নির্বাচন এসেই গেল। আমরা চাই, নির্বাচন ঠিক সময়ে নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হোক। এই দেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়। এই দেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। বহুদিন আগে কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘শান্তির ডিক্রি’ নামের কবিতায় লিখেছিলেন:
নিজের হাতে জমি চাষ করেন এমন একজন সাধারণ কৃষককে জিজ্ঞেস করুন, আপনি কি চান শান্তি?
তাঁর উত্তর হবে: এই তো আমার সবচেয়ে প্রিয় চাওয়া।
চাই, প্রাণপণে চাই, শতমুখে চাই।
জিজ্ঞেস করুন কারখানার একজন সাধারণ শ্রমিককে,
আপনি কী চান? তাঁরও উত্তর হবে—শান্তি।
একটু শান্তির জন্যই তো এই অহোরাত্র শ্রম।
আমরা সবাই শান্তি চাই, স্বস্তি চাই, নিরাপত্তা চাই—সেই জন্যই গণতন্ত্র চাই। সেই জন্যই ভোট। গণতন্ত্র তো দেশে অশান্তি ডেকে আনার জন্য নয়। গণতন্ত্র তো নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতার বোধ দেওয়ার জন্য নয়।
ভোটের আগে কেন হামলা হলো এত, ঠিক ধরতে পারছি না। এ জন্য কে দায়ী, তা বলতে গেলে আবারও তা নিয়ে অশান্তি বেধে যাবে। এ বলবে ও দায়ী, ও বলবে এ দায়ী। এ বলবে, আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা হয়েছে। ও বলবে, আমাদের কর্মীরা নিহত হয়েছে। কাজেই সে বিচারে যাব না। কিন্তু হেলমেট বাহিনী, লুঙ্গি বাহিনী, হকিস্টিক বাহিনী থেকে শুরু করে ছররা গুলি বাহিনীর হামলাযজ্ঞ যে ঘটে গেছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। এতে কোন পক্ষের লাভ হলো, বিষয়টা বুঝতে পারলাম না। কে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে?
চুল কাটাতে সেলুনে গিয়ে নানা বিশেষজ্ঞের আলাপ শুনতে পেলাম। কেউবা চুল কাটার বিশেষজ্ঞ, কেউবা ফেসবুকের বিশেষজ্ঞ, কেউবা পত্রিকার পাঠ বিশেষজ্ঞ, কেউবা টক শোর দর্শন বিশেষজ্ঞ। একজন বললেন, বিএনপি যাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়, সে জন্য এই হামলা। একজন বললেন, নির্বাচন যাতে না হয়, যেন নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করা যায়, সে জন্য এই হামলা। আরেকজন বললেন, ভোটকেন্দ্রে যাতে ভোটাররা ভয়ে না যান, সেটাই হামলার মূল কারণ। আরেকজন বললেন, এই সবের কোনোটাই না। আসল ব্যাপার হলো, মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া। লোকগল্পে শিয়াল যেমন বলেছিল, ওরে কুমির তুমি তো আমার পা ধরো নাই, লাঠি ধরেছ, কুমির যেই না পা ছেড়ে দিল, অমনি শিয়াল পগার পার। তেমনিভাবে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য এই হামলা।
তখন পাল্টা প্রশ্ন, জনগণের দৃষ্টি কোথা থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে?
তার উত্তর অবশ্য পাওয়া গেল না।
একজন বললেন, আগে ভোট মানে ছিল হোন্ডা আর গুন্ডা। এখন ভোট মানে হয়েছে হামলা আর মামলা।
আমি টক শো দেখি না, কারণ আমি রাত জাগতে পারি না। পত্রিকা পড়ি, কারণ তাতেই অন্ন তাতেই ভাত। তাতে অরণ্যে রোদন করি। আমাদের কাজ হলো বলে যাওয়া। দিন পনেরো আগে এই কলামে বলেছিলাম, কথা দাও কথাগুলো ফেরত নেবে না। উভয় জোটের কাছেই আবেদন করেছিলাম যেন তারা ইশতেহারে কতগুলো অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার কথা বলে, ব্যাংকিং সেক্টরে নৈরাজ্য বন্ধ করার অঙ্গীকার করে। ইত্যাদি ইত্যাদি। ইশতেহারগুলোতে ভালো ভালো কথা দেখতে পেয়েছি। তাতে একটুখানি আশার স্পর্শও অনুভব করেছি বটে। শেখ হাসিনা ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে বলেছেন, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের পথগুলো ভালোভাবে চলতে চেয়েছেন। ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, জনগণই দেশের মালিক। সময় এসেছে দেশের জনগণের দেশের মালিকানা বুঝে নেওয়ার। কথাগুলো শুনতে ভালোই লেগেছে। ঐক্যফ্রন্ট বলেছে, তারা বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখবে। তারা জঙ্গিবাদের প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি পোষণ করবে। তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়াও অব্যাহত রাখবে। বিএনপি অবশ্য যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে নীরব।
ড. কামাল বিএনপিকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা বলে গণ্য হবে কি না, তা ভবিষ্যৎই কেবল বলতে পারে। আরও ভালো হতো, যদি বিএনপি জামায়াত প্রার্থীদের নিজেদের মনোনয়নটা না দিত। আমাদের রাজনীতি থেকে ধর্মের ব্যবহার বন্ধে তা হতো একটা বিশাল অগ্রগতি। যা–ই হোক, রাজনীতি জিনিসটা রাজনীতিবিদেরা সবচেয়ে ভালো বোঝেন এবং তাঁরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই রাজনীতি করেন। যে দেশের রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ‘উইনারস টেক অল’। আর নির্বাচনে হেরে যাওয়া মানে যে দেশে কেবল ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হওয়া না, নিজের এলাকা থেকে, শান্তি-স্বস্তি-জীবিকা থেকে অনেক ক্ষেত্রে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া, সেই দেশে কলাম লেখকদের সুবচন নির্বাসনে যেতেই বাধ্য। প্রতিটি দলই যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যেতে চায়। প্রতিটি ভোটই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধার ভোট একটা, একজন রাজাকারের ভোটও একটা। কাজেই ভোট পেতে যা করা দরকার তারা করবে।
এখন চাই নির্বাচনটা ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক। যেই পক্ষই জিতুক না কেন, শান্তি আর শৃঙ্খলা যেন বজায় থাকে। যেন হামলা না হয়। যেন মানুষের জীবনহানি না ঘটে। যেন বিষয়-সম্পত্তির ওপরে আক্রমণ না আসে। মানুষ যেন নিরাপদ থাকে। এই দেশে ভোট চিরকালই ছিল উৎসব। মানুষ সেজেগুজে ভোটকেন্দ্রে যায়। নারীরাও রঙিন সাজপোশাকে ভোটকেন্দ্রে এসে ভিড় করেন। সেই উৎসবের আমেজটা যেন এবারের নির্বাচনেও বজায় থাকে।
এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সরকারের একটা মন্ত্রিপরিষদ আছে, একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন। কাজেই হামলা-মামলা বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের ওপরেও আসবে। আমাদের ওপরেই তো হামলা হচ্ছে বেশি, আমাদের নেতা-কর্মীরাই তো বেশি মারা যাচ্ছেন বললে দায় এড়ানো যাবে না। বরং সেটা তো তাদের দুর্বলতাকেই প্রকট করে তুলবে। ক্ষমতায় থেকেও তোমরা মার খাও, এতই দুর্বল তোমরা?
অতএব আমাদের দ্ব্যর্থহীন আহ্বান, হামলা বন্ধ করুন। হামলা রোধ করুন। হামলার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। ৩০ ডিসেম্বরের আগে-পরের সময়টা আমরা ভালোয় ভালোয় পার করে ২০১৯ সালকে শুভ নববর্ষ বলে যেন স্বাগত জানাতে পারি।
গণতন্ত্র মানেই একেবারে ভুলত্রুটিহীন শাসনপদ্ধতি নয়। গণতন্ত্র মানে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনও নয়। ধরা যাক, ১০০ জন ভোটার,৫টা দল। ৩টা দলের প্রত্যেকে পেল ২০ ভোট,১টা দল পেল ২১, আরেকটা ১৯। তাহলে এই ২১ ভোট পাওয়া দল বাকি ৭৯ জনকে শাসন করতে পারে। আর আমাদের দেশ হলে তারা সদম্ভে ঘোষণাও করতে পারে, জনগণ বাকিদের প্রত্যাখ্যান করেছে। কাজেই গণতন্ত্র মানে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, সংখ্যালঘুর অধিকার ও মর্যাদা এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
জনগণ যে কাকে গ্রহণ করে আর কাকে প্রত্যাখ্যান করে, তা খোদা জানেন। সেই যে গল্পটা ছিল, দুই গ্রামের শিক্ষকের মধ্যে যে জ্ঞানের প্রতিযোগিতা হচ্ছে, এক গ্রামের শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, বলুন তো ‘আই ডোন্ট নো মানে কী?’ উত্তর এল, আমি জানি না। অমনি প্রথম গ্রামের জনতা ঢোল-করতাল বাজিয়ে বিজয়োল্লাস করতে শুরু করে দিল। এবারের ভোট যেন সেই রকম হয়ে না যায়।
নব্বইয়ের পরের নির্বাচনগুলোয় আমরা দেখেছি, প্রচারণার শেষ লগ্নে এসে নেতারা বেতার-টেলিভিশনে ভাষণ দিতেন। সবিনয়ে জানতে চাই নামের একটা অনুষ্ঠান হতো বিটিভিতে। এবারের নির্বাচনে এসব প্রসঙ্গ তোলার অবকাশই মিলছে না। একটা নির্বাচন এসেছে, যেটা অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে, সেটাই বড় কথা। আর আমাদের চাওয়াটা এসে ঠেকেছে একেবারে ন্যূনতম একবাক্যের আকুল আবেদনে—আমাদের শান্তি আর নিরাপত্তা যেন ধূলিসাৎ হয়ে না যায়।
জোরের সঙ্গে তাই বলি, হামলা বন্ধ করুন। নির্বাচন কমিশন আর সরকার চাইলে হামলা বন্ধ করতে পারে না, এটা আমরা বিশ্বাস করি না।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক