চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিয়ে সরকার বা সরকারপ্রধানের আন্তরিকতা নিয়ে সংশয় নেই। ২০০৮ সালের লালদীঘি ময়দানে এক নির্বাচনী জনসভায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব আমি নিজ কাঁধে তুলে নিলাম।’ নির্বাচিত হয়ে তিনি সেই প্রতিশ্রুতি বিস্মৃত হয়েছেন এমন মনে করার কোনো কারণ দেখেন না চট্টগ্রামবাসী। কেননা, এই নগরের একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হাজারো কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে তাঁর সরকার। কিন্তু এত কিছুর পরও উন্নয়নের সুফল ভোগ তো দূরের কথা, নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এখন যানজট, ভাঙা রাস্তাঘাট, জলাবদ্ধতা প্রভৃতি সমস্যায় দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এর কারণ ও প্রতিকারের নানা পথ যখন বাতলাচ্ছেন নগর বিশেষজ্ঞরা, তখন নতুন করে কথা উঠছে সেবা সংস্থাগুলোর দায়দায়িত্বের সীমা ও পরিধি নিয়ে। যেমন জলাবদ্ধতা বিষয়ে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি চসিকের একার কাজ না।’
মেয়রের এই বক্তব্যের মধ্যে কোথাও যেন তাঁর অসহায়ত্ব ও হতাশার সুর শোনা যায়। জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজটি চসিকের ‘একার’ নয়, এ কথা তো আমরা জানি, কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), ওয়াসা ও বন্দর প্রভৃতি সেবা সংস্থা একই উদ্দেশ্যে যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তা সমন্বয়ের দায়িত্ব কার?
‘চসিকের একার কাজ না’ কিংবা ‘জলাবদ্ধতা নিরসন চসিকের দায়িত্ব না, যেহেতু নগরবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাই উদ্যোগ নিয়েছি...’ প্রভৃতি বক্তব্য মেনে নিতে হলে এ প্রশ্ন তো উঠবেই তাহলে নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কেন? অবশ্য এই প্রতিশ্রুতি শুধু বর্তমান মেয়র দিয়েছেন তা নয়, তাঁর আগের নির্বাচিত মেয়ররাও একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং শতকোটি টাকা ব্যয়ও করেছেন। কিন্তু এতে ফল যে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি, এবারের ভয়াবহ জলাবদ্ধতা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
মেয়র পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে মেয়র নির্বাচিত হয়েই বৈঠক আহ্বান করেছি। একাধিক বৈঠকের পর সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে সম্মতিও জানায়। কিন্তু পরে কেউ সার্বিকভাবে সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করেনি।’ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ যে করেনি, তার কারণ সম্ভবত এই সংস্থাগুলো মেয়র বা সিটি করপোরেশনের নির্দেশনায় কাজ করার জন্য কোনো নীতিমালা দ্বারা দায়বদ্ধ নয়।
নগরবাসী যেকোনো দুর্ভোগের জন্য সিটি করপোরেশনকে দায়ী করেন। এর সংগত কারণ হচ্ছে করপোরেশনকে কর পরিশোধ করেন তাঁরা। কিন্তু অন্যান্য সেবা সংস্থার ওপর কর্তৃত্ব না থাকলে সিটি করপোরেশনের পক্ষে নগরবাসীর অভাব-অভিযোগ পূরণ করা যে অসম্ভব, তা বলাই বাহুল্য। এ কারণেই তিন-তিনবারের নির্বাচিত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি গভর্নমেন্ট বা নগর সরকারের ধারণাটি তুলে ধরেছিলেন। পরবর্তীকালে সাবেক মেয়র মনজুর আলম বা বর্তমান মেয়র নাছিরও এই দাবির পক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, সরকার কখনোই তা আমলে নেয়নি। ফলে সেবা সংস্থাগুলোর কাজেও কার্যকর কোনো সমন্বয় গড়ে ওঠেনি। এমনকি সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করার ইচ্ছাও যে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে নেই, তার প্রমাণ সম্প্রতি তিনটি সংস্থা জলাবদ্ধতা নিরসনে তিনটি পৃথক প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে সরকারের কাছে। চসিকের প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা, সিডিএর প্রকল্প ব্যয় ৫ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা এবং একই সমস্যা নিরসনে পাউবো নিয়েছে ২ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকার প্রকল্প। এদিকে কর্ণফুলী নদীর পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে সদরঘাট থেকে বাকলিয়া চর ড্রেজিংয়ের জন্য ২৬০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। এ ছাড়া মহেশ খালের মুখে একটি স্লুইসগেট স্থাপনের জন্য ৩০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও হাতে নিয়েছে সংস্থাটি।
এই মুহূর্তে নগরবাসী আক্ষরিক অর্থেই হাবুডুবু খাচ্ছেন জলাবদ্ধতার সমস্যা নিয়ে। এবারের বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই গত এপ্রিল মাস থেকে শুরু হয়ে গিয়েছিল দুর্ভোগ। তখন প্রবল বৃষ্টিতে দুই দফা ডুবেছে নগর। এরপর মে মাসের শেষ দিন থেকে জুন ও জুলাই মাসে আরও দুই দফায় অন্তত সাত-আট দিন চট্টগ্রাম শহরের একটি বড় অংশের (প্রায় ৩০ শতাংশ) মানুষ ডাঙায় বসে জলজীবনের ‘স্বাদ’ পেয়েছেন। আগ্রাবাদের মতো অভিজাত আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকার সড়কে নৌকা চলেছে। বাড়ি-ঘর, স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার তো বটেই, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরাও ছিলেন জলাতঙ্কে। কারণ, আগ্রাবাদ এলাকার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ভবনের প্রথম তলাটিও তখন তলিয়ে গেছে। এই দুর্ভোগ থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়া গেছে এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই। কেননা, এই বর্ষা মৌসুমে আরও কয়েক দফা ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়ে গেছে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, সেবা সংস্থাগুলো যে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তা সরকারি অনুমোদন পেলে দু-এক বছরের মধ্যেই জলাবদ্ধতার হাত থেকে মুক্তি পেতে পারেন নগরবাসী। কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে এসব উদ্যোগ থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল না পেলে বিভিন্ন সংস্থা পরস্পরের কাঁধে এর দায় চাপাবে কি না, সেই আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই আমাদের এই আশঙ্কা।
সমন্বয়হীনতা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে খোদ মেয়রেরই একটি চিঠিতে। ৩ জুলাই স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট সচিবদের কাছে দেওয়া এক চিঠিতে নিজের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। চিঠিতে বলা হয়, সিটি করপোরেশনের অবকাঠামোয় (রাস্তা, ড্রেন, কালভার্ট, ব্রিজ) বিভিন্ন সরকারি সংস্থা নিজস্ব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে সিটি করপোরেশনকে অবহিত করছে না। সংস্থাগুলোর সঙ্গে সিটি করপোরেশনের সমন্বয় না থাকায় তাদের চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমে জলাবদ্ধতাসহ নানা জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
মেয়রের এই উদ্বেগ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন আলামত থেকে আঁচ করা যায়, মেয়রের সঙ্গে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ঢাকার দুই মেয়রকে মন্ত্রীর পদমর্যাদা, নারায়ণগঞ্জের মেয়রকে উপমন্ত্রী, এমনকি রংপুরের মেয়রকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হলেও চট্টগ্রামের মেয়রকে এ রকম কোনো মর্যাদা না দেওয়ার ব্যাপারটি থেকেই সরকারের মনোভাব কিছুটা আঁচ করা যায়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যতটা উদারহস্ত, সে তুলনায় সিটি করপোরেশন কাঙ্ক্ষিত অর্থ বরাদ্দও পাচ্ছে না। সুতরাং জলাবদ্ধতা নিরসনের উদ্যোগটির সমন্বয়ের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হয়।
আগেই বলেছি, সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সেবা সংস্থাগুলোর বিচ্ছিন্ন তৎপরতা সুফল বয়ে আনবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারকে অর্থ বরাদ্দের আগেই ঠিক করতে হবে, জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন সংস্থার নানামুখী কাজের মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করবে কারা বা কোন সংস্থা।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।