বিষণ্নতা আর সম্ভাবনা উপকূলীয় বাংলাদেশের কৃষি, জীবন ও জীবনযাপনকে করেছে চ্যালেঞ্জিং ও বৈচিত্র্যময়। এখানে নিত্য জোয়ার-ভাটার ছন্দে আন্দোলিত হয় স্বপ্ন আর সমৃদ্ধির গান। উপকূলের বুকে আঁচড়ে পড়ে আইলা-সিডর, মহাসেন-নার্গিস। উপকূলের ধমনি-শিরায় লবণাক্ততার বিষক্রিয়ায় বিপন্ন হয় কৃষি ও জীববৈচিত্র্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের দানবীয় ঝাঁকিতে ধ্বংস হয় জোয়ার-ভাটার জনপদ আর মাঠ-ঘাট। ফিনিক্স পাখির মতন আবার জেগে ওঠে উপকূলের কৃষক-জেলে-জনতা। এঁরা বিষণ্নতা-ঝুঁকি-দুর্যোগ দুপায়ে মাড়িয়ে রপ্তানি আয়ের চাকা ঘোরায়, জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে গতি আনে-স্বপ্ন দেখায় সমৃদ্ধ আগামীর। উপকূলের চিংড়ি, কাঁকড়া, সবজি, ফল বিশ্ববাজার থেকে ছিনিয়ে আনে গৌরব আর ডলার।
সমস্যা-সম্ভাবনার উপকূলীয় কৃষি ও জীবন নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর। বদলে যাওয়া জলবায়ু, ক্রমস্ফীতমান সমুদ্র পৃষ্ট, আর লবণাক্ততা নিয়ে বিশ্বব্যাংক সমীক্ষা করে, এফএও গবেষণা করে, দাতা সংস্থা আয়োজন করে সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম। আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে মূল প্রবন্ধের বিষয়বস্তু হয় উপকূলীয় বাংলাদেশের বিষণ্নতা। গুগল স্কলার বা স্কপাস সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ দিলে চোখের সামনে ভেসে উঠে উপকূলের বিষণ্নতা নিয়ে অসংখ্য জার্নাল আর্টিকেল, নিবন্ধ, বই, প্রসিডিংস।
সায়েন্টিফিক দুনিয়া, দাতা সংস্থা, মিডিয়া জগৎ এখনও জানে লবণাক্ত উপকূলে বছরে একটা ফসল হয়, শুকনো মৌসুমে পতিত পড়ে থাকে বিস্তীর্ণ মাঠ। উপকূলের কৃষির বিষণ্নতা আর নৈরাশ্য নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-প্রকাশনা হয়েছে-সম্ভাবনা ও সফলতার কথা ততটা উঠে আসেনি।
বিষণ্নতা আর সংকট নয়, আমরা এই গবেষণা নিবন্ধে উপকূলীয় কৃষির সফলতা ও সম্ভাবনার কথা শুনব।পিএইচডি গবেষণার অংশ হিসাবে বদলে যাওয়া জলবায়ু, লবণাক্ততা, হাইড্রলজিতে নিবিড় কৃষির সম্প্রসারণ পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে কাজ করা হয়েছে। আমাদের গবেষণা সীমাবদ্ধ ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল বা খুলনা অঞ্চল নিয়ে।
উপকূলীয় ১৯ জেলার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল বা খুলনা অঞ্চল (খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা)। রপ্তানিমুখী চিংড়ি শিল্প, বৈচিত্র্যময় কৃষি ও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জন্য এই অঞ্চল অধিক গুরুত্ব বহন করে। তথ্য-উপাত্ত আর সরেজমিনে কৃষকের সাক্ষাৎকার নিয়ে আমরা দেখতে চেয়েছি সবুজ বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব, প্রযুক্তি বিপ্লবের ছোঁয়াতে উপকূলের কৃষি কী এখনও আগের মতো পেটেভাতের কৃষি?
