প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পর প্রথম যেদিন অফিসে এলাম, দেখি গাছটা একেবারেই নেতিয়ে গেছে। খটখটে মাটির মধ্যে শীর্ণকায় দেহ জানান দিচ্ছে বিদায়ের। লকডাউনের মধ্যে ওর কথা মনে পড়েছে অনেকবার; অফিসে আমার চেয়ারের পেছনের কাপবোর্ডের ওপর থাকা কাচের বয়ামের মানিপ্লান্ট গাছটি। ছোটবেলায় ভাবতাম, এই গাছ যে বাড়িতে থাকে, তাদের অনেক টাকা আসে। টাকার গাছ ডাকতাম। বড়বেলায় সেই ভুল ভেঙেছে। তবে চোখের সামনে টাকার গাছের বিদায়টা মানতে কষ্ট হচ্ছিল।
গাছটা ঈদ-শুভেচ্ছায় পাওয়া। সপ্তাহে দু-তিন দিন অল্প করে পানি দিতাম। বেশ সবুজ, তরতাজা হয়ে উঠেছিল। সীমিত পরিসরে লম্বা লতা পাক খেয়ে নিজের জায়গা করে নিয়েছিল।
কয়েক ঘণ্টার নোটিশে গোটা প্রথম আলো হোম অফিসে চলে গিয়েছিল। সে এক সময়। তবু লকডাউনের সময় একবার জরুরি প্রয়োজনে অফিসে আসা এক সহকর্মীকে অনুরোধ করে পানিও দেওয়া হয়েছিল। সে আমায় ছবি তুলে পাঠিয়ে আশ্বস্ত করে, ‘আপনার গাছ ভালো আছে।’ কিন্তু আজ তার চলে যাওয়ার দিন।
এমনিতেই লকডাউনের পর প্রথম অফিস, নতুন স্বাভাবিকতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। ঝাড়পোছ করা চলছে। এটা মোছো তো ওটা স্প্রে করো, বনের বাঘকে তাড়াও তো মনের বাঘ তেড়ে আসে। ঠিক তেমনি সময় আমাকে সাহায্য করছিলেন যে সহকর্মী, তিনি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, এখনো প্রাণ আছে, বাঁচবে গাছটা।
পানি পড়ল গোড়ায়। কী আশ্চর্য! এমন কেন মনে হচ্ছে যে এই গাছের বেঁচে ওঠার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িয়ে? নাকি দীর্ঘদিন করোনা–নির্বাসনে সব আশা গেছে হারিয়ে? অফিসের জরুরি বৈঠক। তারই ফাঁকে তাকিয়ে দেখি, কয়েক ঘণ্টায় সে অনেকটাই সতেজ। যে সহকর্মী আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলেন, বাঁচবে গাছটা, তাঁর প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম।
হঠাৎ ও হেনরির সেই ‘দ্য লাস্ট লিফ’ গল্পের কথা মনে হলো। অসুস্থ ছোট্ট মেয়েটি জানালা দিয়ে যে গাছ দেখে, তার শেষ পাতাটা ঝরে গেলে তার জীবনও ঝরে যাবে, এই বিশ্বাস তাকে পেয়ে বসে। ধীরে ধীরে সে নেতিয়ে পড়ছে। চিকিৎসকও আশা পান না। কিন্তু শীতের রাতের প্রচণ্ড ঝড়ের পরও দিনের আলোয় জানালা দিয়ে গাছের শেষ পাতাটা দেখে মেয়েটি। বেঁচে ওঠে আবার।
তবে কিনা সেই পাতা ছিল একজন শিল্পীর আঁকা মাস্টারপিস।
যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যে বেশ কবছর আগে (১৯ এপ্রিল ১৯৯৫) সন্ত্রাসী হামলায় বিধ্বস্ত হয় সরকারি ভবন। সকালবেলার নরম আলোয় নিহত হয় ১৬৮ জন নিরপরাধ মানুষ, আহত আরও ৬৮০ জন। এলাকাজুড়ে প্রায় ৩২৪টি ভবন হয় বিধ্বস্ত হয়, নয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি অফিসের ডে কেয়ার সেন্টারে থাকা ছোট্ট শিশুরাও বাদ যায়নি হামলা থেকে। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে ঘটনাস্থলের পাশেই নির্মাণ করা হয় স্মৃতি–উদ্যান। বড় বড় চেয়ারসম কাঠামোর পাশাপাশি নিহত শিশুদের জন্য নির্মিত ছোট চেয়ারগুলোর দৃশ্য বুকে এসে বেঁধে। পুরো এলাকাই ছিল ধ্বংসস্তূপ। আশ্চর্যভাবে সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একমাথা সবুজ ডালপালা নিয়ে বেঁচে ছিল একটিমাত্র গাছ। সেই থেকে গাছটি যুক্তরাষ্ট্রবাসীর কাছে খেতাব পায় ট্রি অব হোপ নামে। আশা–জাগানিয়া গাছ নামে। ওখানে ওরা গাছটাকে ‘সারভাইবার ট্রি’ও বলে।
অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে লড়াই করছে সারা বিশ্ব। হাতি–ঘোড়া গেল তল, ফড়িং বলে কত জল? সারা পৃথিবীর তাবৎ চিকিৎসক ও গবেষক মিলে যেখানে আশার খবর দিতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে সাধারণ ব্যক্তিমানুষ তো খড়কুটো আঁকড়ে ধরবেই। ক্ষণিকের আশাই তার চালিকা শক্তি। মানিপ্লান্টের সঙ্গে টাকার কোনো সম্পর্ক নেই। পাতার আকারের সঙ্গে কয়েনের মিল থেকেই বোধকরি এই নাম। তবে টাকার গাছটা যে মরেনি, তাতেই নিজেকে বড় সম্পদশালী মনে হচ্ছে!
সুমনা শারমিন: প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক।