নিউইয়র্ক থেকে একটি শিশু ঢাকা এয়ারপোর্টে এসে নামে। তারপর গাড়িতে করে বড় রাস্তার দিকে আসতেই দেখতে পায় ট্রাফিক সাইনে লাল আলো জ্বলছে। কিন্তু ড্রাইভার দুরন্ত গতিতে গাড়িটি পার করে নিয়ে আসছেন। শিশুটি মায়ের বুকে ভয়ে মুখ লুকায়। চিৎকার করে বলে ওঠে, মা, রেড সাইনে গাড়ি! ড্রাইভার হাসেন।
সেই সময় ধানমন্ডি এলাকায় একটি শিশু গাড়িতে করে স্কুলে যাচ্ছিল। লাল বাতি জ্বলছে, ড্রাইভার গাড়ি থামাতেই শিশুটি চিৎকার করে উঠল। মা, গাড়ি থামল কেন?
মা: লাল বাতিতে গাড়ি তো থামবেই—
শিশু: না, লাল বাতিতেই তো গাড়ি চলে, সবুজ বাতিতে গাড়ি থামবে।
তখনই লাল বাতিতেই গাড়ি চলতে শুরু করল। দুটি ভিন্ন বার্তা দুই শিশুর কাছে। দুটিই ভুল বার্তা। আর এই ভুল বার্তাতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। দিল্লি, কলকাতা, লন্ডন, বার্লিন, নিউইয়র্কে বা পৃথিবীর যেকোনো শহরেই এই লাল বাতি ও সবুজ বাতির বিষয়টিকে অমোঘ সত্য বলে মনে করে। দিল্লিতে এক শীতের রাতে কুয়াশাঢাকা জনশূন্য রাজপথে ট্যাক্সি থেমে গেল। লাল বাতিও ক্ষীণ। ড্রাইভারকে বললাম, কেন থামালেন?
—লাল বাতি জ্বলছে
—ট্রাফিক পুলিশ নেই, গাড়িঘোড়াও নেই, অসুবিধা কী?
ড্রাইভার জবাব দিলেন, ‘কানুন তো হ্যায়।’
আজকের শিশুদের আন্তর্জাতিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেই হবে, যার পূর্বশর্ত হচ্ছে, সবার জন্য দেশ, আইন সবার ওপরে
নিউইয়র্ক থেকে আসা শিশুটি মিন্টো রোড দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখতে পায়, একই লেনে উল্টো দিক থেকে আসছে একটি গাড়ি। আবারও চিৎকার, গাড়ি আসছে! ভুল পথে। ড্রাইভার আবারও হাসেন, কারণ ওই গাড়িটির ভুল পথে আসার অধিকার আছে।
আমরা জানি, ঢাকা শহরের প্রয়োজনমতো পথঘাট নেই। প্রতি মাসেই হাজার হাজার প্রাইভেট কার নামছে। তারপরও কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। এ সবই আমাদের জানা কথা। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, বরং বাড়ছে। কলকাতায় সত্তর ও আশির দশকে অবস্থা এ রকমই ছিল। ব্যাংককে আশির দশকেও যানজট ছিল দুঃসহ। তারা সমাধান করল কীভাবে? দুটি দেশই গুরুত্ব দিয়েছে প্রবলভাবে ট্রাফিক চলাচলের পরিকল্পনা ও আইনের ওপর এবং জনগণের সচেতনতা বাড়ানোর দিকে। আমরা দেখেছি, অতি তুচ্ছ কারণে যানজটে পড়ে আছি। দেখা গেল, সিএনজি অটোরিকশার চালকের সঙ্গে রিকশাওয়ালার বচসা চলছে। অথচ তাতেই সারা রাস্তা বন্ধ। আর আইন ভঙ্গ করা আমাদের স্বৈরাচারী সংস্কৃতির অংশ, যে যত আইন ভঙ্গ করে, সে তত বাহাদুর। মিন্টো রোডে, বেইলি রোডে যাতে মন্ত্রী-আমলারা উল্টোপথে আসতে না পারেন, তার জন্য দুটো ডিভাইস পর্যন্ত লাগানো হয়েছিল।
ঢাকা শহরের কিছু কিছু রাস্তা যে প্রশস্ত নয়, তা নয়। কিন্তু অনেক স্থানেই রাস্তাগুলোর দখল হয়ে আছে দোকানপাটে। কিছু কিছু জায়গায় স্থায়ীভাবে দোকানপাট বসেও গেছে। আমি দু-একবার অনুসন্ধান করে দেখেছি, এসব দখলকারীকে যাঁরা বসান, তঁারা একধরনের লিডার। যাঁদের পদবি ‘ফুট লিডার’। এই ফুট লিডাররা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে থাকে আর তাঁরাই পুলিশের সঙ্গে একটা ব্যবস্থা করে নেন। এই ফুট লিডাররা ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যান।
ট্রাফিক সাইনগুলোর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ কি আমাদের ট্রাফিক বিভাগের আছে? ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ একটি বিজ্ঞান এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কম্পিউটার। কম্পিউটারের নতুন নতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে এই ব্যবস্থা দিন দিন আধুনিক হচ্ছে। যেকোনো উন্নত দেশের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও রেলের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবেই কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আর আমরা একবিংশ শতাব্দীতে সফল বিজ্ঞান ও আধুনিকতাকে ত্যাগ করে আবার ফিরে গেছি সেই ট্রাফিক পুলিশের হাত তোলা, হাত নামানোর কাজে। ঢাকা শহরের এই বিশাল ট্রাফিককে কি এই সনাতনব্যবস্থায় চালানো সম্ভব?
ট্রাফিক আইন অমান্য করার কাজে নেমেছে সবাই। ভিআইপি, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ বাহিনী, মোটরসাইকেল বাহিনী, সিএনজি অটোরিকশা, ট্যাক্সি ও সবচেয়ে শক্তিশালী রিকশা বাহিনী। আইন মেনে চললে যে সবার সুবিধা, এই কথাটা বুঝতে চাইছে না কেউ। বুঝলাম আমাদের চালকেরা তেমন শিক্ষিত নন, কিন্তু ভারতের চালকেরা কি খুবই শিক্ষিত? না। এই বাহিনীর পেছনে আছে সংঘবদ্ধ সংগঠন। যেকোনো সম্মিলিত শক্তি যে দানবে পরিণত হয়, তার উদাহরণ চালক ও মালিক সমিতি। সম্প্রতি সুপারিশ এসেছে, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালককে ৩০২ ধারায় মামলা করা চলবে না। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। আইন কি মৃত্যুদণ্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, নাকি আইন ভঙ্গ করায় পরিণতির কথা মনে করিয়ে দেয়, যাতে আইন ভঙ্গকারী ভয় পায়। আইনের ভয়টা প্রয়োজন। আমাদের মতো দেশে। যখন সেনাবাহিনী থাকে, তখন সবাই আইন মেনে চলে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার এলেই যেন সব স্বাধীন হয়ে যায়। স্বেচ্ছাচারিতার অধিকার মিলে যায়। এখানেই যে দেশপ্রেম, এটা বোঝার ক্ষমতা আমাদের হয়নি।
ঈদের সময় শত শত মানুষ যারা যায়। এ-ও তো আইনভঙ্গের কারণে। প্রকারান্তরে হত্যাকাণ্ড। অর্থলোভী কিছু মালিকের এবং চালকের আইনভঙ্গের কারণেই এসব ঘটে। ঈদের সময় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করেই ব্যবসা ও হত্যাকাণ্ড। গত রোজার ঈদের সময় যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চন্দ্রাতে দাঁড়িয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছিলেন, কিন্তু তিনি কি দেখেছেন যে নবীনগর থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত সমাপ্ত চার লেনের কী অবস্থা হয়েছে? কার্যত তা দুটি লেনেই রয়ে গেছে। একটি লেনে গাড়ির গ্যারেজ, অন্যটিতে বাজার বসেছে। রাস্তাঘাট করলেই হবে না, তাতে যান চলাচলের সুব্যবস্থাও চাই।
একটা দেশের ট্রাফিক সিস্টেমই সে দেশের শৃঙ্খলার একটা ছবি। তাই বিষয়টি গুরুতর রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই প্রধান বিষয়। একবার যদি বোঝানো যায় যে আইনের আওতার বাইরে কেউ নয়, তবেই তা সম্ভব। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী শুধু সিটবেল্ট পরেননি বলে তাঁকে আদালতে গিয়ে আড়াই শ ডলার জরিমানা দিতে হয়েছে। এসব এখনো আমাদের স্বপ্নের কথা। তবে জীবন এখানে শুধু ধীর-শ্লথ নয়, রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনে কত ধরনের প্রযুক্তি এসেছে, সেগুলোর ব্যবহার করা কি অসম্ভব? দেশের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার জন্য একটা বড় অধিদপ্তর করে তাকে নতুন করে ঢেলে সাজানো যায় না? সরকার তা পারেও, কারণ পরিবহনশ্রমিক ও মালিকদের সংগঠনও তাঁদের হাতে। শ্রমিকদের সচেতন করার কোনো কাজ, তাঁদের মানবিক করে তোলার কাজ এসব সংগঠন কখনো করেছে বলে আমার জানা নেই। শুধু ন্যায়-অন্যায় সব আবদারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
যে শিশুটি লাল-সবুজের ভুল বার্তা পেয়ে বড় হয়েছে, সে একদিন হয়তো বিদেশে যাবে, কিন্তু তার ভ্রান্তি থেকেই যাবে। আজকের শিশুদের আন্তর্জাতিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেই হবে, যার পূর্বশর্ত হচ্ছে, সবার জন্য দেশ, আইন সবার ওপরে।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।