নেতা। অভিযোগ, ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কটূক্তি করা। একই সময়ে দেশের অন্যত্র আরও গ্রেপ্তারের ঘটনাও সম্ভবত ঘটছে, দলীয় পরিচয়ের বাইরে সাধারণ নাগরিকেরা প্রতিদিন এই আইনের আওতায় অভিযুক্ত এবং গ্রেপ্তার হচ্ছেন। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক বা ভিন্ন কোনো পেশা বিবেচনা করে নয়, এই আইনের শিকার যিনিই হোন না কেন, তার পক্ষেই সবার সোচ্চার হওয়া জরুরি। মতপ্রকাশের অধিকারের প্রশ্ন দলীয় প্রশ্ন নয়।
● আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।