মহামারি কাঁধে নিয়ে হারিয়ে গেল আরও একটি বছর। একদিকে কোভিডে মৃত্যুর মিছিল যখন চলছে, তখন অন্যদিকে একদল মানুষ এ মৃত্যুপুরীকে থামাতে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ের ব্যবধানে গত বছর আমরা সার্স-কভ-২ ভাইরাসের টিকা হাতে পেয়েছি। দগদগে প্রাণক্ষয় কমাতে সারা বিশ্ব এখন টিকানির্ভর। আর এসব টিকা গ্রহণের মধ্যেই করোনার নতুন নতুন ধরন আমাদের গবেষকদের তেতিয়ে রাখছে।
ধরনগুলো সম্পর্কে জানতে রাষ্ট্রীয় শাসকগোষ্ঠী যেমন চেয়ে থাকছে, তেমনি সাধারণ মানুষ গণমাধ্যমের ওপর নজর রাখছে। আর সে জন্য সার্স-কভ-২–কে জানতে রাষ্ট্রগুলো বিজ্ঞানের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিচ্ছে। সর্বোচ্চ ধনী রাষ্ট্রটি যদি বিলিয়ন ডলার কোভিড গবেষণায় বরাদ্দ দেয়, সেখানে আফ্রিকার ক্ষুধাপীড়িত গরিব দেশও হাজার ডলারের গবেষণা বরাদ্দ ছাড়ছে। যে কারণে অতিদ্রুত করোনার বিস্তৃতি যেমন জানা যাচ্ছে, তেমনি ধরনবিষয়ক বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য অনায়াসে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। আর সেই কাজে ল্যাবরেটরিগুলোতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন শত শত গবেষক।
অথচ আমরা কোটি কোটি টাকা নিয়ে টিকা কেনার জন্য টিকাপ্রস্তুতকারক কোম্পানির দরজায় ঘুরছি। যেকোনো মূল্যে টিকাপ্রাপ্তির গবেষণাটুকু আমলা ও রাজনীতিবিদেরা বেশ দক্ষতার সঙ্গে করার চেষ্টা করছেন।
সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী টিকাপ্রাপ্তির সেই ঝুঁকি-ঝামেলা এড়াতে দেশেই টিকা প্রস্তুতের ইনস্টিটিউট করার প্রয়াস দেখাচ্ছেন। গত মাসে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী জানান, মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ টিকা আবিষ্কার ও উৎপাদনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এ পরিস্থিতিতে টিকা নিয়ে অধিকতর গবেষণা ও উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট তৈরির ভাবনার কথা জানান তিনি (প্রথম আলো, ১৭ নভেম্বর)।
বিলম্ব হলেও টিকা প্রস্তুতের ইনস্টিটিউট করার যে ভাবনা প্রধানমন্ত্রী মাথায় এসেছে, এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। তবে এ ধন্যবাদের মাত্রা আরও একটু বাড়িয়ে দেওয়া যেত, যদি তিনি বলতেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিকা গবেষণা সম্ভব। আমরা সেখানে প্রয়োজনে মানসম্পন্ন গবেষণার সুযোগ তৈরি করব। কারণ, টিকা গবেষণার জন্য আলাদা ইনস্টিটিউটের প্রয়োজন নেই। এ দেশেই সরকারের নানা গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা টিকা নিয়ে গবেষণা করতে পারে।
মহামারির এই দুই বছরে পুরো বিশ্ব বিজ্ঞান গবেষণায় আগ্রহ দেখালেও কেবল ব্যতিক্রমের পাল্লায় রয়েছে আমাদের বাংলাদেশ। মহামারি মোকাবিলায় কৃষক থেকে শুরু করে শিল্পপতিদের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হলেও করোনার গবেষণায় বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়নি।
