জয় না পেলেও অভীষ্ট পূরণ হবে ট্রাম্পের
আমেরিকার গণতন্ত্র একটা চিকন সুতায় ঝুলন্ত। মার্কিন নির্বাচনের ফল পেকেছে যেহেতু, বেশিক্ষণ তা ওই সুতায় ঝুলে থাকবে না, পড়বে এবং সবাই দেখতে পাবে কে দেশটির ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হন। ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হওয়া মানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে আরও তছনছ করে রোমান সিজারের কায়দায় শাসন চালু হওয়া। জুলিয়াস সিজারও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বলে জনতাকে খেপিয়ে রোমান রিপাবলিককে রাজতন্ত্রী করে তুলে অতীতের গৌরবের অস্ত যাওয়া নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু মনে হয় এ যাত্রা আমেরিকা ওই চিকন সুতার ভারসাম্য দিয়ে রক্ষা পেল। কিছু শহরে রক্ষীবাহিনী নামানো হলেও বড় মাপের গন্ডগোল মনে হয় এড়ানো যাবে।
যদি ট্রাম্প হারেনও, সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সরকারের বহু সিদ্ধান্ত আটকে দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর দলের থাকছে আর তিনিও থাকছেন দলের প্রভাবশালী ভূমিকায়। রিপাবলিকান পার্টি তাঁকে শিগগির ছাড়বে না, যেহেতু দলটিকে চাঙা করায় মূল ভূমিকা ট্রাম্প মহাশয়েরই। তা ছাড়া অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী, রক্ষণশীল, ধর্মভীরু, গরিব আর ভোগবাদী ধনিকেরা তাঁর পক্ষে অনেক বেশি সংগঠিত। নির্বাচনে জয় না পেলেও অভীষ্ট পূরণ হবে জনাব ডোনাল্ড ট্রাম্পের। চীন বা রাশিয়া কিংবা ইরান-উত্তর কোরিয়া যা পারেনি, ট্রাম্প তা পেরেছেন। আমেরিকার বৈশ্বিক ক্ষমতা ও মর্যাদা নামিয়ে নিয়ে এসেছেন। সরকারব্যবস্থার গভীর দলীয়করণ করেছেন, বিচার বিভাগকে রাজনীতিকীকরণ করেছেন এবং সমাজকে দুটি ঘৃণাবাদী শিবিরের মধ্যে ঢোকাতে পেরেছেন। আমেরিকার যেকোনো শত্রু এতে খুশিই হবে এবং সেই খুশির চোটে ট্রাম্পকে আরেক দফা ক্ষমতায় রাখার স্বপ্নও দেখে থাকবে।
ট্রাম্পকে খাটো করে দেখা ভুল ছিল
নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের দিনে—সব জনমত জরিপই জো বাইডেনের ভূমিধস বিজয়ের ছবি এঁকেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমও ছিল ট্রাম্পের বিপক্ষে। কিন্তু সবই গরল ভেল হলো। ভূমিধস বিজয় তো দূরের কথা, জিতলেও টেনেটুনেই পাস করতে হবে বাইডেনকে। সেক্ষেত্রে তিনি হবেন অর্ধেক নাগরিকের প্রেসিডেন্ট। বাকি অর্ধেক সুস্পষ্টভাবে ট্রাম্পকেই চেয়েছিল। দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ ধারালো করে অতীতে যেভাবে ফায়দা তুলেছেন, ভবিষ্যতেও তা–ই করবেন। কেন ট্রাম্প নির্বাচনের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলেন, একটা হিসাব তা বোঝাতে পারে।
কৃতকর্ম ও দৈব—দুয়ের বিরুদ্ধেই তিনি লড়েছেন শেকসপিয়ারের নাটকের হ্যামলেটের মতো। শুধু প্রতিপক্ষই তাঁকে থামাতে চায়নি, নিজের পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতার ভারও ছিল কাঁধে তাঁর। জো বাইডেনের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল তাঁর—যাঁর পেছনে ছিল ক্লিনটন-ওবামা-হিলারির শক্ত সমর্থন। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস আন্দোলন তাঁকে ঘৃণিত করে তুলেছিল। করোনাভাইরাসের মহামারি তাঁকে ও তাঁর সরকারকে অপরাধমূলক অবহেলার দোষে দুষ্ট করে দিয়েছিল।
এত সব বাধা সত্ত্বেও জনাব ট্রাম্প ২০১৬ সালের চেয়ে বেশি ভোট পেলেন! ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন বেশি ভোট পেয়েও যে ট্রাম্পের কৌশলে হোয়াইট হাউস থেকে দূরে থাকলেন, সেটাকে এখন আর দুর্ঘটনা মনে হবে না। এবার বাইডেনের ভূমিধস বিজয় না পাওয়াও কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। ট্রাম্প শিবির বাইডেন শিবিরকে কেবল কঠিন স্নায়ুচাপেই ফেলেনি, ডেমোক্র্যাট শিবিরের প্রথাগত ভোটব্যাংকেও হানা দিয়েছে। লাতিনো ও কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদেরও তিনি নিজের পক্ষে ভাগ করে নিতে পেরেছেন; তাঁদের একচেটিয়াভাবে বাইডেনকে ভোট দিতে দেননি।
সবকিছু এটাই বলে যে ট্রাম্পকে খাটো করে দেখা অতীতেও ভুল ছিল, এখনো ভুল হবে।
ট্রাম্পের আসল ট্রাম্পকার্ড
ট্রাম্প ভীরু ও লাজুক মানুষদের জাগিয়ে দিয়েছেন। আমেরিকা সাংবিধানিকভাবে অনেকটাই উদার ও সেক্যুলার হলেও সামাজিকভাবে অনেক রক্ষণশীল। ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান, জায়নবাদী ইহুদি আর বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গরা সেখানকার সমাজে যথেষ্ট শক্তিশালী। আমেরিকার ধনিক শ্রেণি আরেকজন বারাক ওবামা কিংবা জন এফ কেনেডিকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। ট্রাম্পের পক্ষে কাজ করা বিষয়ে এই প্রতিক্রিয়াশীল ত্রিভুজের কোনো ক্লান্তি ছিল না। কিন্তু এরাই যথেষ্ট নয়। দোলায়মান রাজ্য এবং ভাসমান ভোটারদের দোলাচলের মীমাংসা ট্রাম্প করে দিয়েছেন। ক্রমাগত মিথ্যা, ঘৃণার প্রচার আর বর্ণবাদী বাকোয়াজি দিয়ে তিনি তাঁদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন যে বাইডেন জিতলে আমেরিকা আর আমেরিকা থাকবে না। তিনি রাজনীতিতে উদাসীন সুপ্ত ভোটারদের ভয় আর ঘৃণায় তটস্থ করে তুলতে পেরেছেন। কোনো জরিপ সংস্থা তাঁদের মনের কথা জানতে পারেনি। তাঁরাও কারও কাছে মনের কথা প্রকাশ করেননি।
মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক উমায়ের হকের ভাষায় তাঁদের বলা যায় ‘গোপন ঘৃণাবাদী ভোটার’ বা ‘সিক্রেট হেইট ভোট’। এরা কারা? আমাদের দেশে কেন, সব দেশেই তাঁরা আছেন। তাঁরা একদিকে ভীত, আরেক দিকে উত্তেজিত। সর্বদাই তাঁরা শত্রু খুঁজে চলেন। তাঁরা ভীত জীবন-জীবিকার সংকটে, তাঁরা ভীত অতীতের মতো নিশ্চয়তা হারানোর ভয়ে। জাত গেলে গেল, ধর্ম গেল গেল, দেশ গেল গেল—এই হলো তাঁদের ভয়। এই ভয়ের জন্য তাঁরা দায়ী করেন ‘অপর’কে। এই অপর হলো ‘তারা’, যারা ‘আমাদের মতো নয়’। জাতীয় সংখ্যালঘু, বিদেশি, ভিনধর্মী, ভিনজাতি কিংবা ভিন্ন জীবনধারার মানুষকে তাঁরা ঘৃণা করেন। সাধারণত তাঁরা সামাজিক কিংবা মানসিক দিক থেকে দুর্বল অবস্থানে থাকেন। ব্যক্তিত্বের জোরও কম। কিন্তু জনতার সম্মিলিত ভবিষ্যতে তাঁদের আস্থা নেই। তাঁরা মতামত গোপন করে চলায় অভ্যস্ত। সমাজ-বন্ধুবান্ধব কিংবা আইনের চাপে তাঁরা অনেক কিছু মুখে মেনে নেন বটে, কিন্তু ভোট কিংবা দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় তাঁদের আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসে। মুখে মুখে তাঁরা হয়তো গণতন্ত্র, প্রগতিশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন, কিন্তু মনের মুকুরে লালন করেন ভিন্ন কিছু।
জনতা ভয় থেকে ভোট দিলে ভুল করে। ভয় থেকে জন্ম নেয় ঘৃণা। ঘৃণা অন্ধ করে বিচারবুদ্ধি। যার মনে ভবিষ্যৎ নিয়ে কিংবা অপছন্দের মানুষ নিয়ে ভয় যত বেশি, শক্তিশালী নেতার জন্য আকাঙ্ক্ষা ও ভক্তি তার তত বেশি।
ভোট জয়ের মতো সহজ নয় রাজনীতি
ডোনাল্ড ট্রাম্প এ-জাতীয় মানুষকে নিজের পক্ষে টানতে পেরেছেন। জরিপকারী কিংবা সাংবাদিকেরা তাঁদের মনের খবর জানতে পারেন না; এ জন্য তাঁদের বলা হয় ‘লাজুক ভোটার’। অনেক সময় নিজেরাও তাঁরা বুঝতে পারেন না যে কতটা ভয় বা ঘৃণা মনের তলায় জমেছে। যদি মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশও তাঁদের হয়, সেটাও বিরাট সংখ্যা। ভারত বা আমেরিকার মতো বড় গণতন্ত্রে এই ৫ ভাগ ভোটার অনেক হিসাব উল্টে দিতে যে পারেন, তা তো এখন প্রমাণিত। তাঁদের মিছিল-জনসভায় দেখা যায় না, কিন্তু নির্বাচন কিংবা দাঙ্গা-হাঙ্গামার মোক্ষম সময়ে তাঁরা ভেসে ওঠেন, ঠিক যেভাবে পুকুরের ঘোলা পানিতে রয়না বা মেনি মাছ ভেসে ওঠে। ২০১৬ সালে তাঁরাই গণহারে ভেসে উঠে ট্রাম্পকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন, ২০২০-এ-ও তাঁরা ট্রাম্পকে এমন দুর্ধর্ষ করে তুলেছেন। বাস্তবতা যা-ই হোক, তাঁরা অন্ধভাবে নেতার সমর্থক। বাস্তব জীবনে যতই লাজুক ও মুখচাপা লোক তাঁরা হোন, ফেসবুকের ঘৃণার বাজারে কিংবা স্বৈরাচারী একনায়কের পক্ষে তাঁরা বিশ্বস্তভাবে কাজ করেন।
জনতা ভয় থেকে ভোট দিলে ভুল করে। ভয় থেকে জন্ম নেয় ঘৃণা। ঘৃণা অন্ধ করে বিচারবুদ্ধি। যার মনে ভবিষ্যৎ নিয়ে কিংবা অপছন্দের মানুষ নিয়ে ভয় যত বেশি, শক্তিশালী নেতার জন্য আকাঙ্ক্ষা ও ভক্তি তার তত বেশি। জার্মান সমাজ-মনোবিজ্ঞানী এরিক ফ্রম হিটলারের জার্মানি দেখেছেন। সে সময় ফ্যাসিবাদী নেতা ও তাঁর অনুসারীদের ওপর গবেষণা করে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, ‘নিজের ওপর ভরসার অভাবে স্বাধীনতার যোগ্য না হওয়ায় আমরা পরাক্রমশালী নেতার দ্বারা চালিত হতে চাই। আমরা যখন প্রকৃত স্বাধীনতা সহ্য করতে পারি না, তখনই আমরা অধীন হওয়ার পথে যাই। আমাদের বাসনা থেকেই জন্ম নেয় দুঃশাসনের।’
আমি নিজে চুরি করতে চাই। কিন্তু নিজের ওপর আমার কোনো আস্থা নেই। আমার চাই বড় ভাই, আমি হব তার সহমত ভাই। আমার অক্ষমতার ক্ষমতা তিনি, আমার দুর্নীতির পাহারাদার তিনি। লালন ক্ষমতার দারুণ এক সংজ্ঞা দিয়ে রেখেছেন, ‘তোমার ক্ষমতায় আমি, যা ইচ্ছা তাই করো তুমি’। অর্থাৎ আমি অক্ষম বলেই তুমি সক্ষম তা নও, আমি অধমভাবে তোমার ক্ষমতা হয়ে উঠতে চাই, যাতে তুমি আমাকে দিয়ে ক্ষমতাবান হতে পারো। এই অন্ধভক্তি থেকেই জন্ম স্বৈরাচারী ক্ষমতার এবং তার প্রতি ভয়ের। তখন সেই ভয়ের খপ্পরে পড়ে আমরা স্বাধীনতা চাই না, অধিকার চাই না; আমরা চেয়ে বসি এমন কাউকে, যে আমাদের বশ করবে। আর আমরা হব তার ক্ষমতায় ক্ষমতায়িত প্রজা। আমরা যেমন, তেমন নেতাই পাই।
রাজনীতিকে কঠিন করে গেলেন ট্রাম্প
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট না থাকলেও আমেরিকার রাজনীতিতে শক্তিশালীভাবে আরও কিছুকাল থেকে যাবেন। এমনকি তিনি না থাকলেও তাঁর দ্বারা সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ বর্ণবাদী ঘৃণাবাদী নাগরিকেরা থাকবে। তাই থাকবে সমাজটাকে ভাগ করার রাজনীতি। দুনিয়ার সুশীল কিংবা শুভবাদী মানুষেরা আর এই গোপন ঘৃণার জগতের মানুষদের কখনো দেখা হয় না। কিন্তু তাঁরা আছেন, তাঁরা ট্রাম্প বা মোদির মতো নেতাদের টিকিয়েও রাখেন। আর এ ধরনের নেতারা রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে কঠিন করে তোলেন মিথ্যা দিয়ে, ঘৃণা দিয়ে, বিভক্তি দিয়ে, দম্ভ দিয়ে। ট্রাম্প একটা মডেল, এই মডেল অনেক নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত শাসকেরা অনুসরণ করে যাচ্ছেন।
আগেকার যুগের রাজনীতিবিদেরা জনমানুষের জীবনে কর্মসূচি দিয়ে রাজনীতি করতেন। ট্রাম্পের মতো ঘৃণাবাদীরা দুনিয়াজুড়ে তাদের জন্য রাজনীতিকে কঠিন করে তুললেন। কালোটাকা, ‘অপরের’ প্রতি বিদ্বেষ, যৌনবাদ ও বর্ণবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ আর বলপ্রয়োগের কার্ড যাদের হাতে, তাদের মোকাবিলার জন্য দুনিয়াকে নতুন করে ভাবতে হবে। বাইডেন ভোটজয় করলেও শক্তিশালী ট্রাম্পপক্ষের বাধায় রাজনীতি করা তাঁর জন্যও কঠিনই হবে।
ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।