ওয়াশিংটন ডিসিতে যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেল, তাতে যিনি আকাশ থেকে পড়ার মতো অবাক হয়েছেন, তিনি নিশ্চয়ই গত চার বছরের যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতির খোঁজ রাখেননি। অবশ্য এ কথা ঠিক, ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলের যেসব দৃশ্য চারপাশে এখনো ঘুরছে, তা এককথায় ভয়ানক। এসব ছবিতে দেখা যাচ্ছে হিংস্র দানবের মতো জ্বলজ্বলে চোখের কিছু মানুষ নব্য নাৎসি পতাকা আর ট্রাম্পের সমর্থনে লেখা ব্যানার হাতে প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট কার্যালয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। উন্মত্ত লোকেরা চিৎকার করে ‘যুক্তরাষ্ট্র’ এবং ‘চুরি থামাও’ বলে স্লোগান দিচ্ছেন। অন্যরা নানান ভঙ্গিতে সেলফি তুলছেন, যাতে ভবিষ্যতে ছবিগুলো তাঁদের নাতি–নাতনিদের গর্বভরে দেখাতে পারেন।
তবে সবচেয়ে জঘন্য দৃশ্য যেটি ছিল, সেটি হলো ট্রাম্প নিজেই তাঁর উন্মত্ত সমর্থকদের ক্যাপিটলের দিকে যাওয়ার এবং নির্বাচনের ফল বাতিলে ‘শয়তানি শক্তির’ বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানাচ্ছিলেন।
এ দৃশ্য সবাইকে ধাক্কা দেওয়ার মতো কিন্তু অবাক করার মতো নয়। যাঁরা ২০১৬ সাল থেকে ট্রাম্পের আচরণ দেখে আসছেন, তাঁরা এতে মোটেও অবাক হননি। দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিতর্কে ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আসন্ন নির্বাচনের ফল যা-ই হোক না কেন তা তিনি মেনে নেবেন কি না। জবাবে তিনি বলেছিলেন, তিনি ফল মানবেন কি না, তা ফল কী হবে তার ওপর নির্ভর করছে। তখন বোঝা গিয়েছিল তিনি উদার গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি মানবেন না।
শুধু তাই নয়, তিনি মুক্ত গণমাধ্যমকে ওই সময় ‘জনগণের শত্রু’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনকে ‘জেলে পুরে রাখা উচিত’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন। অভিবাসীদের তিনি ‘ধর্ষণকারী’ ও ‘মাদক কারবারি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর হামলা করা গোষ্ঠীকে প্রকাশ্যে প্রশংসা করেছিলেন।
ট্রাম্পকে রিপাবলিকান পার্টির যে নেতারা নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছেন এবং ট্রাম্পের একগুঁয়ে ও স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডকে চাটুকারের মতো প্রশংসা করেছেন, ক্যাপিটলে হামলার দায় থেকে তাঁরাও মুক্তি পেতে পারেন না। এই নেতারা যে ট্রাম্পকে ভালোবেসে তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন, তা মনে করার কারণ নেই। ট্রাম্প উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে অনেক বেআইনি কাজের অনুমোদন দিয়েছেন। অতি ধনীদের ট্যাক্স কমিয়ে দিয়েছেন। চরম ডানপন্থীদের বিচারপতি হিসেবে ত্বরিতগতিতে নিয়োগ দিয়েছেন। এসব কারণে অতিরক্ষণশীলেরা ট্রাম্পকে তাঁদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রধান হাতিয়ার মনে করে থাকেন।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, কোনো আদর্শ তার নেতার ক্ষমতাচ্যুতিতে শেষ হয়ে যায় কি না। অর্থাৎ, ট্রাম্পকে ছাড়া কি ট্রাম্পিজম বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে?
অনেক রিপাবলিকান নেতা মনে করেন, ট্রাম্প ‘গতানুগতিক রাজনীতিক’ নন। তাঁদের এ ধারণা খুবই সঠিক। আদতেই ট্রাম্প প্রচলিত ধারার কোনো রাজনীতিক নন। তিনি অনেকটা ধর্মীয় নেতার মতো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নিজ সমর্থকদের উন্মত্ত করে তোলার এক অভাবনীয় ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। তিনি তাঁর একনিষ্ঠ সমর্থকদের কাছে সেই ধরনের একজন ‘মসিহ’ বা ‘ত্রাতা’ হিসেবে বিবেচিত, যিনি উদারপন্থী অভিজাত, কৃষ্ণাঙ্গ, সমকামী ও অভিবাসীদের হাত থেকে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদকে রক্ষা করতে পারেন।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, কোনো আদর্শ তার নেতার ক্ষমতাচ্যুতিতে শেষ হয়ে যায় কি না। অর্থাৎ, ট্রাম্পকে ছাড়া কি ট্রাম্পিজম বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে? গদিচ্যুত হওয়ার পরও রিপাবলিকান পার্টিতে তাঁর অনেক ভক্ত থাকবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জোরে তিনি তাঁর প্রভাবকে ধরে রাখতে চাইবেন। তিনি হয়তো ছোট পরিসরে হলেও নিজের একটি সংবাদমাধ্যম তৈরি করবেন। কিন্তু তা দিয়ে কি তিনি শেষমেশ টিকে থাকতে পারবেন?
আমার মনে হয় সিনেটর টেড ক্রুজের মতো কট্টর কোনো নেতার মধ্য দিয়ে ট্রাম্পিজম আরও কিছুদিন টিকে থাকবে। তবে ট্রাম্পের মধ্যে যে ‘অশ্লীল ক্যারিশমা’ আছে, টেড ক্রুজের মধ্যে তার ঘাটতি আছে। ক্রুজ অতি উচ্চশিক্ষিত কুটিল মানুষ এবং দয়ামায়াহীন রাজনীতিক, কিন্তু মানুষকে উন্মত্ত করে তোলার বিষয়ে ট্রাম্পের যে অভাবনীয় ক্ষমতা আছে, টেড ক্রুজের তা নেই।
ট্রাম্প দৃশ্যপট থেকে সরে গেলে তাঁর সমর্থকদের মধ্যে বিদ্যমান চাঞ্চল্য আর থাকবে না। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার যেভাবে বেড়েছে এবং অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা শুরু হয়েছে তার জন্য যে ট্রাম্পই মূল দায়ী, সে বিষয়টি তিনি গদি ছাড়ার পর অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে। গণমাধ্যমে তাঁর অনুপস্থিতি ট্রাম্পিজমের উজ্জ্বলতাকে দ্রুত ফিকে করে ফেলবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ইয়ান বুরুমা ডাচ বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ও গবেষক