সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (বর্তমানে শহীদ শামসুদ্দীন সদর হাসপাতাল) নবীন শল্যচিকিৎসক ছিলেন ডা. শ্যামল কান্তি লালা।
শান্ত-সৌম্য লালা পান খেতে অসম্ভব ভালোবাসতেন। ঠোঁটে সব সময় থাকত একচিলতে স্নিগ্ধ হাসি।
তাঁর কাছে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা সবাই একবাক্যে বলতেন, ডা. লালার কাছে এলেই মনে হয় অর্ধেক রোগ ভালো হয়ে গেছে। তাঁর প্রশংসায় সবাই ছিলেন পঞ্চমুখ।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু যাননি। প্রথম কারণ, মানবতার সেবা তাঁর কাছে ছিল প্রধান।
দ্বিতীয়ত, তাঁর শিক্ষাগুরু ডা. শামসুদ্দীন আহমেদকে ফেলে যেতে চাননি। শিক্ষাগুরুর মতো তিনিও ধারণা করেছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর যাই করুক, মানবসেবার একমাত্র স্থান হাসপাতালে কিছু করবে না।
এই বিশ্বাসে হাসপাতালে থেকে যান তাঁরা। কিন্তু তাঁদের সে ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো সিলেটেও চলছিল প্রতিরোধযুদ্ধ। প্রতিদিন সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসছিল যুদ্ধে আহত ব্যক্তিরা।
শ্যামল কান্তি লালা তাঁর শিক্ষাগুরুর সঙ্গে তাঁদের চিকিৎসা ও সেবাযত্নে নিয়োজিত ছিলেন।
সিলেটে প্রতিরোধযুদ্ধ ভেঙে পড়লে ৯ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হয়।
তখন শ্যামল কান্তি লালা ডা. শামসুদ্দীনের সঙ্গে ওয়ার্ডে রোগী দেখছিলেন। সেনারা তাঁদের সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যায়।
এ সময় শ্যামল কান্তি লালা চিৎকার করে ইংরেজিতে সেনাদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘প্লিজ ডোন্ট হার্ট হিম, হি ইজ মাই প্রফেসর, শুট মি ফার্স্ট, বাট লেট হিম গো।’ তাঁর এ অনুরোধ সেনাদের কাছে ছিল মূল্যহীন।
সেনারা তাঁদের টেনে বাইরে এনে আরও কয়েকজনসহ লাইনে দাঁড় করায়। তখন শ্যামল কান্তি লালা আবারও কিছু বলতে চাইলে তাঁর মুখে সজোরে লাথি মারে এক সেনা। এরপর তাঁদের গুলি করে। একজন ছাড়া সবাই মারা যান।
৯ এপ্রিল এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটলেও ১২ এপ্রিলের আগে তাঁদের কাউকে সমাহিত করা যায়নি। মরদেহগুলো শিয়াল, কুকুর ও শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়।
১২ এপ্রিল কারফিউ শিথিল হলে হাসপাতাল কলোনি থেকে কয়েকজন এসে মরদেহগুলো মাটিচাপা দেয়।
এ ঘটনা সম্পর্কে আরও জানা যায়, শ্যামল কান্তি লালার সতীর্থ ডা. মৃগেন কুমার দাস চৌধুরীর আমার হোস্টেলমেট রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘৯ এপ্রিল মধ্যবেলা।
লালাকে নিয়ে শামসুদ্দীন স্যার ওয়ার্ডে রোগী দেখছিলেন। একটু পর জরুরি অপারেশনে ওটিতে ঢুকবেন।
এমন সময় পাকিস্তানি সেনারা ওয়ার্ডে ঢুকে তাঁদের দুজনকে পাষণ্ডের মতো টেনেহিঁচড়ে হাসপাতালের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আরএস কোয়ার্টার-সংলগ্ন খালি মাঠে নিয়ে যায়।
সঙ্গে জড়ো করে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, কোরবান আলী, নার্স মাহমুদুর রহমান, পিয়ন মো. মহিবুর রহমান, মকলিসুর রহমানসহ মোট সাতজনকে।
পেছন থেকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয় সবার শরীর। গুলিতে ডান হাতের হাড় চুরমার হয়ে গেলেও মকলিসুর অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়।
হানাদারেরা স্থান ত্যাগ করার পর গড়িয়ে গড়িয়ে মকলিসুর সরে পড়ে। সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে মকলিসুর আজও বেঁচে আছে। আমাদের অনুপস্থিতিতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার কথা আমি স্বাধীনতার পর মকলিসুর ও তদানীন্তন আরএস ডা. সৈয়দ লোকমান ও অন্যদের কাছ থেকে শুনি।’ (পরিমার্জিত)।
শ্যামল কান্তি লালার জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৪৮। পৈতৃক স্থায়ী ঠিকানা আকালিয়া, খড়নদ্বীপ, পটিয়া, চট্টগ্রাম। বাবা সুধাংশু বিমল লালা।
তিনি চিকিৎসক ছিলেন।
শ্যামল কান্তি লালা ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৬৪ সালে আইএ পাস করে সিলেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। মেধাবী ছিলেন।
১৯৭০ সালের জুনে এমবিবিএস পাস করে হাসপাতালে হাউস সার্জন হিসেবে যোগ দেন। তখন এখনকার মতো বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ ছিল না।
মেধানুসারে দুজন হাসপাতালে হাউস সার্জন হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেতেন।
শ্যামল কান্তি লালা অবিবাহিত ছিলেন।
সিলেট মেডিকেল কলেজের (বর্তমানে এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ) ছাত্রীনিবাস তাঁর নামে নামাঙ্কিত। এ ছাড়া কলেজের হাসপাতাল চত্বরে তাঁর নামে স্মৃতিফলক রয়েছে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ, বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ, প্রকাশ ২০০৯। প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (সপ্তম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৮) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
[email protected]