এখন পর্যন্ত যতগুলো টিকা বাজারে এসেছে, তার সিংহভাগের গবেষণা হয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্তর্জাতিক মানের টিকা গবেষণার ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার আগে আমাদের প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানের গবেষক। আর যদি সেই গবেষক না পাওয়া যায়, কিংবা তৈরি না করা যায়, তাহলে এসব ইনস্টিটিউট কেবল ইট-সুরকি আর নামমাত্র যন্ত্রপাতির আবাসস্থল হবে। দেখা যাবে, বায়োসেফটির জন্য যন্ত্রপাতি কিনতে একদল আমলা বিদেশ সফরে যাচ্ছেন কিংবা টিকা কীভাবে তৈরি হয়, তা দেখতে কোটি টাকার বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আবার যদি দেশেই কোনো গবেষক টিকা তৈরি করেও ফেলেন, সেই কাজের মূল্যায়ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক দপ্তরে দক্ষ কর্মকর্তা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। এর নমুনা হিসেবে দেশেই গবেষণারত একটি টিকার ট্রায়াল নিয়ে ঘটনাগুলো সামনে আসতে পারে।
মহামারির এই দুই বছরে পুরো বিশ্ব বিজ্ঞান গবেষণায় আগ্রহ দেখালেও কেবল ব্যতিক্রমের পাল্লায় রয়েছে আমাদের বাংলাদেশ। মহামারি মোকাবিলায় কৃষক থেকে শুরু করে শিল্পপতিদের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হলেও করোনার গবেষণায় বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়নি। আমরা সম্ভবত কোভিড–সংকট মোকাবিলায় গবেষক ও বিজ্ঞানীদের দরজায় কড়া না নেড়ে আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাধান খুঁজছি। আমরা মনে করছি, কোটি কোটি টাকা দিয়ে আরটি–পিসিআর কিট কিনতে সক্ষম হলেও দেশে বায়োটেক কোম্পানির মাধ্যমে এসব কিট প্রস্তুতের স্বপ্ন দেখছি না।
স্থানীয় পর্যায়ে টিকার ব্যবহার নিয়ে বিশদ গবেষণার পরিবর্তে আমরা চেয়ে থাকি প্রতিবেশী দেশগুলো কী করছে। কোনো ধরনের গবেষণা ছাড়াই আমরা মহামারির টিকা ২৪ ঘণ্টায় অনুমোদন দিয়ে ফেলেছি। আমি নিশ্চিত নই, আমরা আদৌও টিকা নিয়ে কোনো নীতিমালা তৈরি করতে পেরেছি কি না, অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, এ মহামারির শুরুতে ভ্যাকসিন-অ্যাসোসিয়েটেড ইনহান্সড রেসপিরেটরি ডিজিসেস (ভারর্ড) তৈরি করে কঠোরতার সঙ্গে মানছে। আমরা গত দুই বছরেও সেদিক থেকে এগিয়ে নিতে পারিনি।
মহামারির এ দীর্ঘ সময়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দৃশ্যত মৌলিক কোভিড গবেষণায় ধাপ দিতে পারেনি। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক জরিপভিত্তিক কিছু গবেষণা আমরা দেখতে পেলেও সেগুলো কেবল সংবাদ–সম্মেলননির্ভর স্থানীয় পত্রিকার শিরোনামে। অথচ এসব গবেষণার ফলাফল আগে প্রকাশ হবে বিজ্ঞান সাময়িকীতে। কিন্তু আমরা কেবল স্থানীয় পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশনে নিজেদের মুখখানা দেখতেই ব্যস্ত থাকছি। যারা কিছু কাজ করার চেষ্টা করছে, সেগুলোকে সহযোগিতা করার মতো মানসিকতা সরকার দেখাচ্ছে বলে মনে হয় না।
মৌলিক গবেষণা ছাড়া যে একটি দেশের প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়, সেটি কোনো সরকারই উপলব্ধি করেনি। জন্মের পঞ্চাশ বছরেও গবেষণায় পরশ্রীকাতরতা আমাদের কাটেনি। এ দেশে আড়াই শর বেশি ওষুধ কোম্পানি থাকলেও নিজেরা কখনো গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন ড্রাগ আবিষ্কারের স্বপ্ন দেখেনি।
অথচ আমাদের দেশে অনেক ভালো গবেষক রয়েছেন, যাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্রির পাশাপাশি অভিজ্ঞতার ঝুলিও বড় করেছেন। মৌলিক গবেষণা ছাড়া যে একটি দেশের প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়, সেটি কোনো সরকারই উপলব্ধি করেনি। জন্মের পঞ্চাশ বছরেও গবেষণায় পরশ্রীকাতরতা আমাদের কাটেনি, অন্যদের উন্নতি দেখেই কাতর হয়ে যাচ্ছি। এ দেশে আড়াই শর বেশি ওষুধ কোম্পানি থাকলেও নিজেরা কখনো গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন ড্রাগ আবিষ্কারের স্বপ্ন দেখেনি। অথচ এসব কোম্পানি চেয়ে আছে বিদেশি কোম্পানিগুলোর দিকে। যখন গণমাধ্যমে করোনার কোনো ড্রাগ আসার ঘোষণা আসছে, সেসব মাতৃকোম্পানির আগে আমাদের দেশের বাজারে স্থানীয় কোম্পানিগুলো সেই ওষুধ তৈরি করতে উঠেপড়ে লাগছে। ওই সব বিদেশি ওষুধ কোম্পানি কোনো ড্রাগ বাজারে আনার আগে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার গবেষণায় বরাদ্দ দিয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশের সনদে আমাদের ওষুধ কোম্পানি যেকোনো ওষুধ তৈরির এখতিয়ার রাখলেও আমরা কখনোই নিজেদের গবেষণাগারে বরাদ্দ রাখি না। অথচ কোটি কোটি টাকা আয় করে যাচ্ছে, গবেষণায় আগ্রহ নেই।
নিঃসন্দেহে এবারের মহামারি আমাদের সবার জন্য চরম শিক্ষণীয়। আমরা জানি না, কবে এ মহামারি থেকে পরিত্রাণ পাব। তবে এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের যেকোনো মহামারি বেশ সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করা যাবে, তা বলতে পারি। যেসব দেশ স্থানীয়ভাবে কোভিড নিয়ে গবেষণা করছে, তা তাদের জন্য সম্পদ। ২০০৩ সালের দিকে চীনে যে সার্স-কভ হয়েছিল, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে চীন যেমন এবার পাকাপোক্তভাবে করোনাকে মোকাবিলা করে যাচ্ছে, তেমনি ভিয়েতনামও করেছে। আর তা করতে সহায়তা করেছে তাদের অতীত গবেষণা।
আমাদের হাতে এখনো সময় আছে, আমরা বিজ্ঞান গবেষণায় আরও একটু মনোযোগী হই। আমাদের মেধা আছে, রিসোর্স আছে, শুধু গবেষণার সংস্কৃতিটা নেই। আমি মনে করি না গবেষণায় বরাদ্দ দিতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী হতে হবে। কেনিয়া বা নাইজেরিয়ার মতো দেশ কোভিড গবেষণায় যেসব প্রকাশনা বের করেছে, তা বাংলাদেশের জন্য অনুপ্রেরণার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। হাজার কোটি টাকার টিকা যখন আমরা কিনতে পারি, তাহলে হাজার কোটি টাকার ১০ বছরের জন্য গবেষণার বরাদ্দ দিলেও দেশটার চেহারা যে পাল্টে যেতে পারে, তা আমাদের শাসকগোষ্ঠীর মন ও মগজে ঠাঁই পেতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ মহামারিই শেষ মহামারি নয়। এটি চলবে, সামনে আরও বড় বড় আসবে। তবে মোকাবিলার জন্য নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র বিজ্ঞান গবেষণা সেই সক্ষমতাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে। আমার বিশ্বাস, নতুন বছরে সরকার বিজ্ঞান গবেষণায় আরও মনোযোগী হবে।
ড. নাদিম মাহমুদ জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক