২০২০-এর জানুয়ারি জেনারেল কাসেম সোলাইমানি খুন হন। ইরানের জন্য এটা অপূরণীয় ক্ষতি মনে করা হতো। কিন্তু পারস্য সভ্যতা এবং শিয়া নৃতত্ত্বে অদম্য এক মানসিকতা আছে। তারই ফল যেন জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহের উত্থান। সবাই বলছে, কাসেম সোলাইমানির শূন্যতা তিনি ইরানকে পূরণ করে দিয়েছেন। ইরানের প্রতিপক্ষরা এই ‘নতুন সোলাইমানি’কে নিয়ে নতুন করে উদ্বেগে পড়েছে। তিনি মৃত সোলাইমানির চেয়েও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন বলে তাদের শঙ্কা।
পুরোনো সোলাইমানির শূন্যতা যেভাবে পূরণ হচ্ছে
এটা এখন আর কোনো লুকোছাপা তথ্য নয়, ইরাক থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত বহু অঞ্চলের সশস্ত্রতায় ইরানের উপস্থিতি ও স্বার্থ আছে। যেভাবে আছে সেসব জায়গায় সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ আরও বহু দেশের অংশ। ছদ্ম যুদ্ধের এসব পরিসরে ইরানকে এগিয়ে রেখেছিলেন জেনারেল সোলাইমানি। তাঁর দক্ষতার শূন্যতা ইরানের জন্য ভয়াবহ বিপদ হিসেবে আসে। সে জন্যই ব্যাপক হুমকি-ধমকির পরও দেশটি সোলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ নেয়নি বা পারেনি। কিন্তু গত ২০ মাসের অভিজ্ঞতা বলছে, প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার প্রত্যয় ছাড়েনি ইরানের সামরিক কাঠামো। তারই প্রমাণ আমির আলী হাজিজাদেহ্।
স্থলযুদ্ধের প্রতিভা জেনারেল সোলাইমানি ইরানের অপেক্ষাকৃত গোপন তৎপরতায় নেতৃত্ব দিতেন। ‘বিপ্লবী গার্ড’-এর আট শাখার একটি—কুদস ফোর্সের প্রধান ছিলেন তিনি। সেই তুলনায় জেনারেল আলীর কর্মক্ষেত্র ভিন্ন। ইরানের বিপ্লবী গার্ডের আকাশ প্রতিরক্ষা দিকের কমান্ডার তিনি। প্রায় দেড় দশক এই পদে আছেন।
সোলাইমানির চেয়ে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট আমির আলী হাজিজাদেহ্। কিন্তু ইতিমধ্যে আপন প্রতিভায় সোলাইমানির মতো স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ইরানিদের। আর ভয় দেখাচ্ছেন দেশটির প্রতিপক্ষদের। সোলাইমানির সঙ্গে আমির আলীর বড় মিল—ইরানের যুদ্ধকৌশলকে আত্মরক্ষামূলক না রেখে আক্রমণাত্মক রাখতে চান তিনিও। তবে ভিন্ন পদ্ধতিতে, ভিন্ন ধাঁচে।
ইরানের আকাশযুদ্ধ প্রযুক্তির নতুন গুরু আমির আলী
হাজি কাসেম সোলাইমানি জীবিত থাকার সময় ইসরায়েলের সমরবিদদের মুখে মুখে ফিরত তাঁর ‘অপবাদ’। ওই জেনারেল সম্পর্কে খবরাখবরের বড় উৎস ছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংগ্রহ। এখন সেটা শুরু হয়েছে আমির আলীকে নিয়ে। ড্রোন বা ‘মানুষবিহীন আকাশযান’ এবং মিসাইল প্রযুক্তিতে আমির আলী ও তাঁর সহকর্মীরা ক্রমাগত ইসরায়েলকে চমকে দিচ্ছে। কুদস ফোর্সের হাত হয়ে এসব প্রযুক্তি চলে যাচ্ছে লেবানন, গাজা, ইয়েমেনসহ ছায়াযুদ্ধের বহু ফ্রন্টে। অভিযোগ উঠেছে, আমির আলীর আমলে ইরান আকাশযুদ্ধকে ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজেদের আকাশসীমার বাইরে বহু ‘অপর আকাশে’। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শঙ্কার দিক এটা। সেই সূত্রেই আমির আলী এখন ইসরায়েলের নতুন ‘টার্গেট’। যেভাবে ছিলেন ইরানিদের প্রিয় ‘হাজি কাসেম’।
