ট্রাম্প ও আমেরিকার বর্ণবাদী মন
ডোনাল্ড ট্রাম্প কি একজন বর্ণবাদী? দেড় বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এই প্রশ্নে বিতর্ক করছে। ট্রাম্প নিজে নানাভাবে এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টকে তিনি বিদেশি বলে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছেন। মেক্সিকানদের ঢালাওভাবে বলেছেন ধর্ষক, আফ্রিকান-আমেরিকানদের বলেছেন অলস ও খুনে, সন্ত্রাসবাদী—এই কারণে মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে আসা নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেছেন, এমনকি কু ক্ল্যাক্স ক্ল্যানের মতো শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মধ্যে ভালো মানুষ খুঁজে পেয়েছেন। তারপরও তাঁকে কেউ সরাসরি বর্ণবাদী বলেনি, তাঁর এই মনোভাবকে রাজনৈতিক রণকৌশল ভেবে তার ব্যাখ্যা করেছে।
সব বদলে গেল গত বৃহস্পতিবার। এদিন হোয়াইট হাউসে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক সিনেটরদের সঙ্গে অভিবাসন প্রশ্নে আলোচনার সময় হাইতি ও আফ্রিকার দেশগুলোকে ‘জঘন্য’ (তাঁর ভাষায় ‘শিট হোল’) দেশ বলে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘এসব দেশ থেকে আমাদের লোক নিতে হবে কেন? তার চেয়ে আমরা নরওয়ের মতো দেশ থেকে লোক নিই না কেন?’
ট্রাম্পের কথা থেকে স্পষ্ট, তিনি আফ্রিকা বা হাইতি থেকে কাউকে চান না। কারণ, তারা কালো ও দরিদ্র। তিনি নরওয়ের লোকদের স্বাগত জানাবেন, কারণ তারা সাদা ও সচ্ছল। কোনো সন্দেহ থাকল না, শুধু গায়ের রং ও অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে তিনি তাঁর অভিবাসন নীতিনির্ধারণ করতে চান। এটি যদি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি হতো, তাহলে হয়তো আমরা অগ্রাহ্য করতে পারতাম। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ট্রাম্প তাঁর জাতীয় অভিবাসন নীতি নির্মাণ করতে যাচ্ছেন, উদ্বেগটা সে কারণেই। জেমস বলডুইন বলেছিলেন, বর্ণবাদ হলো একদিকে দৃষ্টিভঙ্গি, অন্যদিকে ক্ষমতার ব্যবহার। সন্দেহ নেই, এই মানদণ্ডে মার্কিন প্রেসিডেন্ট একজন বর্ণবাদী।
যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ নিজেদের দেশকে আধুনিক গণতন্ত্রের সেরা উদাহরণ হিসেবে দাবি করে থাকে, এই দেশকে ‘পর্বতচূড়ায় প্রতিশ্রুত উজ্জ্বল গৃহ’ বিবেচনা করে। আর এই দেশের প্রেসিডেন্ট, নিউইয়র্কার পত্রিকার রবিনরাইটের ভাষায়, তাঁর ‘শুধু এক শব্দ ব্যবহারের ভেতর দিয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে নিজের সব সম্মান, সব মর্যাদা হারালেন।’
খবরটি প্রচারিত হওয়ার ১৫ ঘণ্টা পর ট্রাম্প বললেন, অভিবাসন নিয়ে আলোচনার সময় তিনি ‘শক্ত ভাষা’ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু ঠিক এ কথা বলেননি। অন্যদিকে সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন ডেমোক্রেটিক সিনেটর ও একজন রিপাবলিকান সিনেটর বলেন, ট্রাম্প একবার নন, কয়েকবার ‘শিট হোল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তাঁর মুখের ওপরেই সিনেটর লিন্ডসি গ্রাহাম প্রতিবাদ করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস এক বিশেষ সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেছে, অস্বীকার করলে কী হবে, ট্রাম্প অবশ্যই সে কথা বলেছেন। ‘ভুলে যাবেন না, ট্রাম্প শুধু একজন বর্ণবাদী, মূর্খ, অযোগ্য ও মর্যাদাহীন ব্যক্তি নন। তিনি একজন মিথ্যাবাদীও।’
বস্তুত, ট্রাম্প কোনো রকম ভাবনাচিন্তা ছাড়াই এমন ঢালাও মন্তব্য করেছেন, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। তিনি বর্ণবাদী রণকৌশল ব্যবহার করেই গত নির্বাচনে সব হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই বর্ণবাদ এখনো তাঁর তুরুপের তাস, অন্ততপক্ষে তাঁর নিজের অনুগত সমর্থকদের মধ্যে। এটা গোপন ব্যাপার নয় যে একদিকে মন্দাবস্থা, অন্যদিকে অব্যাহত অভিবাসনের কারণে মার্কিন নির্বাচকদের একটি অংশ প্রবল অভিবাসীবিরোধী হয়ে পড়েছে। এরা নিজেরাও এ দেশে এসেছে অভিবাসী হিসেবে, অধিকাংশই সেই সময়ের দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত দেশ থেকে। কিন্তু তাদের গায়ের রং সাদা। ফলে সাদা অভিবাসীদের নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই, আপত্তি শুধু সেসব অভিবাসীকে নিয়ে, যাদের গায়ের রং কালো অথবা পীত। আমেরিকার এই বর্ণবাদী মনটি অন্য সবার চেয়ে সবচেয়ে ভালোভাবে নিজের রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহারে সক্ষম হয়েছিলেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের বক্তব্য নিয়ে এই দেশের ভেতরে ও বাইরে তীব্র সমালোচনা হয়েছে। অথচ সত্যি কথা হচ্ছে তাঁর সমর্থক হিসেবে পরিচিতদের কাছে তাঁর কথা যথার্থ বলেই মনে হয়েছে। ফক্স নিউজের উপস্থাপক টাকার কার্লসন বলেছেন, মার্কিনরা মনে মনে যা ভাবে, প্রেসিডেন্ট শুধু মুখে সে কথা বলেছেন। এতে আপত্তির কী আছে? সাবেক রিপাবলিকান স্পিকার ন্যুট গিনগ্রিচ বলেছেন, ট্রাম্প যা বলেছেন, তাতে তাঁর সমর্থকদের ক্ষিপ্ত হওয়ার কিছু নেই, ঠিকই তো বলেছেন। আইওয়ার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান স্টিভ কিং টুইটারে মন্তব্য করেছেন, ‘ভীত হবেন না, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনি ঠিক কাজই করেছেন।’
অন্যদিকে অধিকাংশ ডেমোক্রেটিক এবং হাতে গোনা কয়েকজন রিপাবলিকান সিনেট ও কংগ্রেস সদস্য ট্রাম্পের বক্তব্যের নিন্দা করে বলেছেন, এই কথায় যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধের প্রতিফলন নেই। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় ধর্ম, বর্ণ ও আর্থিক অবস্থানির্বিশেষে অভিবাসীদের আশ্রয় দিয়েছে। ট্রাম্পের নিজের পরিবারও মাত্র তিন প্রজন্ম আগে এ দেশে এসেছে। রিপাবলিকান সিনেটর পল রায়ান স্বীকার করেছেন, শ–খানেক বছর আগে তাঁর হতদরিদ্র পরিবারও আয়ারল্যান্ড থেকে এসেছিল।
অভিবাসীদের অধিকাংশই প্রান্তবর্তী শ্রেণির মানুষ, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন। সে কারণে তাদের কণ্ঠস্বর সর্বদা শ্রুত হয় না। একশ্রেণির রাজনীতিক ও তথ্যমাধ্যমের কারণে মার্কিন অর্থনীতি ও সমাজে তাদের অবদান অজ্ঞাত রয়ে গেছে। সাদা মানুষের চোখে এরা সবাই অপরাধী, অলস, কাজ না করে সরকারি ভাতা খায়। অথচ প্রকৃত সত্য হলো আমেরিকার অর্থনীতির একটি প্রধান চালিকাশক্তি এই সব অভিবাসী। আমেরিকান একাডেমি অব সায়েন্সের হিসাব অনুসারে, একজন গড়পড়তা মার্কিন অভিবাসী তাঁর জীবদ্দশায় সরকারের কাছ থেকে যে পরিমাণ আর্থিক বা অন্যান্য সাহায্য পেয়ে থাকেন, তার চেয়ে কমপক্ষে ৮০ হাজার ডলার বেশি তাঁরা কর হিসেবে সরকারের কাছে ফেরত দিয়ে থাকেন। কলেজ ডিগ্রি আছে এমন অভিবাসীর ফেরত দেওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় দুই লাখ ডলার।
অভিবাসীরা মার্কিন অর্থনীতি কীভাবে সচল রেখেছেন, ক্যালিফোর্নিয়ার আপেল বা আঙুর বাগানের শ্রমিকদের দিকে তাকালেই সে কথা বোঝা যায়। একই কথা সিলিকন ভ্যালির নয়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। ক্যাটো ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিদেশিদের আসা বন্ধ করে দিলে সিলিকন ভ্যালির আইটি খাত লাটে উঠবে। ট্রাম্প বিশেষ আপত্তি করেছিলেন আফ্রিকা থেকে অভিবাসী আগমনের ব্যাপারে, কারণ তারা সব দরিদ্র ও অশিক্ষিত। অন্য এক বৈঠকে নাইজেরীয়দের বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন, সে দেশের মানুষ সব পর্ণ কুটিরে থাকে। তিনি শুনে হয়তো বিস্মিত হবেন, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত নাইজেরীয়দের ১৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে, আর ৮ শতাংশের রয়েছে ডক্টরেট। সে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেত জনসংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশের রয়েছে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, মাত্র ১ শতাংশের রয়েছে পিএইচডি।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক রাউলহিনোহোসা-ওজেদা হিসাব করে দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে এই মুহূর্তে যে সোয়া কোটি অবৈধ অভিবাসী রয়েছেন, তাঁদের যদি বৈধতা দেওয়া হয়, তাহলে আগামী ১০ বছরে মার্কিন অর্থনীতিতে প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলার যুক্ত হবে। সেই উদাহরণ দিয়ে সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেস লিখেছে, ‘ইমিগ্রান্টস আর মেকার্স, নট টেকার্স।’ অভিবাসীরা শুধু নেয় না, ফিরিয়েও দেয়।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।