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে উপকূলের তাপমাত্রাও বেড়েছে, এলোমেলো হয়েছে বৃষ্টিপাত। সেই সঙ্গে বেড়েছে বন্যা, খরা, সাইক্লোন, জলাবদ্ধতা। লবণাক্ততার তীব্রতা ও বিস্তৃতি দুইটাই বেড়েছে উপকূলে; ফারাক্কার প্রভাবে নেতিয়ে পড়ছে নদীর প্রবাহ। জোয়ারে লবণ জলের বিস্তৃতি ঘটেছে বহুদূর। বেড়েছে সুপেয় পানির দুষ্প্রাপ্যতা।
আমরা দেখতে চেয়েছি এসব ঝুঁকি মোকাবিলা করে উপকূলের কৃষির বর্তমান অবস্থা কী। শুকনো মৌসুমে যে বিস্তীর্ণ পতিত জমির কথা সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত জার্নাল আর্টিকেলেও বলা হয়েছে, সে পতিত জমি বাস্তবে অনেক কমে গেছে। হাইড্রলজিক্যাল সতর্কতা, লবণাক্ততার আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে শুকনো মৌসুমে বোরো ধান, ডাল, তৈল, ভুট্টা, আলু ও সবজি ফসলের আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
১৯৯১ সালের ৩০ শতাংশ পতিত জমি ২০১৮ সালে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২ শতাংশে। বোরো ধান ও নন-রাইস ফসলের আবাদ ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে খুলনা অঞ্চলে। কৃষি বান্ধব সরকারের উদ্যোগে ভূ-পৃষ্টস্থ ও ভূগর্ভস্থ সেচে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, খুলনা অঞ্চলে গত তিন দশক (১৯৯১-২০১৮) আমন ধানের চাষ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। বর্ষা মৌসুমে আমন ধান চাষ কমার প্রধান কারণ ক্রপিং সিস্টেমের পরিবর্তন। আমনের জমিতে কৃষক গলদা ঘের করছে। গবেষণার বিশেষ দৃষ্টি ছিল শুকনো মৌসুমে ফসলের কী অবস্থা। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, হাইড্রলজিস্ট, মৃত্তিকা বিজ্ঞানী সবাই বলেছে উপকূলে সেচনির্ভর বোরো ধানের আবাদ কৃষি ও পরিবেশবান্ধব নয়।
অথচ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জেলায় (খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট) গত বছর বোরো ধানের আবাদ হয়েছে প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমিতে। দেশজ মোট হাইব্রিড ধানের আবাদের (১৫ লাখ হেক্টর) প্রায় ৮% হচ্ছে বৃহত্তর খুলনা জেলায়। কৃষকের ভাষ্য অনুযায়ী হাইব্রিড ধান লবণাক্ততা সহিষ্ণু।
অত্যন্ত কম সেচ চাহিদার তৈলবীজ, ডাল, তরমুজ, ভুট্টা, আলু, সবজি চাষের আবাদ বৃদ্ধি নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। ১৯৯১ সালে নন-রাইস ফসলের আবাদ ছিল ৬০ হাজার হেক্টর, ২০২০ সালে প্রায় এক লাখ হেক্টর। দেশজ মোট তরমুজ আবাদের (১২ হাজার হেক্টর) ৮০ শতাংশ উপকূলে (বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম) হয়; শুধু খুলনা অঞ্চলে ৪০ শতাংশ তরমুজের চাষ হচ্ছে। দেশের ৪০ শতাংশ তিল চাষ হচ্ছে উপকূলে। চিংড়ি ঘেরের পাড়ের সবজি ও ফল চাষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষির মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে।
লবণপানির বাগদা চিংড়ির অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ ও এর সর্বব্যাপী প্রভাব নিয়ে সাধারণ কৃষক, মিডিয়া, পরিবেশবাদী সংগঠন আওয়াজ তুলেছিল। বাগদা চাষের অশুভ প্রভাব নিয়ে, ধান-চিংড়ি বিতর্ক নিয়ে, পরিবেশে ও প্রতিবেশের ওপর প্রভাব নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, সুপারিশ হয়েছে বিস্তর। আশার কথা হচ্ছে গত এক দশকে উপকূলে বাগদা চাষ কমছে, অপরদিকে মিষ্টি পানির গলদা বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ২০১০ সালের ২.১৩ লাখ হেক্টর বাগদা চাষ ২০২০ সালে কমে হয়েছে ১.৮৪ লাখ হেক্টর। অপরপক্ষে ২০১০ সালের ৪৩ হাজার হেক্টরের গলদা বেড়ে ২০২০ সালে হয়েছে ৭৩ হাজার হেক্টর। গলদা চাষের সঙ্গে শুকনো মৌসুমে বোরো ধান ও বছরব্যাপী সবজি এই ক্রপিং সিস্টেমকে আরও টেকসই ও লাভজনক করেছে।
কৃষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে এত চ্যালেঞ্জ-ঝুঁকি সত্ত্বেও কৃষি এই শস্য নিবিড়ায়নের পেছনে কোন কোন শক্তি কাজ করেছে। তারা প্রধান উদ্দীপনা হিসেবে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, দক্ষ সম্প্রসারণ সেবা, কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, সরকারি সহায়তা উল্লেখ করেছেন। ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমি, বিকল্প পেশার অভাব, যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তির উন্নতি, ব্যবসামনস্কতা বাণিজ্যিক ও নিবিড় কৃষির আবাদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।
অবকাঠামো উন্নয়নে (বাঁধ, সেচনালা, স্লুইসগেট গেট, খাল খনন, নদী খনন, সেচ প্রকল্প, গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন) সরকারি সহায়তা নিবিড় ফসল চাষ ত্বরান্বিত করেছে। সাক্ষাৎকারে সকল কৃষকই দুর্বল বাজার ব্যবস্থা, ভরা মৌসুমে ফসলের দাম পড়ে যাওয়া, ও কৃষি ঋণ পেতে ভোগান্তির কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছে।
বাংলাদেশের মোট ৪৬ বিলিয়ন ডলারের কৃষি জিডিপি’র (ফসল, মাছ, বনজ সম্পদ, প্রাণিসম্পদ) ৫ শতাংশ (২.৩ বিলিয়ন ডলার) আসছে খুলনা অঞ্চল থেকে যা অন্য যে কোন নিবিড় কৃষির জেলা (বগুড়া, যশোর, কুমিল্লা, রংপুর) থেকে বেশি। উপকূলে উচ্চমূল্য ফসলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ, নিবিড় চিংড়ি চাষ, সুন্দরবন সুরক্ষা, ঘেরের পাড়ে নিবিড় সবজি চাষ অব্যাহত থাকলে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের কৃষি জিডিপি’র পরি মান ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।
পরিবর্তিত জলবায়ু, লবণাক্ততা ও বাজার ঝুঁকি মোকাবিলা করতে গবেষণাপত্রে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। নদী-নালা খনন, আধুনিক সেচ নালা, সেচ স্কিম, কমিউনিটি ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা, স্লুইচ গেট মেরামতের মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির দক্ষ ব্যবহার সম্ভব।
লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, ও খরা প্রতিরোধী ফসলের জাত উপকূলের কৃষির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির সম্প্রসারণে দক্ষ সম্প্রসারণ সেবা নিশ্চিত করতে হবে। ঘাত প্রতিরোধী উচ্চফলনশীল জাত উন্নয়নের গবেষণা অব্যাহত রাখতে হবে। বাজার ব্যবস্থা ও ভ্যালু-চেইন আমাদের কৃষির সবচেয়ে দুর্বল জায়গা; এখানে একটা বড় পরিবর্তন দরকার।
আধুনিক সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও শক্তিশালী বাজার মূল্য বঞ্চনা কমাতে সহায়তা করবে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিকে আনুষ্ঠানিক ঋণের আওতায় তেমন একটা আনা যায়নি এখনও। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দুর্যোগ-ঝুঁকি মোকাবিলায় শস্য বিমা চালু না করলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি বেরিয়ে যেতে বাধ্য হবে তার বাপ-দাদার পেশা কৃষি থেকে।
বৈরিতা, চ্যালেঞ্জ ও বিষণ্নতা মানুষকে আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহসী করে। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশের কৃষক, কৃষিবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানী এখন অনেক সাহসী ও উদ্ভাবনী। আমাদের কৃষক এখন ‘ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার’ চর্চা করছে, আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা ‘ক্লাইমেট রিজিলিয়েন্ট’ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে, সরকার ‘ব্লু-ইকোনমি’ নিয়ে কাজ করছে। উপকূলে প্রিসিশন এগ্রিকালচার, ইনটেনসিভ চিংড়ি চাষ, হাইড্রোফকিন, ইনট্রিগেটেড এগ্রো-একুয়াকালচার, কাঁকড়া-কচুয়া খামার হাতছানি দিচ্ছে ডাকছে।
এখন দরকার দক্ষ পরিকল্পনা আর বাজেট। প্রযুক্তি, পরিকল্পনা, বাজেট, আর কৃষকের ঘাম-শ্রমের সমন্বয় করতে পারলে উপকূলীয় বাংলার জোয়ার-ভাটার কৃষি হবে বিশ্বের রোল মডেল।
মো. রওশন জামাল অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক। mjamal2 @myune.edu.au