তরুণ বয়সে ইরাকবিরোধী যুদ্ধকালে আমির হাজিজাদেহ্কে ইরান গড়ে তুলতে চেয়েছিল দক্ষ ‘স্নাইপার’ হিসেবে। কিন্তু এই যোদ্ধা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন জেনারেল হাসান তেহরানী দ্বারা। যিনি ছিলেন ইরানের আকাশযুদ্ধ প্রযুক্তির প্রধান স্তম্ভ। ২০১১ সালে রহস্যময় এক বিস্ফোরণে ইরান তাদের মিসাইল প্রযুক্তির ওই অগ্রসেনানীকে হারায়। মৃত্যুর আগে হাসান তেহরানী গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ সেরে যান, তা হলো আমিরকে তাঁর শাখার ওপরের দিকে টেনে আনা। তারপর থেকে আমির আলী ইরানের আকাশযুদ্ধ প্রযুক্তির নতুন গুরু।
সোলাইমানির মতো আমিরকেও ভালোবেসে মদদ দিয়ে যাচ্ছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা। কিন্তু ২০১৯-এর জুন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিষিদ্ধ একজন তিনি। আমির আলীর পেশাগত জীবনের বড় কুখ্যাতির দিক হলো সোলাইমানি হত্যার পর ২০২০ এর ৮ জানুয়ারি ভুল করে তেহরান থেকে কিয়েভে যাওয়ার পথে ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান ফেলে দিয়েছিল তাঁর বিভাগের মিসাইল। বিনা অপরাধে ১৭৬ জন মারা যান তাতে। এ রকম নির্মম ভুল, এরপরও দেশের সর্বোচ্চ নেতার প্রিয়ভাজনই আছেন তিনি। নিজ দপ্তরের এ রকম কাণ্ডে দুঃখ প্রকাশ করতে আমির আলী তিন দিন সময় নিয়েছিলেন। তাঁর ওই ‘কুকীর্তি’ ডেকে রাখতে প্রায়ই হরমুজ প্রণালিতে ২০১৯-এর জুনে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা ড্রোন ভূপাতিত করার সফলতার কথা বলা হয়। যে ড্রোন ৬০ হাজার ফুট উচ্চতায় নজরদারি করতে পারত বলে কথিত আছে এবং বহু দশক পর যুক্তরাষ্ট্রকে মার খাওয়ার এ রকম দৃশ্য দেখতে হয়। ইরানিদের কাছে অবশ্য আমির আলীর জীবনবৃত্তান্তের এ রকম আরও উজ্জ্বল দিক আছে।
হাজি কাসেম সোলাইমানি জীবিত থাকার সময় ইসরায়েলের সমরবিদদের মুখে মুখে ফিরত তাঁর ‘অপবাদ’। ওই জেনারেল সম্পর্কে খবরাখবরের বড় উৎস ছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংগ্রহ। এখন সেটা শুরু হয়েছে আমির আলীকে নিয়ে।
ইরানের যুদ্ধকৌশলের অদলবদল
হরমুজে ড্রোন হারানোর প্রতিশোধ নিয়েছে ওয়াশিংটন এক বছর পর সোলাইমানির ওপর আরেক ড্রোন হামলায়। সোলাইমানের মৃত্যুর পর ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল প্রতিশোধের ১৩টি বিকল্প পথ তৈরি করেছিল। তবে সেসব প্রকাশ করেনি তারা। কিন্তু প্রকাশ্য দৃশ্যপটে ইরানের অগ্রাধিকার বোঝা কঠিন নয়। ইসরায়েল, সৌদি আরবসহ সব প্রতিপক্ষকে তারা আকাশে ও সমুদ্রে বিব্রত রাখতে চাইছে ড্রোন ও মিসাইলবিদ্যায়। সোলাইমানির আমল থেকে আমির আলীর আমলে ইরানি যুদ্ধকৌশলের এই পরিবর্তন বেশ চোখে পড়ার মতো। সর্বশেষ গত আগস্টে, ওমানের কাছে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলিদের আংশিক মালিকানা আছে এমন এক নৌযানে যে চোরাগোপ্তা ড্রোন হামলা হলো, তার জন্যও অনেক ভাষ্যকার বিপ্লবী গার্ডের আকাশ প্রতিরক্ষা বিভাগের দিকে আঙুল দেখাচ্ছে। গত কয়েক বছর ভারত মহাসাগরেও ইসরায়েলিদের মালিকানাধীন পণ্যবাহী নৌযানে এ রকম সন্দেহজনক হামলা হয়েছে এবং হচ্ছে। এসবকে সিরিয়ামুখী ইরানি তেলবাহী ট্যাংকারে তেল আবিবের হামলার নিছক বদলা হিসেবে গণ্য করা যেত। কিন্তু ইয়েমেন থেকে সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে হামলা, ইরাকে আমেরিকার বসতিতে আক্রমণ এবং লেবানন ও গাজা থেকে ইসরায়েলে নিয়মিত বিরতিতে মিসাইল ছোড়ার ঘটনাকে একসঙ্গে মেলালে পুরো ভূরাজনীতিতে ইরানের উপস্থিতি শনাক্ত করা সহজ হয়।
কয়েক বছর আগে এ ধরনের ছায়াযুদ্ধে মাইনের ব্যবহার দেখা যেত। এখন দেখা যাচ্ছে মনুষ্যবিহীন আকাশযান। পুরোনো সোলাইমানির জায়গায় ‘নতুন সোলাইমানি’ মধ্যপ্রাচ্যের রণক্ষেত্রকে এভাবে বদলে নিচ্ছেন বলা হয়। তাঁর আমলেই ইরানের মিসাইল দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা দেখিয়েছে। ‘যেসব মিসাইলের বড় এক অংশ’, আমির আলীর ভাষায় ‘রাখা আছে ঊর্ধ্বমুখী করে’!
যে কারণে আমির আলীকে নিয়ে প্রতিপক্ষরা শঙ্কায়
সর্বগ্রাসী কঠোর এক অবরোধের মাঝে ইরান কীভাবে তার মিসাইল প্রযুক্তি সংগ্রহ ও বিকশিত করছে, তার হদিস পাওয়া মুশকিল। তবে সরাসরি সেটা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বকে খর্ব করতে চায়। সে কারণেই আমির আলী ইসরায়েল, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সোলাইমানির মতোই বড় এক দুর্ভাবনা। আর সেই সূত্রেই তাঁকে বলা হচ্ছে আরেক সোলাইমানি। তাঁর আমলেই ইরান মহাশূন্যে ‘নূর’ নামে সামরিক স্যাটেলাইট ছুড়েছে; যা তাদের দূরপাল্লার মিসাইলের অভিযানকে বিশেষভাবে সহায়তা করতে পারে। সব মিলিয়ে, স্থলযুদ্ধের চেয়ে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে এই জেনারেলের আগ্রহ বেশি।
এই সোলাইমানিকে নিয়ে উদ্বেগের আরেক বাড়তি কারণ ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনি কট্টরপন্থীদের কাছের লোক। পুরোনো প্রেসিডেন্ট রুহানির প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল না। রক্ষণশীল এব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এক বক্তৃতায় এই জেনারেলের উচ্ছ্বসিত মন্তব্য ছিল, ‘ইরান এই প্রথম পুরোপুরি ইসলামি রাষ্ট্রে রূপ নিল।’ পুরোনো সোলাইমানির দিক থেকে পূর্বতন শাসকদের প্রতি এ রকম আক্রমণাত্মক মন্তব্য দেখা যেত না।
বোঝা যাচ্ছে, ইরানের ইতিহাসে সেই মুহূর্ত এসেছে, যখন তাদের সর্বোচ্চ নেতা, প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সমরবিদেরা পুরোপুরি একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে শত্রু-মিত্রদের। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে মুহূর্তটি উদ্বেগের সঙ্গে নজর কাড়ছে সবার।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক