গত মাসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (কপ ২৬) জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার কমানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে ভারত। দিল্লির বায়ুতে বিষাক্ত কণার উপস্থিতি মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ার পরও কয়লার ব্যবহার কমানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করায় ভারত খল চরিত্র হিসেবে বিশ্বদরবারে চিত্রায়িত হয়েছে। এই সম্মেলনে ভারতের অপরাধ, দেশটি কয়লার ব্যবহার ইস্যুতে চীনের সঙ্গে একজোট হয়ে সম্মেলনের অন্য সব উন্নত দেশের বিরোধিতা করেছে।
সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো কয়লার ব্যবহার থেকে ‘ধাপে ধাপে পুরোপুরি সরে আসার’ প্রস্তাব করেছিল। এ নিয়ে শুরুতে ভারতের দিক থেকে কোনো রকম বিরোধিতাও ছিল না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে চীন ও ভারত বেঁকে বসে এবং তারা ‘ধাপে ধাপে পুরোপুরি সরে আসার’ বদলে ‘ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার’ প্রস্তাব করে। অর্থাৎ তারা ‘ফেজ আউট’ না করে সে কয়লার ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয়ে ‘ফেজ ডাউন’ করতে চায়।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী দেশ হিসেবে ভারত তুমুলভাবে সমালোচিত হচ্ছে। অথচ চীন ও পশ্চিমা ধনী দেশগুলোর তুলনায় ভারতের নির্গমন খুবই কম।
এ কথা সত্য যে ভারত অন্যতম বড় কয়লা ব্যবহারকারী দেশ। এ দেশের ৭০ শতাংশ জ্বালানি উৎপাদিত হয় কয়লা থেকে। ভারতে যেখানে প্রতি চারজনের একজন সুইচ টিপে বিজলিবাতি জ্বালানোর কিংবা ট্যাপের পানিতে গোসল সারার সুবিধা থেকে বঞ্চিত, সেখানে উন্নত বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকে এই সুবিধা ভোগ করে আসছে।
আরও করুণ হলো, ভারতই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান শিকার। এখানে বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। বায়ুদূষণ তো আছেই। বায়ুদূষণ ও নিম্নমানের বায়ুর শহর হিসেবে দিল্লি এখন বিশ্বের কাছে ‘পোস্টার বয়’ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র, গণপরিবহনের ডিজেলচালিত ইঞ্জিন এবং আশপাশের রাজ্যগুলোর খেতের নাড়ায় আগুন দেওয়ার পর সৃষ্ট ছাইয়ে দিল্লির বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত উপাদান ভয়াবহ মাত্রায় যুক্ত হচ্ছে। এই দূষণ সামনে আসায় ভারতের কয়লা ব্যবহারের সমালোচনা আন্তর্জাতিক মহলে জোর পাচ্ছে।
এই সম্মেলনের অনেক আগেই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই ‘ফেজ ডাউন’–সংক্রান্ত একটি চুক্তি হয়ে আছে। অথচ বিশ্বের কাছে এই ধীরে ধীরে নির্গমন কমানোর প্রস্তাবকারী হিসেবে ভারতকেই এখন দোষারোপ করা হচ্ছে। কিন্তু এতটা সমালোচনা ভারতের প্রাপ্য হতে পারে না।
সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশের নেতা হিসেবে ভারতের শেষ মুহূর্তের এই পরিবর্তন তাকে রীতিমতো ‘ভিলেন’ বানিয়েছে। কিন্তু এই যে ভারত কয়লার ব্যবহার থেকে ‘ধীরে ধীরে পুরোপুরি সরে আসার’ বদলে ‘ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার’ প্রস্তাব দিয়েছে, তা কিন্তু মোটেও নতুন কিছু নয়।
এই সম্মেলনের অনেক আগেই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই ‘ফেজ ডাউন’–সংক্রান্ত একটি চুক্তি হয়ে আছে। অথচ বিশ্বের কাছে এই ধীরে ধীরে নির্গমন কমানোর প্রস্তাবকারী হিসেবে ভারতকেই এখন দোষারোপ করা হচ্ছে। কিন্তু এতটা সমালোচনা ভারতের প্রাপ্য হতে পারে না।
প্রথম কথা হলো সারা বিশ্বে যত কার্বন নিঃসরণ হয়, তার মাত্র ৭ শতাংশ নির্গমন করে ভারত, চীন ২৭ শতাংশ আর যুক্তরাষ্ট্র করে নিঃসরণ করে ১৫ শতাংশ। উন্নত বিশ্ব সবচেয়ে বেশি মাত্রার কার্বন নিঃসরণের ধাক্কা এসে পড়ছে ভারতের মতো দেশের ওপর, যাদের বেশির ভাগ মানুষই বিদ্যুৎ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ কয়লা দিয়েই তার জ্বালানি চাহিদার বেশির ভাগ পূরণ হয়। এই অবস্থায় ভারত কয়লা ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে—পশ্চিমাদের এমন আশা করাটা মোটেও ন্যায্য হবে না, যতক্ষণ না তারা ভারতকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষতির বিপরীতে ক্ষতিপূরণ দেয়।
অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে কোটি কোটি ভারতবাসী বিদ্যুৎ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এই অবস্থায় কয়লা হয়তো দূষণ বাড়াচ্ছে, কিন্তু এর বিকল্প বেছে নেওয়া শুধু ভারত কেন, অন্য কোনো দেশের পক্ষেও সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের ভারতকে যে সহযোগিতা দেওয়া উচিত ছিল, তার কিছুই তারা দেয়নি।
তবে আনন্দের বিষয়, ভারতের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আছে সৌর আলোক। পর্যাপ্ত সূর্যালোক কাজে লাগিয়ে ভারত ২০২২ সাল নাগাদ ছাদে বসানো সোলার প্যানেল দিয়ে ৪০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। তবে এখন পর্যন্ত তারা লক্ষ্যের মাত্র ২০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণের সৌরবিদ্যুৎ রাতারাতি উৎপাদন করা সম্ভব নয়। এর জন্য বিপুল পরিমাণ ব্যাটারির স্টোরের প্রয়োজন হবে, যা ব্যয়সাপেক্ষ। অন্যদিকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ ভারতের মাত্র ২ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে।
যেহেতু ভারত কৃষিপ্রধান দেশ, তার সামর্থ্যও সীমিত, সেহেতু কয়লার ব্যবহার শিগগিরই নামিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সেটি করতে গেলে দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতি একেবারেই ঝিমিয়ে পড়বে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● শশী থারুর জাতিসংঘের সাবেক আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী