ফিরে দেখা মূল্যায়নের অংশ। আর আত্মমূল্যায়ন সাফল্যেরও শর্ত। সরকারের বেলায়, আত্মমূল্যায়নের বেলায় নাগরিকদের মূল্যায়নকেও হিসাবে রাখা উচিত। তাতে প্রকৃত অবস্থা ও করণীয় সম্পর্কে ধারণা আরও স্বচ্ছ হয়। বিগত তিন বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর গণতন্ত্র মুখোমুখি ভূমিকায় রাখা হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে গেলে গণতন্ত্রের সঙ্গে আপস করতে হয়। এই ধারণা সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ও চিন্তাধারায় প্রতিফলিত হয়েছে। এটা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রকৃত বাস্তবতা নিরূপণ করা কঠিন হয়, যদি গণতন্ত্র তথা জবাবদিহির সংস্কৃতি দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অবস্থা আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে।
মোটাদাগে বললে, এ সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত ছিল। বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে অবস্থাকে ইতিবাচকই বলতে হয়। এই অর্থে যে জাতীয় আয় ও প্রবৃদ্ধি—দুটোই স্থিতিশীল ছিল। তবে এ সময়ে প্রবাসী আয় কমেছে। সেটা অবশ্য বৈশ্বিক মন্দার সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে দেশগুলোতে আমাদের জনশক্তি মোতায়েন ছিল, সেসব দেশে বৈশ্বিক মন্দার অভিঘাত পড়েছিল। পোশাকশিল্প খাত মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও গত বছরের শেষে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল। এ সময়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া থেকে মনে হয়েছে, শ্রমিকদের দাবিদাওয়ার ব্যাপারে অতীতের থেকে আরও কঠোর ভূমিকায় সরকার।
গত বছরের প্রধান আর্থিক কেলেঙ্কারি ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ পাচার। প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর আঘাত এল। আর্থিক খাতে, ব্যাংকিং খাতে যে অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছিল, তারই শিকার হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতেও দুর্নীতির ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। এটা এক শঙ্কাজনক অবস্থা। কারণ, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে পাওয়া যায়নি। অন্যভাবেও বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত ছিল। সুইস ব্যাংকসহ অবৈধ পথে অর্থ পাচারের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান আন্তর্জাতিকভাবেই বেশি উঁচুতে ছিল। আগের বছর থেকে পাচার বৃদ্ধির হারও ছিল বেশি। আন্তর্জাতিকভাবে তুলনামূলক দুর্নীতির মানদণ্ডে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পরই। এটা খুবই দুঃখজনক। বিভিন্ন জরিপে ৬৯ শতাংশ মানুষকে সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে বলে দেখা গেছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রীও বলেছেন, বড় বড় দুর্নীতির কারণে জাতীয় আয় ২ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে বলা দরকার, আমাদের দুর্নীতিগুলোতে বিদেশিরাও জড়িত বলে দেখা গেছে।
মোদ্দা কথা, দুর্নীতির বিষয়ে আমাদের অবস্থান অপরিবর্তিতই রয়েছে। দুর্নীতি অনিয়মের ধারা প্রায় সব ক্ষেত্রেই অব্যাহত ছিল। তবে সুলক্ষণ দেখা গেছে দুদকের নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের বেলায়। বিশেষ করে নতুন চেয়ারম্যান আসার পর গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে দুদক আগের চেয়ে সক্রিয় হওয়া শুরু করেছে। এর মধ্যে অন্তত একজন জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে মামলা ও তদন্ত হয়েছে। তাহলেও সরকারের আরও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আলোচিত দুর্নীতির বেলায় কিন্তু অনুরূপ পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং কারও কারও বেলায় মামলা প্রত্যাহার করে নেতিবাচক ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এমন ইঙ্গিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দুর্নীতি বিস্তারে সহায়ক।
সরকার বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পকে প্রাধান্য দিচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন আমাদের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু যত বেশি অর্থ বিনিয়োগ হয়, তত বেশি দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়। শুধু ওপরের স্তরেই নয়, তৃণমূল পর্যায়েও উন্নয়ন প্রকল্পে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি খরচ দেখানো মোটামুটি নিয়ম হয়ে গেছে। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে সেই ঝুঁকি বিদ্যমান বলে আমরা বলতে পারি। অভিযোগ রয়েছে, এই পদ্ধতিতে সরকারের সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ হাতিয়ে নিচ্ছেন যেমন, তেমনি তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরাও গর্হিত পথে লাভবান হয়েছেন। উন্নয়ন টেকসই হতে হলে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগ হতে হবে। সে ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক চিত্র দেখা যায়নি। চাপিয়ে দেওয়া স্থিতিশীলতার মধ্যে বিনিয়োগ আস্থা পায় না।
