ডাকসু নির্বাচন: ছাত্ররাজনীতির গুণগত বদল, কিছু সংশয়
ছাত্ররাজনীতির বর্তমান বাস্তবতা হলো, যারা ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ, তারাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, ক্যাম্পাস ও ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হলগুলোতে আধিপত্য, দখলদারি বজায় রাখছে। তারা দলীয় আনুগত্যের রাজনীতি করছে এবং পেশিশক্তির চর্চা করছে।
ছাত্ররাজনীতির নামে তারা ভয়ের সংস্কৃতি আর দখলদারির সংস্কৃতিকে মাঠপর্যায়ে বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ছাত্ররাজনীতির এই ধারায় কিন্তু আমরা কোনো রকম আদর্শ কিংবা নৈতিকতার অনুশীলন কিংবা চেষ্টা, কিছুই দেখছি না। সেই অর্থে চলমান ছাত্ররাজনীতির কোনো ন্যূনতম মানও কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো-মন্দ এবং শিক্ষা-গবেষণার প্রশ্নে কিন্তু এদের কোনো কর্মসূচি নেই। এমনকি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধার প্রশ্নেও তাদের কোনো নৈতিক অবস্থান নেই। উল্টো আমরা বিভিন্ন সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার বিরুদ্ধে এমন ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের অবস্থান নিতে দেখেছি।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিল, রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল, তখন এই ছাত্ররাজনীতির হোমরাচোমরারা তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের পেটোয়া বাহিনী, হেলমেট বাহিনী হয়ে কাজ করেছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে যখন স্কুল-কলেজের বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা রাজপথে আন্দোলন করছিল, তখনো আন্দোলনে নামা কিশোর-কিশোরীদের বিরুদ্ধে এদের মারমুখী হতে দেখা গেছে। এই রকম চর্চাটা কিন্তু অনেক দিন ধরেই চলছে। এখনকার ক্ষমতাসীনদের সময়ে যেমন এটা দেখা যাচ্ছে, তেমনি এর আগে ক্ষমতায় থাকা দলের পক্ষেও তাঁবেদারি ছাত্ররাজনীতির এই ভূমিকা আমরা দেখেছি।
এ অবস্থায় ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচনকে যত বড় করে দেখা হচ্ছে, আমি কিন্তু ততটা আশাবাদী নই মোটেই। আমার বরং ডাকসু নিয়ে উল্টো আশঙ্কা আছে। মাঝখানে কয়েকটা দশক গেল, আমরা কিন্তু তেমনভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হতে দেখিনি। একটা শব্দ ছিল ‘সাইনে ডাই’ (sine die), এর মানে হলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা। এখন কিন্তু তেমন পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন হলে যে নতুন ছাত্র নেতৃত্ব আসবে, সেটা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমান্তরাল একটা ক্ষমতা চর্চার জায়গায়, একটা দ্বৈত-প্রশাসনের অবস্থায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করতে পারে। সে রকম হলে আবাসিক হলগুলো থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসে এই রকম ম্যান্ডেট পাওয়া বৈধ মাস্তানির চর্চা এখনকার চেয়ে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এমনকি তখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-সংস্কৃতি-পরিবেশের প্রশ্নে এটা আমার কাছে খুবই একটা ভয়ের জায়গা হিসেবে কাজ করে।
গত দুই-আড়াই দশকে বড় ছাত্রসংগঠনগুলোর কাউকেই আমরা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট, শিক্ষার্থীদের অধিকারসংশ্লিষ্ট, আবাসন-সমস্যা বা গ্রন্থাগারের সমস্যা কিংবা ছাত্রছাত্রীদের কোনো সাধারণ সুবিধা-অসুবিধার প্রশ্নে কোনো কর্মসূচি নিতে দেখিনি। কাজেই নির্বাচিত হয়ে এলেই যে তারা ছাত্র-অধিকার নিয়ে কথা বলবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ বা কোনো নমুনাও কিন্তু আমাদের সামনে নেই। প্রগতিশীল ধারার কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের মুষ্টিমেয় কিছু ছেলেমেয়ে হয়তো বিভিন্ন সময়ে এসব নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তখনো কিন্তু এরা হয় নীরব থেকেছে, নয়তো উল্টো বিরোধিতা করেছে, অথবা আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়েছে। হলে হলে এদের নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী আছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এরা সারা রাত গেস্টরুমে আটকে রাখে, গণরুমে নির্যাতন চালায়। এই নেতা-কর্মীদের নিজস্ব স্টাইলের প্রটোকল আছে, সাধারণ কর্মীদের এদের স্যালুট দিতে হয়, এদের কথায় উঠবস করতে হয়, দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, মিছিলে যেতে হয়।
এ অবস্থায় আমার কিছু প্রশ্ন কাল যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে: এক. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেখলাম, ডাকসু নির্বাচনও কি সেই রকম হবে? দুই. এখানে যে প্রশাসন নির্বাচনের দায়িত্বে আছে, তারাও একপক্ষীয়, তারাও ক্ষমতাসীনদের আনুগত্যের রাজনীতিই করে। যেসব শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালান, তাঁদের ওপরও কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকদের কোনো আস্থা নেই। জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কর্তৃপক্ষও কিন্তু একই রকম প্রশ্নবিদ্ধ। তারা কি আজ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে? তিন. ছাত্ররাজনীতির কাঠামোগত ও গুণগত পরিবর্তন ছাড়া শুধু ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোনো যুগান্তকারী পরিবর্তন কি সম্ভব? চার. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সংগঠনগুলোকে এটা বোঝানো কতটা সম্ভব যে, একটা পরাধীন দেশের ছাত্ররাজনীতি আর একটা স্বাধীন দেশের ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা আর দায়িত্ব কী এক রকম?
আমি মনে করি, আজকের ছাত্ররাজনীতি হতে হবে পুরোপুরি শিক্ষা ব্যবস্থাকেন্দ্রিক, শিক্ষার্থীদের অধিকার, শিক্ষা-গবেষণা সংক্রান্ত দাবিদাওয়া, ক্যাম্পাসের পরিবেশ-সংস্কৃতি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে। ক্ষমতায় বা ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি ছাত্ররা করবে না। ছাত্রসংগঠনগুলোকে কাঠামোগতভাবে এবং অনুশীলনের জায়গা থেকে স্বাধীন থাকতে দিতে হবে। তাহলেই আজকের তরুণ প্রজন্ম নিজেদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও তখন ছাত্ররাজনীতি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে। ছাত্ররাজনীতির কাঠামোগত ও গুণগত এমন পরিবর্তন ছাড়া ‘ডাকসুর সোনার হরিণ’ আমাদের কিছুই দিতে পারবে না।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘দুধ বিষাক্ত হলে সেই দুধ থেকে যে মাখন ছেঁনে নেওয়া হবে তা আরও বিষাক্ত হবে।’ এখন যে ছাত্ররাজনীতি আমরা দেখছি, সেখানে ছাত্ররাজনীতির ৯০ ভাগই যে প্রক্রিয়ায় চলছে, সেটা বিষাক্ত হয়ে গেছে। ফলে এই ছাত্ররাজনীতি থেকে আসা ছাত্র নেতৃত্ব বা বেছে নেওয়া ডাকসু নেতৃত্বও ‘বিষাক্ত’ হয়ে উঠতে পারে। কাজেই ডাকসু নিয়ে যে উচ্চাশা দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে আবেগতাড়িত বিষয় আছে, অতিশয়োক্তি আছে। ডাকসু সম্পর্কে আমাদের ধারণার মধ্যেই যতটা না সত্য আছে, তার চেয়ে বেশি মিথ আছে, একটা বিশ্লেষণহীন ঢালাও ধারণায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকার ব্যাপার আছে। ফলে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নির্মোহ হয়ে ভাবনাচিন্তা করা প্রয়োজন, আমরা আসলে এখান থেকে কী প্রত্যাশা করছি বা কী প্রত্যাশা করব।
রোবায়েত ফেরদৌস: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]