জনবল ও ব্যবস্থাপনাকাঠামোয় যে পরিবর্তন দরকার

স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন মূলত হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, নতুন মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা, ডাক্তার ও নার্স নিয়োগসহ কতগুলো গতানুগতিক পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। কিন্তু কোভিড–১৯ ব্যবস্থাপনায় বেহাল অবস্থা থেকে প্রতীয়মান হয়, এই ক্ষেত্রে দরকার একটি সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত সংস্কার। এই লেখায় স্বাস্থ্য খাতে জনবল ও ব্যবস্থাপনাকাঠামোয় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করব।

মেডিকেল শিক্ষাকে স্বাস্থ্যসেবা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়নে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে; স্থানীয়ভাবে শিক্ষক ও অন্যান্য জনবল নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতির ক্ষমতা দিতে হবে। গবেষণা ও শিক্ষার মান বাড়ানোর প্রয়োজনে চিকিৎসা প্রদানের কাজে যতটুকু সংশ্লিষ্ট হওয়া দরকার, মেডিকেল কলেজগুলো ততটুকুই সংশ্লিষ্ট হবে। তবে জেলা সরকারি হাসপাতালের অর্গানোগ্রাম ও কাঠামোগত ব্যাপক পরিবর্তনের মাধ্যমে সেকেন্ডারি স্বাস্থ্যসেবার সব প্রয়োজন মেটানোর উপযোগী করে তুলতে হবে। বিভাগীয় পর্যায়ে সব বিশেষায়িত হাসপাতালের শাখা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

মেডিকেল কলেজ স্থানীয়ভাবে বেসিক ও প্যারা-ক্লিনিক্যাল বিষয়ে সরাসরি প্রভাষক নিয়োগ দেবে। ক্লিনিক্যাল বিষয়ে সহকারী রেজিস্ট্রার নিয়োগ দিয়ে তঁাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পদায়ন করবে। উভয় ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে তঁাদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা ও গবেষণালব্ধ প্রকাশনার ভিত্তিতে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দেবে। তবে যাঁরা ক্লিনিক্যাল বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করতে ব্যর্থ হবেন, তাঁদের মধ্যে যঁারা ক্লিনিক্যাল লাইনে থাকতে চান, তাঁদেরকে পর্যায়ক্রমে জ্যেষ্ঠতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে সিনিয়র ইনডোর মেডিকেল অফিসার ও প্রিন্সিপাল ইনডোর মেডিকেল অফিসার বা অনুরূপ কোনো উচ্চতর পদে পদোন্নতি দেওয়া যেতে পারে।

প্রশাসনিক লাইনে যেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের জ্যেষ্ঠতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সহকারী পরিচালক, সহযোগী পরিচালক ও পরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়া যেতে পারে। শুধু অধ্যাপকদের নির্দিষ্ট কোটার ভিত্তিতে গ্রেড-১–এ যাওয়ার সুযোগ থাকবে।

যেহেতু মেডিকেল কলেজগুলো মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চিকিৎসাসেবার মূল ধারার বাইরে থাকবে, সেহেতু মেডিকেল শিক্ষা নামে আলাদা কোনো অধিদপ্তর থাকার প্রয়োজন নেই।

প্রতিকারমূলক স্বাস্থ্যসেবার মূল ধারাটি হবে উপজেলা সরকারি হাসপাতাল, জেলা সরকারি হাসপাতাল ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিশেষায়িত হাসপাতাল। যাঁরা এ ধারায় নিযুক্ত হবেন, তাঁরা বর্তমানের মতো সহকারী সার্জন বা ডেন্টাল সার্জন হিসেবে নিয়োগ পাবেন। তাঁরা পর্যায়ক্রমে ক্লিনিক্যাল বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, জ্যেষ্ঠতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে উপজেলা, জেলা ও বিশেষায়িত হাসপাতালে সহকারী পরামর্শক, সহযোগী পরামর্শক, পরামর্শক, সিনিয়র পরামর্শক ও প্রধান পরামর্শক হিসেবে পদোন্নতি পাবেন। প্রধান পরামর্শকের পদটি গ্রেড-১ হবে। যাঁরা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন না, তাঁদেরকে জ্যেষ্ঠতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে সিনিয়র মেডিকেল অফিসার, প্রিন্সিপাল মেডিকেল অফিসার বা অনুরূপ কোনো উচ্চতর পদে পদোন্নতি দেওয়া যেতে পারে। ডেন্টাল সার্জনদেরও জেলা হাসপাতালে উচ্চতর পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে।

উপজেলা হাসপাতাল থেকে বিভাগীয় পর্যায়ের বিশেষায়িত হাসপাতাল পর্যন্ত ব্যবস্থাপনার একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করতে হবে। এ ধারায় মেডিকেল স্নাতকদের পাশাপাশি স্বাস্থ্য অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় স্নাতকদের আবেদন করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এর ধাপগুলো হতে পারে সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, যুগ্ম পরিচালক, অতিরিক্ত পরিচালক, পরিচালক এবং মহাপরিচালক।

উপজেলা সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপক হবেন একজন উপপরিচালক এবং সহব্যবস্থাপক হবেন একজন সহকারী পরিচালক। জেলা সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপক হবেন একজন যুগ্ম পরিচালক। এ ছাড়া দুজন উপপরিচালক (প্রশাসন এবং অর্থ) এবং চারজন সহকারী পরিচালক থাকবেন। জেলা সরকারি হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে জেলা পর্যায়ের সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর নজরদারি ও তদারকির দায়িত্ব তাঁদের হাতে ন্যস্ত করা যেতে পারে।

৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপক হবেন একজন অতিরিক্ত পরিচালক। আর তঁাকে সহযোগিতা করবেন ২ জন যুগ্ম পরিচালক (প্রশাসন এবং অর্থ), ৪ জন উপপরিচালক এবং ৮ জন সহকারী পরিচালক। আর ৫০০–এর অধিক শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপক হবেন ১ জন পরিচালক, তাঁকে সহযোগিতা করবেন ২ জন অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন এবং অর্থ), ৪ জন যুগ্ম পরিচালক, ৮ জন উপপরিচালক ও ১৬ জন সহকারী পরিচালক। পরিচালকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে একজনকে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে পদায়ন করা যেতে পারে। এর পরের ধাপটি হবে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। এ ধারার পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অর্থনীতি/স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা/হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সব পদে এই ধারা থেকে পদায়ন করতে হবে।

প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা ও সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পুষ্টি’ নামে আর একটি নতুন ধারার সৃষ্টি করতে হবে। প্রতি উপজেলায় এ ধারার একটি শক্তিশালী ইউনিট থাকবে। এই ইউনিটে ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা’ নামে একটি এবং ‘পুষ্টি কর্মকর্তা’ নামে একটি পদ থাকবে। মেডিকেল, স্বাস্থ্য অর্থনীতি, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞানের স্নাতকেরা এ পদে আবেদন করতে পারবেন। উপজেলাতে এই ধাপের প্রধান পদটি হবে ‘উপজেলা স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পুষ্টি কর্মকর্তা’। প্রতি ইউনিয়নে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদার একজন স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিদর্শক ও একজন পুষ্টি উন্নয়ন পরিদর্শক থাকবেন; তাঁরা স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত থাকবেন। বর্তমান স্বাস্থ্য সহকারী ও স্বাস্থ্য পরিদর্শকের পদ বিলুপ্ত করতে হবে। ‘সিভিল সার্জন’ পদটিকে রূপান্তর করা যেতে পারে ‘জেলা স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পুষ্টি উন্নয়ন কর্মকর্তা’ নামে। তাঁকে সহযোগিতা করবেন একজন ‘অতিরিক্ত জেলা স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা’, একজন ‘অতিরিক্ত জেলা পুষ্টি উন্নয়ন কর্মকর্তা’, দুজন ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা’ ও দুজন ‘পুষ্টি উন্নয়ন কর্মকর্তা’। বিভাগীয় ও অধিদপ্তর পর্যায়ে এবং সচিবালয়ে উচ্চতর পদ তৈরি করে তঁাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে, তাতে গ্রেড-১ পর্যন্ত পদোন্নতির সুযোগ থাকবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমানের ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর’ বিলুপ্ত করে ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পুষ্টি উন্নয়ন অধিদপ্তর’ গঠন করা যেতে পারে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকেও স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অধিকারী হতে হবে। এর প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উপযুক্ত যোগ্যতার একজনকে ছায়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

নার্স, প্যারামেডিক, ফার্মাসিস্ট, মেডিকেল ফিজিসিস্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ সব সাপোর্ট স্টাফের ক্ষেত্রেও সব ধরনের অসংগতি চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি করে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। ১১ থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলাকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ সব অধস্তন পদ বদলিযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে এবং প্রতি তিন বছর পরপর একই জেলার অন্য হাসপাতালে বদলি করতে হবে।

এ জন্য সর্বক্ষেত্রে অর্গানোগ্রামে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সংযোজন করতে হবে। বাংলাদেশ বিসিএস কাঠামোর ভেতরে এসব ধারা প্রবর্তনের বিধান না থাকলে হয় উপযুক্ত বিধান তৈরি করতে হবে, নতুবা মেডিকেল ক্যাডারকে জুডিশিয়াল ক্যাডারের মতো বিসিএসের বাইরে আনতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সম্পূর্ণ নিজস্ব জনবল দ্বারা পরিচালনা করতে বাধ্য করতে হবে। এর ফলে একদিকে যেমন বেসরকারি হাসপাতালে সেবার মান উন্নত হবে এবং বেকার ডাক্তারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার পথ বন্ধ হবে। ফলে সরকারি হাসপাতালের সেবার মান উন্নত হবে। এসব কাঠামোগত পরিবর্তনসহ ভবিষ্যতের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য একটি শক্তিশালী জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
[email protected]