জবাবদিহি ছাড়াও উন্নয়ন ঝুঁকিপূর্ণ। এই সময়ে সংসদসহ জবাবদিহির প্রতিষ্ঠান ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে। এটা উদ্বেগের জায়গা। সরকারকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে এ কারণে যে জবাবদিহি সরকারের রাষ্ট্রপরিচালনায় সাফল্যের জন্যই দরকার। আমরা আশা করতে পারি না যে জবাবদিহির অভাবে সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা ও সমন্বয় দুর্বল হয়ে পড়ুক।
গত দুই বছরে জাতীয় স্তরে একধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল। এটা ছিল চাপিয়ে দেওয়া স্থিতিশীলতা। এ সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনকে সরকার একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। মোটা দাগে বিরোধী দল চাপের মুখে ছিল। দুটি ধারায় এটা ঘটেছে: ১. সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ তথা মামলা-হামলার কারণে তারা সক্রিয় হতে পারেনি। ২. তারাও যে খুব সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছে, তা মনে হয়নি। সরকার চাপ রাখায় বরং তারা নিজেদের দুর্বলতা এই বলে ঢাকার সুযোগ পাচ্ছে যে সরকারের চাপেই তারা সুবিধা করতে পারছে না।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির তো বিরোধী দলে থাকাকালে সরকারি চাপের স্বরূপ জানার কথা। কিন্তু তারা বুদ্ধিমত্তা ও জনমুখী কর্মসূচি দিয়ে সেই চাপ মোকাবিলা করতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক পুঁজির ব্যবহার কিংবা নতুন নেতৃত্ব নিয়ে দূরদর্শিতা তারা দেখাতে পারেনি। মাঝেমধ্যে দুই–একটি ইস্যুতে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেও ধারাবাহিকতা ছিল না। যেমন রামপাল নিয়ে তারা কথা বলল, সেটাতে বরং ইস্যুটারই ক্ষতি করল। সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী নাগরিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক রং দেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল। এ রকম বিক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া ছাড়া বিএনপি এ সময় কোণঠাসাই ছিল।
বিগত তিন বছরে মানবাধিকারের বাস্তবতা মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ওপর চাপ এ সময়ে আরও প্রকট হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই সংকোচনকে প্রাতিষ্ঠানিক করা হয়েছে। নাগরিক হিসেবে যে কারোর জন্যই এই চিত্র হতাশাজনক। বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং শিশু ও নারী অধিকারের বেলায় অবনতির ধারা অব্যাহত ছিল। যদিও সরকার অস্বীকার করে গেছে, তবু এই অবস্থা মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য চ্যালেঞ্জ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার হরণ অব্যাহতই ছিল। যা ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিকার বাস্তবে খুবই বিরল। বরং উদ্বেগজনকভাবে দেখেছি, যারা অধিকার হরণের শিকার হয়েছে, তারা বা তাদের স্বজনদের জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক। মানবাধিকার ও দুর্নীতির এই নেতিবাচক চিত্র উন্নয়নের গতিপথকে আরও কণ্টকাকীর্ণই করবে।
এ সময়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ে সরকার ও সংসদের সঙ্গে বিচার বিভাগের টানাপোড়েন বাড়তে দেখা গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা পশ্চাদ্গতি। জাতীয় সংসদের মতো প্রতিষ্ঠােন আইন প্রণয়ন হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানে এখন প্রাণহীন পরিবেশ। কারণ, প্রশ্ন করা, প্রতিবাদ করা, জবাবদিহি দাবির ঘাটতি অব্যাহতই ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে উদ্বেগজনকভাবে জঙ্গিবাদের বড় ধরনের উত্থান এ সময়ে আমরা দেখেছি। এ বিষয়ে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আপাতদৃষ্টিতে সাফল্য দাবি করতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর সমাধানের দিকনির্দেশনা দেখা যায়নি। এই সমস্যার রাজনৈতিক ঝুঁকি আছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা দরকার। সরকার বলে আসছে, স্থানীয় জঙ্গিবাদের সঙ্গে বিদেশিদের সম্পর্ক নেই, আইএস নেই ইত্যাদি। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে এদের যোগাযোগ সম্প্রসারিত হচ্ছে কি না, তা ভাবার অবকাশ রয়েছে।
বছর শেষাশেষি নির্বাচন কমিশনকেন্দ্রিক আলোচনা জোরালো হয়েছে। রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা স্বাভাবিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। এ আলোচনা চলছে, কী ফল হয় দেশবাসী দেখতে আগ্রহী। ২০১৬ সালে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে যা দেখা গেছে, তা রাজনৈতিক অঙ্গনের ভাবনার খোরাক জোগাবে। গতানুগতিক অর্থে সহিংসতা ও কালোটাকার প্রভাব আগের মতোই বিরাজমান ছিল। সর্বশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচনে অর্থের লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে যে চর্চা দেখা গেল, তা ইতিবাচক। এটা প্রমাণ করে, এখনো সুস্থ রাজনীতির সুযোগ আছে। এটা শিক্ষা দেয়, রাজনীতি করতে হলে দুর্নীতি ও পেশিশক্তি রাখতেই হয়, এটা চিরায়ত সত্য নয়। জনকল্যাণমুখী সুস্থ রাজনীতি বিকাশের চেষ্টা করলে জনগণ সাড়া দেয়, এটা প্রমাণিত হলো। এ নির্বাচন সরকারকেও এই বার্তা দিল যে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে আর নির্বাচনী সংস্কৃতি বিনষ্ট করতে হয় না।
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।