তখন কার্তিক মাস। আকাল কি তাহলে এসে গেল! নদীতে মাছ নেই। চতুর্দিকে অবৈধ খনিজ বালুর পাহাড়। প্রভাবশালীরা টাকাওয়ালা হচ্ছেন। জেলা সড়ক ছাড়াও ৪৮ টন ওজনের বালুর ট্রাক চলছে ইউনিয়ন পরিষদের ১১ ফুটের রাস্তায়। উন্নয়নের চাকায় রাস্তা কেঁপে ওঠে। বলগেটের বালু তোলার শব্দে রাত–দিন চৌচির, পাখি-মাছ-শুশুক-ডুরা (কাছিম) সব এলাকাছাড়া। জেলেরাও মাছের পথ ধরলেন?
চিলমারীর জোড়গাছঘাট জেলেপাড়া। স্থানীয় লোকজন কয় মাঝিপাড়া। কেউ কেউ মাটির হাঁড়ি–পাতিল বানাতেন। তা-ও এখন অচল। পরিবার ১৩২টি। গত বছর এ সময় ৪০ থেকে ৫০ জন এলাকা ছেড়েছেন। এ বছর ইতিমধ্যে চলে গেছেন ১০০ থেকে ১৫০ জন। আরও যাবেন ৫০ জনের মতো। তঁারা পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ। বাড়িতে থাকবেন বৃদ্ধ মা–বাবা আর বউঝিরা। চালের দাম আর আনাজের (সবজি) দাম বাড়লে প্রথম আঘাতটা পড়ে এই পাড়াতেই। ’৪৩, ’৭৪-সহ সব মন্বন্তরে এখানেই আঘাতটা প্রথম পড়েছিল।
ব্রহ্মপুত্রপাড়ের জেলের কাছে দেশ তাই ব্রহ্মপুত্র যত দূর, তঁার ভাষায় যেটি হলো ‘দ্যাশ’। ঢাকা শহর তো অবশ্যই, কখনো রংপুরও তাঁর কাছে বিদেশ। ব্রহ্মপুত্রের চর, কোলা ও আকাশই তাঁর সারা দিনমান। শহরে তিনি ডানাভাঙা পাখি। তবু শূন্যে উড়াল। যত দূর যান, মাছের গল্প সঙ্গে নিয়ে ওড়েন।
২.
জোড়গাছ হাটে কথা হচ্ছিল প্রভাতের (৪০) সঙ্গে। তাঁরা ১৪ থেকে ১৫ জন মিলে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন। কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্রত মাছ নাই, ভাই। কী খামো, বাঁচি থাকা তো নাইগবে।’
মাছ নেই কেন? জানতে চাইলে বলেন, ‘গত বছরের আগের বছর সিরাজগঞ্জ থাকি পাঁচ থেকে ছয়জন জালুয়া আসি চায়না না কী জানি জাল আনি মাছ ধরছে। মাছে মাছ বাহে। সেই কাণ্ড দেখি সবাই চায়না জাল কিনছি। সাপ, কুঁচিয়া, ইঁচলে (চিংড়ি), ভেরুস, বাইম—কোনো মাছ বাদ যায় না। সউগ ওঠে। আর মশারি জাল তো আছে। খাওয়ার মাছ এক সের ওঠে, তো মাছ নষ্ট হয় মণখানেক। কত আর সহ্য হয়, এবার মাছ নাই। পোনা মাছের অভিশাপ নাইগছে।’
‘চায়না জাল বিছানো হয় নদীর এমাথা থেকে ওমাথায়। একেবারে তলায় চলে যায়। কোনো মাছ রেহাই পায় না। গভীরের মা মাছগুলোও ধরা পড়ে। আর মশারি জালের স্থানীয় নাম খ্যাতাজাল। প্রচুর পোনা নষ্ট হয় এতে। আর বিষ দিয়ে মাছ সাফা করা তো আছেই। এ কারণে নদীতে আর মাছ নাই,’ বলছিলেন ভারত চন্দ্র (৪৫)। নদীতে পানি কমে গিয়ে কোলা (যে জলভাগের তিন দিকে চর ও এক দিক স্রোতের সঙ্গে যুক্ত) জাগে, তখন বিষ দিয়ে সব প্রাণকে হত্যা করা হয়।
রমনা ডাটিয়াপাড়ার জেলে আমিনুল ইসলাম (৪০) বলেন, ‘মাছ যে ডিম ফুটাইবে, সেই পরিবেশ কডৈ? যে জায়গাত সকালে এক দল মাছ মারি, একই জায়গাত রাইতে আরেক দলও মারি। মাছ ডিম ফুটায় কহন?’
৩.
উজানে ব্যাপক মাছ ধরা পড়ার কারণ হিসেবে লাল মিয়া (৬০) বলেন, ‘সেখানে তিন মাস মাছ ধরা মানা। শুকনা মৌসুমে নদীর মাঝোত ও আশপাশে জঙ্গলভরা বিল আছে। হামরা যাক কোলা বলি। সেই কোলাগুলোত মাছ ধরা নিষেধ। বিএসএফ পাহারা দেয়। তিন মাসে কোলাগুলো মাছে ভর্তি হয়া যায়। পরে নদীত পানি বাড়লে কোলা আর বিলগুলো নদীর সঙ্গে একাকার হয়। তখন ব্রহ্মপুত্রে মাছ আইসে। এত মাছ ওঠে, দুইজন মানুষ নাগে জাল তুলতে। হামার এতিও এটা করা উচিত।’
কিন্তু ব্রহ্মপুত্রে মাছ সংরক্ষণে কোনো বিধিনিষেধ নেই। কখন, কোথায় কোন জাল দিয়ে মাছ ধরা যাবে, তা নিয়ে কোনো ব্যবস্থাপত্র নেই। জেলেপাড়ার তরুণ রাজনীতিবিদ দিলীপ কুমার বলেন, ‘সরকার খালি ইলিশ চেনে। চিলমারীর লোক তো ইলিশ খায়ও না, পায়ও না। হামরা চিনি বাঘের মতো ডোরাকাটা বাইগর (বাগাড়)। জারোত (শীতে) পৈরালির যে স্বাদ, তার সাথে ইলিশের তুলনা হয়? অথচ সরকার খালি ইলিশ চেনে।’
বোয়াল, চিতল যেমন ডিম ফোটায় বর্ষাকালে, ইলিশ তেমন আশ্বিন মাসে। পৈরালি, কাউয়াট্যাংনা, কাজলি, ট্যাংনার মতো ছোট মাছগুলো ডিম পাড়ে মাঘ-ফাল্গুনে। এরা ডিম ফোটায় নদীর কোলা বা বিলগুলোয়। মশারি বা খ্যাতা জালগুলো দিয়ে এই ডিম ও পোনাগুলো মেরে ফেলা হয়। একেক ঋতুতে একেক জাতের মাছ বংশ বাড়ায়। যে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বাংলাদেশের প্রায় সব জাতের মাছ ডিম ছাড়ে, সেই সময় নদ-নদী শুকিয়ে যায়। থাকে ব্রহ্মপুত্রের মতো বড় নদ-নদীতে। সেই ব্রহ্মপুত্রেই যদি মাছ ঠাঁই না পায়, তাহলে? ভারতীয় অংশে সেই সময় মাছ ধরা নিষিদ্ধ বলে এইটুকু মেলে।
নদী–নালার দেশে, জালুয়া-তাঁতির দেশে এগুলো নিয়ে আলাপ থাকবে না? আমরা তো শুধু উন্নয়ন খাই না, মাছও খাই।
নাহিদ হাসান রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি