২০০৬ সালে বাংলাদেশে একটি বড় আইনি পরিবর্তন ঘটে। এতে ২০০১ সালের টেলিকমিউনিকেশন আইনকে সংশোধন করে নাগরিকদের টেলিফোন রেকর্ড করার অবাধ ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়। যেমন: ৯৭ক ধারার ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা’র স্বার্থে সরকার গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে যেকোনো টেলিযোগাযোগ রেকর্ড করার ক্ষমতা দিতে পারবে বলা হয়। এ কাজে টেলিযোগাযোগ সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (যেমন গ্রামীণফোন বা রবি) সহায়তা না করলে ৯৭গ ধারায় তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
নাগরিকদের যোগাযোগ রক্ষায় গোপনীয়তাবিরোধী এই আইনের বিরুদ্ধে নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী সেই বছরই হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। আদালত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনটি কেন সংবিধানবিরোধী নয়, তা ব্যাখ্যা করার জন্য রুল জারি করেন। আজ পর্যন্ত এই মামলার আর কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
এ মামলায় বাদীরা আশঙ্কা করেছিলেন যে সামরিক সরকার আমলের মতো এভাবে টেলিফোন রেকর্ডের সুযোগ থাকলে তার অপব্যবহার হবে এবং এতে নাগরিকদের বাক্স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে।
তাঁরা যা আশঙ্কা করেছিলেন, অবস্থা এখন তার চেয়েও গুরুতর আকার ধারণ করছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বা আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পর্কহীন টেলিফোন সংলাপ এখন শুধু রেকর্ড করা নয়, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বিরোধী রাজনীতিবিদদের গোপনে ধারণকৃত টেলিফোন আলাপ দেশের কয়েকটি টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার করা হচ্ছে বীরদর্পে।
দেশের সংবিধান ও আইনবিরোধী এসব কাণ্ড একের পর এক ঘটে যাওয়ার পরও এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। আইন ভঙ্গ হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের, স্বতঃপ্রণোদিতভাবে হলেও এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে উচ্চ আদালত, সংসদীয় কমিটি ও মানবাধিকার কমিশনের। কিন্তু তারপরও ফোন রেকর্ড আর তা টেলিভিশন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কোথাও। বরং এভাবে প্রচারিত তথ্যের ভিত্তিতে ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে মামলা সাজানোর ঘটনা ঘটেছে কিছু ক্ষেত্রে।
অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে মুক্তভাবে মতপ্রকাশ করা দূরের কথা, সাধারণ কথাবার্তা বলার সাহসই হারিয়ে ফেলছে বহু মানুষ।
২.
পৃথিবীর শতাধিক দেশে ডেটা প্রোটেকশন বা প্রাইভেসি আইনে নাগরিকদের ব্যক্তিগত যোগাযোগে গোপনীয়তার অধিকারকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। তথ্য অধিকার ও ডেটা প্রোটেকশন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো। তথ্য অধিকার শাসনকাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও স্বেচ্ছাচারিতা রোধে নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকারের কথা বলে। অন্যদিকে, ডেটা প্রোটেকশন প্রধানত সরকারের অবাধ ক্ষমতার থাবা থেকে নাগরিকের নিজেদের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার কথা বলে। এই আইনের মূল কথা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার শক্ত কারণ ছাড়া কোনোভাবেই সরকার নাগরিকের টেলিফোন, চিঠিপত্র ও ডিজিটাল মাধ্যমে আড়ি পেতে তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ ও ব্যবহার করতে পারবে না। নাগরিকদের এই গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ১৯৬৬ সালের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তিতে স্বীকৃত, এই চুক্তির পক্ষরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এটি পালন করার।
আমাদের সংবিধানে এটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে বলা হয়েছে। তবে এই অধিকারের ওপর রাষ্ট্র নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করতে পারবে বলা হয়েছে।
টেলিকমিউনিকেশন আইনের ২০০৬ সালের সংশোধনীতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার অজুহাত দেখিয়েই টেলিযোগাযোগ রেকর্ড করার অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই ক্ষমতা কখনো অনিয়ন্ত্রিত বা অবাধ হতে পারে না। ১৯৯৬ সালে পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, নাগরিকদের টেলিফোন টেপিং শুধু বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ওপর গুরুতর বিপদ (পাবলিক ইমার্জেন্সি) এড়ানোর প্রয়োজন হলে করা যাবে, টেলিফোন টেপিংয়ের আদেশ কেবল কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিবের আদেশে বা বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁর দ্বারা ক্ষমতায়িত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশে করা যাবে এবং এই আদেশ রিভিউ কমিটি বাতিল করতে পারবে।
২০১৭ সালে বিচারপতি পুত্তাস্বামী বনাম ভারত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট গোপনীয়তার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে বর্ণনা করেন এবং বলেন যে এ অধিকারের ওপর আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে তা যুক্তিসংগত, জনস্বার্থমূলক ও পরিমিত হতে হবে এবং তা কোনোভাবেই যেন সরকারের স্বেচ্ছাচারের অস্ত্রে পরিণত না হয়। এই রায়ের আলোকে প্রণীত পারসোনাল ডেটা প্রোটেকশন-সংক্রান্ত একটি খসড়া আইন বর্তমানে ভারতের যৌথ পার্লামেন্টারি কমিটির পরীক্ষাধীন রয়েছে।
আমাদের দেশে ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট রাষ্ট্র বনাম অলি মামলায় হাইকোর্টের একটি রায়ে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, ‘এটি আমাদের সাধারণ (কমন) অভিজ্ঞতা যে বর্তমানে অডিও ও ভিডিওসহ নাগরিকদের মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ফাঁস ও প্রকাশ করে দেওয়া হয়।’ আদালত আরও বলেন যে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি অথরিটি ও টেলিফোন কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব রয়েছে এ-সংক্রান্ত নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার মেনে চলার এবং তারা সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আইন মোতাবেক ছাড়া তাদের গ্রাহকের কোনো তথ্য কাউকে দিতে পারে না।
আদালতের এ রায়ে অবশ্য টেলিযোগাযোগ ফাঁসের দায়দায়িত্ব নিয়ে আলোকপাত করা হয়নি, টেলিকমিউনিকেশন আইনের ৯৭ক ধারার বৈধতা নিয়েও আলোচনা করা হয়নি। এই রায়ের পর বরং বহুবার টেলিযোগাযোগ রেকর্ড শুধু নয়, তা ফাঁস করার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কখনো কখনো নাগরিকের নিজের দ্বারা সংঘটিত হতে পারে (যেমন ব্ল্যাকমেল বা শত্রুতামূলক ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে)। কিন্তু বিএনপির নেতারা বা মাহমুদুর রহমান মান্না বা নুরুল হক বা তাঁদের রাজনৈতিক অনুসারীরা নিজে নিজের বিপদ ঘটানোর জন্য টেলিফোন সংলাপ রেকর্ড করে তা ফাঁস করে দিয়েছেন, তা ভাবার কোনো যুক্তি নেই।
৩.
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতের মানুষের টেলিফোন রেকর্ড ও তা ফাঁস করার সবচেয়ে বেশি সুযোগ ও সক্ষমতা রয়েছে টেলিসেবাদানকারীদের বা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। কিন্তু এসব ফাঁস করার কোনো অধিকার তাদের বা এসব প্রচার করার কোনো অধিকার টেলিভিশন চ্যানেল, কোনো সংবাদমাধ্যম বা অন্য কারোরই নেই। আইসিটি ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে এসব বড় ধরনের ফৌজদারি অপরাধ। এসব আইনে মতপ্রকাশ-সংক্রান্ত বিষয়গুলোয় মামলা করতে সরকারকে যেমন তৎপর দেখা যায়, নাগরিকদের টেলিফোন যোগাযোগ রেকর্ড ও ফাঁস রোধে সরকারের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না।
সরকার উদ্যোগী হলে অন্তত ফাঁস করা টেলিফোন সংলাপ যেসব টিভি চ্যানেল জেনেবুঝে প্রচার করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে পারত, কারা তাদের এসব সরবরাহ করেছে, তা তাদের থেকে জেনে নিতে পারত। এসব করার কোনো আগ্রহ সরকারের মধ্যে দেখা যায়নি। বরং দেখা যাচ্ছে টিভি চ্যানেলে প্রচার করা টেলিফোন সংলাপগুলো সরকারের রাজনৈতিক কৌশলের সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
এ অবস্থার অবিলম্বে নিরসন প্রয়োজন। আমাদের নাগরিকদের প্রাইভেসি রক্ষার আইন প্রয়োজন। একের পর এক টেলিযোগাযোগ ফাঁস হওয়ার পরও ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকেরা কেন আদালতে যেতে ভরসা পাচ্ছেন না, এসব নিয়ে বহু নিন্দার পরও কোনো কোনো টিভি চ্যানেল বা সংবাদমাধ্যম কোন সাহসে তা প্রচার অব্যাহত রেখেছে, এসব নিয়েও ভাবা প্রয়োজন।
● আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক