ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়া ইউরোপের রাজনীতির কর্তৃত্ব অনেকটাই জার্মানির হাতে তুলে দিয়েছে। চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলও এ সুযোগ পুরোপুরি নিয়েছেন। জার্মানিকে ইউরোপীয় রাজনীতির শক্ত অবস্থানে নিয়েছেন তিনি। ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশকে সঙ্গে নিয়ে ম্যার্কেল চেষ্টা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া থেকে বেরিয়ে ইউরোপের নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে। যুদ্ধংদেহী, কট্টর জাতিবাদী অবস্থান থেকে সরে এসে উদারনৈতিক বহু সংস্কৃতির ইউরোপ গঠনের প্রচেষ্টা ম্যার্কেলের ছিল; যদিও তিনি এতে পুরোপুরি সফল হতে পারেননি। তাঁর নিজ দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমক্রেটিক দলের মধ্য থেকেই প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েছেন একাধিকবার। প্রায় ১৫ লাখ সিরীয়কে জার্মানিতে আশ্রয় দেওয়ার জন্য এখনো ম্যার্কেলকে সমালোচনা করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিশালসংখ্যক সিরীয় অভিবাসীর ব্যয় বহন করতে গিয়ে জার্মান নাগরিকদের অনেক সামাজিক সুবিধা কাটছাঁট করা হয়েছে। এ ছাড়া পরমাণু জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২০২২ সালের মধ্যে বন্ধ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করলেও সেখান থেকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে তাঁকে।
আঙ্গেলা ম্যার্কেল স্বল্প পরিসরে কিছুটা শুরু করেছিলেন। শ্রমঘাটতি মেটানোর জন্য চাকরি অনুসন্ধানের ভিসা শুরু করেছিলেন। ন্যাটোতে অতিরিক্ত বরাদ্দ দিতে রাজি হননি। জার্মানির গঠিতব্য নতুন সরকার ম্যার্কেলের কাজগুলোই আরও বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দিয়েছে। সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদলের পর জার্মানি নতুন সরকার গঠনের দ্বারপ্রান্তে আছে। আশা করা হচ্ছে, ক্রিসমাসের ছুটির আগেই জার্মানিতে নতুন সরকার গঠিত হবে সামাজিক গণতান্ত্রিক দল, সবুজ দল ও উদার গণতান্ত্রিক দলের সমন্বয়ে। ইতিমধ্যেই দল তিনটি সরকার গঠনের একটি খসড়া চুক্তি প্রণয়ন করেছে।
এ চুক্তিতে জনবান্ধব অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর চার লাখ আবাসন সৃষ্টির পরিকল্পনা চুক্তিতে রয়েছে। গণপরিবহনের ব্যবহার ও সুবিধা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি রয়েছে। রেলের উন্নয়ন করা হবে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে নতুন অভিবাসন, জলবায়ুনীতি ও অস্ত্র বিক্রি হ্রাসের বিষয়গুলো অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কারণ, এ বিষয়গুলো ইউরোপ ও বৈশ্বিক রাজনীতি গভীর প্রভার বিস্তার করবে। যেমন ২০৩০ সাল নাগাদ ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদন করা হবে। ১৫ মিলিয়ন বৈদ্যুতিক গাড়ি নামানো হবে রাস্তায়। কয়লার ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধের চেষ্টা করা হবে। এর ফলে জলবায়ু-কূটনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ও চীনের মতো বড় খেলোয়াড়েরা আরও কোণঠাসা হয়ে যাবে।
খসড়া চুক্তিতে অভিবাসনের পদ্ধতি সহজ করার কথা বলা হয়েছে। জার্মানিতে যাঁরা পাঁচ বছর ধরে অবস্থান করছেন, তাঁদের ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এক বছর থাকার অনুমতি দেওয়া হবে। তিন বছর বৈধভাবে অবস্থানের পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। অবৈধ হয়ে পড়া ব্যক্তিদের ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত থাকলেও সম্ভবত তা করা হবে না। তবে বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়ে নতুন করে জার্মানিতে ঢোকার বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে। অব্যাহত শ্রমিকের সংকট মেটাতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ রাখা হবে।
খসড়া চুক্তিতে অভিবাসনের পদ্ধতি সহজ করার কথা বলা হয়েছে। জার্মানিতে যাঁরা পাঁচ বছর ধরে অবস্থান করছেন, তাঁদের ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এক বছর থাকার অনুমতি দেওয়া হবে। তিন বছর বৈধভাবে অবস্থানের পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। অবৈধ হয়ে পড়া ব্যক্তিদের ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত থাকলেও সম্ভবত তা করা হবে না। তবে বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়ে নতুন করে জার্মানিতে ঢোকার বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে। অব্যাহত শ্রমিকের সংকট মেটাতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ রাখা হবে। এসব প্রস্তাবনায় দক্ষ শ্রমিকদের অভিবাসনের সুযোগ দানের ইঙ্গিত স্পষ্ট।
জার্মানির আসন্ন সরকারের কর্মপরিকল্পনা নিঃসন্দেহে ইউরোপের অন্যান্য দেশকেও প্রভাবিত করবে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের রাজনীতির আলোচিত বিষয় হচ্ছে অভিবাসননীতি ও জলবায়ুর পরিবর্তন রোধের পদক্ষেপ। প্রায়ই ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির সংবাদ পাওয়া যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে অভিবাসী ইউরোপের দিকে ছুটে আসছে। ওদিকে গত দশকের অর্থনৈতিক মন্দার জের ধরে বিভিন্ন দেশে অভিবাসনবিরোধী জাতিবাদী কট্টরপন্থী দলের উত্থান ঘটে। কট্টরপন্থীরা শ্রমঘাটতি স্বীকার করতে চায় না। এরা অভিবাসন বন্ধের পক্ষে। অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি ও নেদারল্যান্ডসে কট্টরপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছে। এ ছাড়া জলবায়ুনীতিতে তারা বেশ রক্ষণশীল অবস্থানে ছিল। জার্মানির নতুন উদার অবস্থান ইউরোপের দেশগুলোকে অভিবাসন ও জলবায়ুনীতি পরিবর্তন করতে উৎসাহিত করবে। অভিবাসননীতি উদার করা ছাড়া জার্মানির কোনো উপায়ও ছিল না। স্থানীয় জনসংখ্যার হ্রাস ও অর্থনীতির প্রসারের কারণে দিন দিন শ্রমঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করছে।
এ অবস্থায় ইউরোপের অভিবাসননীতি সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিদিনই দলে দলে মানুষ সাগর, পাহাড় ডিঙিয়ে ইউরোপে ঢুকছে। তাদের ফেরত পাঠানোর কথা বললেও সিংহভাগই বিভিন্নভাবে অস্থায়ী বসবাসের অনুমতি অর্জন করতে সক্ষম হয়। তারা নিজেদের উদ্বাস্তু ঘোষণা করে আশ্রয়ের আবেদন করে। ইউরোপের দেশগুলো জানে তাদের সম্পর্কে। কিন্তু সবাইকে ফেরত পাঠায় না শ্রমবাজারে চাহিদার কারণে। কিন্তু এটা অভিবাসনের সহজ ও নিরাপদ পন্থা নয়। শ্রমের ঘাটতি পূরণের এ বিপজ্জনক পথ থেকে ইউরোপের দেশগুলোর বের হওয়া জরুরি। বিকল্প হিসেবে স্বাভাবিক অভিবাসনপ্রক্রিয়া শুরু করা প্রয়োজন।
জার্মানির নতুন উদার অভিবাসনের পরিকল্পনা ও জলবায়ুবান্ধব নীতি ইউরোপে অন্যদের পথ দেখাবে; বিশেষ করে শ্রমের ঘাটতি মেটাতে ইউরোপকে সাহায্য করবে। যে প্রক্রিয়ায় ইউরোপ শ্রম সংগ্রহ করছে, তা টেকসই নয়। বিভিন্নভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শ্রমিকেরা এসে ইউরোপ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু এ জন্য শ্রমিকদের চড়া মূল্য দিতে হয়। সংবাদপত্রের পাতা উল্টালে বা ওয়েবসাইটে চোখ রাখলেই আমরা ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির সংবাদ দেখি। প্রতিনিয়তই ডুবে মরছে। যারা এতটা দুঃসাহসী নয়, স্থলপথেই ইউরোপে ঢুকতে তারা এসে বসনিয়ার জঙ্গলে আটকা পড়ে অথবা বেলারুশের বনে।
জার্মানির নতুন অভিবাসননীতি কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন নয়। তবে কিছুটা হলেও বন্ধ দুয়ার খোলা হয়েছে। জার্মানির দেখাদেখি ইউরোপের অন্য দেশগুলোও অচিরেই দুয়ার খুলতে শুরু করবে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো নম্বরের ভিত্তিতে নতুন নতুন অভিবাসী গ্রহণ করবে। অনেকেরই মনে হতে পারে, ইতালি, ফ্রান্স বা স্পেনে লাখ লাখ অভিবাসী রয়েছে; তাহলে নতুন করে অভিবাসননীতি উদার করার কোনো প্রয়োজন আছে কি না।
এ অবস্থায় ইউরোপের অভিবাসননীতির পর্যালোচনা করা জরুরি হয়ে পড়েছিল; যদিও এর বিরোধিতা রয়েছে। কট্টরপন্থীরা মনে করেন গণহারে অভিবাসীদের ঢোকার সুযোগ ইউরোপের অর্থনীতিকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। শ্রমিকের অভাবেই ইউরোপের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হতে পারে। তাই ইউরোপের অভিবাসনীতিকে আরও উদার ও বাস্তবসম্মত করতে হবে। শ্রম উদ্বৃত্তের বাজার থেকে ইউরোপীয় ভাষা ও কারিগরি দক্ষতার ভিত্তিতে ইউরোপ শ্রমিক আমদানি করতে পারে। অভিবাসনের নামে ভয়ংকর জুয়া বন্ধ করতে হবে। ইউরোপে অভিবাসন ভাগ্যের জুয়ায় পরিণত হয়েছে। সাগর, পাহাড় ও জঙ্গল অতিক্রম করে শ্রমিকেরা ইউরোপে এসে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে। এরপর এদেশ-সেদেশ ঘুরে কয়েক বছর পর থিতু হওয়ার সুযোগ পায়। আর যারা পায় না, তাদের দেশে ফিরে যেতে হয়।
জার্মানির নতুন অভিবাসননীতি কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন নয়। তবে কিছুটা হলেও বন্ধ দুয়ার খোলা হয়েছে। জার্মানির দেখাদেখি ইউরোপের অন্য দেশগুলোও অচিরেই দুয়ার খুলতে শুরু করবে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো নম্বরের ভিত্তিতে নতুন নতুন অভিবাসী গ্রহণ করবে। অনেকেরই মনে হতে পারে, ইতালি, ফ্রান্স বা স্পেনে লাখ লাখ অভিবাসী রয়েছে; তাহলে নতুন করে অভিবাসননীতি উদার করার কোনো প্রয়োজন আছে কি না। মনে রাখতে হবে, তাদের অধিকাংশ বৈধভাবে বা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নিজেদের অবৈধ বলে ঘোষণা করে বসবাসের অনুমতির জন্য আবেদন করেছে। এটা অভিবাসনের স্বাভাবিক কোনো প্রক্রিয়া নয়।
অভিবাসন ও জলবায়ুনীতি ছাড়াও জার্মানির আসন্ন নতুন সরকার অস্ত্র বিক্রির লাগাম টেনে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অস্ত্রের ওপর নির্ভরতা হ্রাস ও অস্ত্র বিক্রি কমাতে তিন দলই একমত হয়েছে। ফলে, দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, ভারতসহ সারা বিশ্বে যেখানে জাতিবাদী কট্টর জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটছে, জার্মানিতে তখন অনেকটাই উদার অবস্থানের সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। উল্লিখিত দেশগুলোয় একই চরিত্রের কট্টরপন্থীরা সরকার গঠন করছিল বা ক্ষমতায় আছে। তারা চরম অভিবাসীবিরোধী।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধের পদক্ষেপকে হালকাভাবে বিবেচনা করে। অস্ত্র বিক্রি ও ক্রয় করছে ধুমছে। এসব দেশে কট্টর জাতীয়তাবাদ ও ছদ্ম ফ্যাসিবাদের সময়ে জার্মানির আসন্ন সরকার নতুন দিনের আশায় সলতে পাকাচ্ছে। তারা কতটা সফল হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে জার্মানির নতুন সরকার চলমান স্রোতের বিপরীতে নতুন দিশা হতে পারে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বিশ্বরাজনীতিতে জার্মানির অবস্থান আরও সংহত করবে। ইউরোপের একচ্ছত্র নেতা হবে জার্মানি।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক