২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ট্রাম্পবাজির দুনিয়া

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

সামরিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক শক্তিতে দুনিয়াকে ওলট–পালট, কমপক্ষে ঝাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা অর্থে শক্তিমান দেশের সংখ্যা আসলে হাতেগোনা। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন এই তালিকার একেবারে ওপরে। এরপর নাম আসতে পারে জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন আর জাপানের। ইসরায়েল, ইরান, উত্তর কোরিয়া, ভারত আর পাকিস্তানও থাকবে এই তালিকায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের তোলপাড়ে ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে কেবল আমেরিকায় নয়, বরং জার্মানি ও ফ্রান্স বাদে এই তালিকার বাকি দেশগুলোতেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্থানীয় সংস্করণেরাই ক্ষমতায় আছেন।
ট্রাম্প কে? ট্রাম্প হচ্ছেন বিদ্বেষবাদ ও কর্তৃত্ববাদের নয়া অবতার; পুঁজিবাদের পিতৃভূমি আমেরিকা যাঁর লীলাক্ষেত্র। ট্রাম্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য গোটা দুই। ট্রাম্প বিদ্বেষবাদকে দস্তুরমতো ‘শিল্পে’ পরিণত করেছেন। যারা ‘আমাদের’ মতো নয়, তাদের বিরুদ্ধে অবিরাম বিদ্বেষ হচ্ছে ট্রাম্পের রাজনীতির বীজমন্ত্র। এই বিদ্বেষ চাগিয়ে তোলা হয় অপরায়ণের মাধ্যমে। যারা ‘আমাদের’ মতো নয়, তারা হচ্ছে ‘অপর’। এই অপরেরা খারাপ, এই অপরেরা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, এই অপরেরা আমাদের যাবতীয় দুর্ভোগের কারণ, এই অপরেরা আমাদের আরও অনেক ক্ষতির কারণ হবে। অতএব, এই অপরদের যেভাবেই হোক শায়েস্তা করা হচ্ছে এই রাজনীতির মূল সূত্র। ট্রাম্প তাঁর রাজনীতির জন্য প্রধানত ব্যবহার করেন উগ্র জাতীয়তাবাদী সুড়সুড়ি। নয়-এগারোর পর থেকে আমেরিকাতে জাতীয়তাবাদ চাগা দিতে থাকে। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দা সূচনার পর থেকে তা উগ্র রূপ নেয়। অভিবাসী, মুসলিম, মেক্সিকান, বিদেশি—এরা হচ্ছে ট্রাম্পের কাছে ‘অপর’। এর মধ্যে মুসলিমরা একটু বেশি অপর। বিদ্বেষ আর কর্তৃত্বপরায়ণতা-নির্ভর অগণতান্ত্রিক এই রাজনীতি বোঝার সুবিধার জন্য এর নাম দেওয়া যেতে পারে ট্রাম্পবাজি।
এবার দেখা যাক অন্য শক্তিমান দেশগুলোতে ট্রাম্পবাজি কীভাবে ক্ষমতার দখলে আছে। শুরুতে রাশিয়ার আলোচনা। আমেরিকার ট্রাম্পের মতো রাশিয়ার পুতিনও মূলত সম্বল করেন জাতীয়তাবাদ। তবে পুতিন দেশের ভেতরে তেমন কোনো ‘অপর’ দাঁড় না করিয়ে আমেরিকা-ইউরোপ নামক অপরদের বিরুদ্ধে একটানা বিদ্বেষ ছড়াতে ছড়াতে দেশের ওপর বলতে গেলে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। রাশিয়াতে মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় বটে, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। আসলে এখন পুতিনই রাশিয়া। রাশিয়াকে পুতিন নামে ডাকা যায়। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মধ্যেও আছে ট্রাম্পের কিছু বৈশিষ্ট্য। তাঁর দলের নাম লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, অর্থাৎ কিনা উদার গণতান্ত্রিক দল। কিন্তু আবের রাজনীতিতে লিবারেল ও ডেমোক্রেটিক উপাদান দ্রুত কমছে; বাড়ছে চড়া জাতীয়তাবাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শান্তিমুখী সংবিধান পাল্টানোর জোর চেষ্টা, সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি, চীনের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ দ্বীপ নিয়ে ঝগড়ায় শব্দ ব্যবহারের ধরন-ধারণে আবের মধ্যে ট্রাম্পকে দেখা যায়। ট্রাম্পের মতোই শান্তি, গণতন্ত্র, সৌহার্দ্য, বৈচিত্র্যের চেয়ে জাতীয় গর্বের ধারণাই আবেতে প্রকট।
ভারতে নরেন্দ্র মোদি আর ইসরায়েলের বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ট্রাম্পবাজি হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মীয় উন্মাদনার মিশেল। মোদি তাঁর বর্তমান দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হিন্দু জাতীয়তাবাদ আর সাবেক সংগঠন তথা বিজেপির অভিভাবক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) হিন্দু মৌলবাদী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করে হিন্দু ভারত প্রতিষ্ঠার প্রকল্পে আছেন। মোদির প্রধানত দুই অপর—মুসলিম ও পাকিস্তান। মোদি ও তাঁর দলের রাজনীতি প্রকৃত অর্থে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতির তত্ত্বের নিবিষ্ট অনুসারী। নেতানিয়াহুর রাজনীতি মোদির রাজনীতির মতো। নেতানিয়াহুর অপর হচ্ছে ফিলিস্তিন, আরব, মুসলিম ও মধ্যপ্রাচ্য। নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি উগ্র জায়নবাদের চাষবাস করে, যা আসলে ইহুদি সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এখানেই শেষ নয়। বিজেপির ঘাড়ে যেমন আরএসএস আছে, লিকুদের কোয়ালিশন সরকারের ঘাড়ে তেমনি বসে আছে জিউস হোম, ইসরায়েল বেইতিনু পার্টি (Yisrael Beiteinu party), শাস (Shas), ইউনাইটেড তোরাহ জুদাইজমের মতো ইহুদি মৌলবাদী দলগুলো। নেতানিয়াহুর কট্টর অপরায়ণেও এরা খুশি নয়; জায়নবাদী ইসরায়েলেও এরা সন্তুষ্ট নয়। এরা ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তোরাহভিত্তিক ইসরায়েল চায়। নেতানিয়াহু এদের নিয়েই ইসরায়েল চালান। নেতানিয়াহুকে কি ট্রাম্পের চেয়ে বড় ট্রাম্পবাজ বলা যায় না? আয়াতুল্লাহ খোমেনির বানানো ইরানে অপরায়ণের প্রধান উপাদান ধর্ম। ধর্ম বলতে শিয়া ইসলাম। ক্ষমতাধারী শিয়া ধর্মগুরুদের বদৌলতে সুন্নি, ইহুদি, খ্রিষ্টান ইভানজেলিস্ট, অগ্নি উপাসক সবাই অপর; একাধারে ইসরায়েল ও সৌদি আরব হচ্ছে অপর। ট্রাম্পের আমেরিকার সঙ্গে খোমেনির ইরানের পার্থক্যটা ঠিক কোথায়?
চীনের ক্ষেত্রে হয়তো ট্রাম্পীয় অর্থে বিদ্বেষবাদ দেখানো মুশকিল। কিন্তু কমিউনিজমের নাম ভাঙিয়ে কর্তৃত্ববাদ চর্চায় চীনা শাসকেরা বেশ এগিয়ে। চীনে সর্বক্ষমতাময় একটি কমিউনিস্ট পার্টি আছে কিন্তু এটাই সত্য যে চীনে কমিউনিজম নেই। দেং জিয়াও পেংয়ের আমল থেকে চীন অর্থনীতিতে মোটাদাগে পুঁজিবাদী। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কমিউনিজমের কথা বলা হয় কমিউনিস্ট পার্টির হাতে ক্ষমতা আটক রাখার জন্য। উত্তর কোরিয়ায়ও একই কেস। কমিউনিজমের নাম ভাঙিয়ে, সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে ভীষণ অপরিশোধিত কর্তৃত্ববাদ চর্চা হচ্ছে দেশটিতে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অবিরাম অনুশীলন। বিদ্বেষবাদ আর অপরায়ণই সব—আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সাম্রাজ্যবাদ। মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা এসবের কোনো চিহ্ন নেই উত্তর কোরিয়াতে।
ইউরোপের তিন দেশের মধ্যে প্রথমে আলো ফেলা যাক ব্রেক্সিট যুগের ব্রিটেনের দিকে। ট্রাম্পের মতো অতটা কর্তৃত্ববাদীও হয়তো নন, কিন্তু ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কনজারভেটিভ পার্টির থেরেসা মে বিদ্বেষবাদী রাজনীতিতে খুব একটা পিছিয়ে থাকবেন না। মের পূর্বসূরি ডেভিড ক্যামেরনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলবে। কয়েক বছর ধরে অভিবাসী বিদ্বেষ ছাড়া আর কী আছে ব্রিটিশ রাজনীতিতে? এখন ব্রিটেনে ভোটের জন্য সহজ পথ অভিবাসী বিদ্বেষ। সবশেষে জার্মানি ও ফ্রান্স। শক্তিমান দেশগুলোর মধ্যে এই দুই দেশে এখন পর্যন্ত বিদ্বেষবাদী-কর্তৃত্ববাদীরা ক্ষমতায় নেই। তবে ফ্রান্সের বোধ হয় দিন ঘনিয়ে এসেছে। সামনের নির্বাচনে বর্তমানে ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্টদের হার নিশ্চিত। বিদ্বেষবাদী ডানপন্থী অথবা উগ্র ডানপন্থীরাই আসছে ক্ষমতায়। জার্মানিতেও বিদ্বেষবাদীরা লম্ফ দিয়ে এগোচ্ছে জনপ্রিয়তায়।
ট্রাম্পবাজরা এখন বিশ্বের দখল নিয়ে ফেলেছেন। আমেরিকার ট্রাম্প এখন ঘৃণার সলতেয় আগুন দিতে শুরু করেছেন। শক্তিমান দেশগুলোর বাইরে, উদারপন্থার জন্য খ্যাত অনেক দেশেও ট্রাম্পবাজির জয়জয়কার। সুইডেন ও নেদারল্যান্ডসের নাম বলা যায় এ ক্ষেত্রে। আরেকটা কথা, ট্রাম্পেরা কেবল শক্তিশালী দেশে থাকেন না; দুর্বল দেশেও থাকেন। ট্রাম্পবাজি করে ভোটে জেতেন এমন রাজনীতিক, এমন দল বাংলাদেশে নেই?
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।