মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ গত ২০ এপ্রিল এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আমাদের বুঝতে হবে যে উন্নত জাতি হয়ে ওঠা কখনোই সম্ভব হবে না, যদি আমরা কেবল সুউচ্চ দালানই দেখাতে থাকি, বিপরীতে আমাদের নদীগুলো দূষিত হয়ে যায়, আমাদের বনভূমির জায়গা মরুর আকার ধারণ করে এবং যে বাতাসে আমরা শ্বাস নিই, তা মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ে।’
মাহাথিরের এই বক্তৃতা পড়ে ৪০ বছর আগের আরেকটি বক্তৃতার কথা মনে পড়ে গেল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির আইনবিদ ও রাজনীতিক ভাই রবার্ট কেনেডি ১৯৬৮ সালের ১৮ মার্চ ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসে এক দীর্ঘ বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমরা যখন মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির গণনা করি, তখন বায়ুদূষণ, সিগারেটের বিজ্ঞাপন, মহাসড়কে হতাহতদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা—সবই এর অন্তর্ভুক্ত করে নিই। এমনকি আমাদের দরজার বিশেষ তালাগুলো যারা ভাঙে, তাদের রাখার জেলখানার পরিমাণও জিডিপি গোনায় ধরা হয়। আবার রেডউড যেভাবে ধ্বংস করা হয় এবং আমাদের প্রাকৃতিক আশ্চর্যগুলো যেমন বিশৃঙ্খলভাবে ভেঙে পড়ে, তা–ও জিডিপি গণনার মধ্যে ধরা হয়।
বোমায় ব্যবহৃত পেট্রল, পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র এবং দাঙ্গা রুখতে পুলিশের সাঁজোয়া যান, তা–ও জিডিপি গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্য, স্কুলের শিক্ষার মান কিংবা খেলার আনন্দকে গোনায় ধরে না। আবার জিডিপি আমাদের কবিতার সৌন্দর্য কিংবা বিয়েব্যবস্থার শক্তির দিক, বুদ্ধিদীপ্ত গণবিতর্ক কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মনিষ্ঠাকেও গোনায় ধরতে জানে না। এমনকি আমাদের বৃদ্ধিদীপ্ত রসবোধ, সাহস, প্রজ্ঞা, শিখতে পারার ক্ষমতা, আমাদের আবেগ, আমাদের দেশভক্তি—কোনো কিছুকেই গোনায় ধরে না এই জিডিপি। আসলে জিডিপি সবকিছুই মাপে, কেবল যা যা আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে, সেসব ছাড়া।’
১৯৬০–এর দশক পর্যন্ত একটি দেশের উন্নতির পরিমাপক হিসেবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন বেশ জনপ্রিয় ছিল। ঠিক সেই দশকেই ববি কেনেডির এই বক্তৃতা যথেষ্ট আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। তবে অর্থনীতিবিদেরা জিডিপি থেকে সরে এসেছিলেন সত্তরের দশকে এসে। কারণ, জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা বা মোহ দেশের মধ্যে আয়বৈষম্য বাড়ায়। এ কারণেই এত বছর পরেও জিডিপি আলোচনায় ববি কেনেডির এই বক্তৃতার কথা অনেকেই স্মরণ করেন।
তবে জিডিপি মানেই উন্নতি—এই ধারণা থেকে সবাই যে বেরিয়ে গেছে, তা বলা যাবে না। জিডিপি নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। তবে বাংলাদেশে এ নিয়ে আলোচনা অবশ্যই অনেক বেশি হওয়া প্রয়োজন। কেননা, বাংলাদেশ যেমন সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী পাঁচটি দেশের একটি, তেমনি সর্বোচ্চ আয়বৈষম্যের দেশগুলোরও একটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সবাই যখন প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা ধরনের বুদ্ধিভিত্তিক আলোচনা করছে, তখন আমরা কথা বলছি প্রবৃদ্ধির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে, পরিসংখ্যানের যথার্থতা নিয়ে।
২.
প্রবৃদ্ধি নিয়ে একধরনের মোহ আছে আমাদের। কেউ কেউ বলেন, ‘হাতিরঝিলে গেলে মনে হয়, প্যারিস শহরের কোনো অংশে এসেছি। আকাশ থেকে ঢাকা শহরকে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস মনে হয়। কুড়িল ফ্লাইওভার দেখলে মনে হয় এটি কোনো সিনেমার দৃশ্য।’ এক মন্ত্রী বললেন, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবদান হবে কানাডার সমান। আমরা এ ধরনের কথাবার্তা সামনে হয়তো আরও শুনব। এ অবস্থায় জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি থেকে আমরা কী পাচ্ছি, এই আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। দৃশ্যমান প্রভাব না থাকলে জিডিপির প্রকৃত অর্জন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
দেশের গবেষণা সংস্থাগুলো বাংলাদেশের জিডিপির মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে। যেমন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস) গত ২৮ এপ্রিল অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি সমালোচনামূলক আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। সেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বিআইডিএস বলেছে, দুইভাবে প্রবৃদ্ধির মান বুঝতে পারা যায়। এর একটি আয়বৈষম্য, যা বাংলাদেশে ক্রমাগত বাড়ছে। অন্যটি কর্মসংস্থান, যা উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও তেমন বাড়েনি বলে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে। অনেকের মতো বিআইডিএসও এটাকে বলেছে, কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। সরকার রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়কে প্রবৃদ্ধির বড় উৎস হিসেবে বিবেচনা করছে। কিন্তু বিআইডিএস বলছে, গত কয়েক বছরে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় দুটোরই গড় প্রবৃদ্ধি কমেছে।
একই ধরনের বিশ্লেষণ করেছে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের সামঞ্জস্য পাওয়া যাচ্ছে না। শিল্প খাতের উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গেও বেসরকারি বিনিয়োগের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসা পরিচালনার ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ পেছনের সারির একটি দেশ। অথচ ক্রমবর্ধমান মূলধন উৎপাদন অনুপাত (ইনক্রিমেন্টাল ক্যাপিটাল আউটপুট রেশিও) কমছে বলে সরকার বলছে। এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, গত পাঁচ বছরে গড়ে ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কমে গেছে। যেমন, ২০০৫-১০ সময়ে দারিদ্র্য বিমোচনের হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ আর ২০১০-১৬ সময়ে তা কমে হয়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশ। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির লাভ কার পকেটে গেল? নাকি হিসাবে গন্ডগোল আছে?
একই ধরনের সমালোচনা করেছে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির ভাষ্য হচ্ছে, বিভিন্ন খাতের যে অবদান থাকার কথা, সেটা অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে না, অথচ উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে। আবার এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে যেহেতু বিনিয়োগ বেশি হয়নি, সেহেতু শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশি হতে হবে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে এমন কোনো প্রযুক্তি বা উদ্ভাবন যুক্ত হয়নি বা রূপান্তর ঘটেনি যে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৈপ্লবিকভাবে বেড়ে গেছে। আর শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়লে শ্রমিকের আয় বাড়ার কথা। কিন্তু সরকারের তথ্য-উপাত্তই বলছে, বৈষম্য বাড়ছে। সুতরাং যে ধরনের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তাতে আয় ও কর্মসংস্থানের যে চিত্রটি আসে, তা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জিডিপির যে প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। সিপিডি এক ধাপ এগিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব কীভাবে নিরূপণ হলো, তা প্রকাশের দাবি জানিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত জিডিপি বিতর্ক নিয়ে মুখ খুলতে হয়েছে সরকারের। যেমন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত শনিবার জিডিপির সমালোচকদের নিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি ব্যাখ্যা দিতে চাই। কোথাও গোলটেবিল আয়োজন করুক, আমি সব প্রশ্নের জবাব দেব।’
৩.
প্রবৃদ্ধির অর্জন নিয়ে বিতর্ক অবশ্য এবারই প্রথম নয়। যেমন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ, অথচ কৃষি খাতে ছিল ঋণাত্মক, প্রবাসী আয়ও কমে গিয়েছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। অথচ ওই অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমেছিল প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ, অন্যদিকে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল খুবই সামান্য, ১ শতাংশের কিছু বেশি।
প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয় পরের অর্থবছরেও। সরকারের প্রাথমিক প্রাক্কলন ছিল, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। কিন্তু হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এই হার নিয়ে বিশ্বব্যাংকের মন্তব্য ছিল, উৎপাদন সক্ষমতা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান খুব বেশি না বাড়লেও কেবল ভোগ ব্যয়ের ওপর ভর করে বড় প্রবৃদ্ধি অর্জনের হিসাব বিশ্বাসযোগ্য হবে না।
জিডিপি নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট এবারও দেখা দিল। এই সংকট নিরসন করা জরুরি। কেননা, স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও আমরা একটা বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। দুঃখজনক হচ্ছে, সারা বিশ্ব যখন প্রবৃদ্ধির বাইরে গিয়ে সুখ বা ভালো থাকার উপায় নিয়ে কথা বলছে, আমরা তখন আলোচনা করছি জিডিপির পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। পরিসংখ্যান সঠিক না হলে দেশের প্রকৃত চিত্র জানা যাবে না।
৪.
গত ১৫ ডিসেম্বর বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসি ও আইসিসিবি এক নাগরিক সংলাপের আয়োজন করেছিল। সেখানে দেওয়া পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহীম বলেছিলেন, ‘আমি চাকরিজীবনে দেখেছি, কীভাবে ঘষেমেজে উন্নয়নের পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়।’
দেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থা নিয়ে একটা বড়সড় আলোচনার উপযুক্ত সময় এখনই।
শওকত হোসেন: প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক
[email protected]