>
নরেন্দ্র মোদির পাকিস্তান সফরের পর ভারত–পাকিস্তানের সম্পর্কে যে উষ্ণতা দেখা যাচ্ছিল, ভারতের পাঠানকোটের বিমানঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলায় তা শীতল হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে লিখেছেন পাকিস্তান ও ভারতের দুই সাংবাদিক
বছরটা শেষ হয়েছিল পশ্চিম আকাশে সাতরঙা এক আশা ছড়িয়ে। অথচ নতুন বছর শুরু হলো একরাশ নতুন উদ্বেগ নিয়ে। এ যেন ভারত-পাকিস্তানের সেই আদ্দিকালের দিবারাত্রির কাব্য!
রাশিয়া থেকে কাবুল হয়ে ফেরার পথে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুক করে লাহোরে নেমে পড়লেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের হাত ধরাধরি করে হাঁটলেন। শরিফের পৈতৃক বাড়িতে তাঁর নাতনির বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলেন। সম্পর্কের দিগন্তে এক রংধনু যেন ছড়িয়ে পড়ল। এই অত্যাশ্চর্য কাণ্ড দেখে সবাই চমকিত হলো। মোদি এই আশাটা ছড়িয়ে দিলেন।
আমার মনে কিন্তু সংশয়ের কাঁটাটা খচখচ করছিল। চোখে ভাসছিল ১৯৯৯ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ির লাহোর বাসযাত্রার ছবিটা। দিল্লি থেকে পাঞ্জাবের অমৃতসর হয়ে আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত পেরিয়ে বাজপেয়ির বাস লাহোর পৌঁছাল, প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তাঁকে স্বাগত জানালেন, বাজপেয়ি তাঁকে বুকে টেনে নিলেন, ঠিক যেন ছেলেবেলায় মেলায় হারিয়ে যাওয়া দুই ভাইয়ের পুনর্মিলনের হিন্দি ফিল্মি দৃশ্য। চুয়ে পড়া আবেগের আড়ালে শরিফের সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফ যে ততক্ষণে ভিলেনের কাজটুকু করে ফেলেছেন, কারগিলে সেনা পাঠিয়ে ভারতের জমি দখল করে নিয়েছেন, তা আমরা কেউই বুঝিনি। আমাদের টনক নড়ল যখন, ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী লড়াই শেষে ভারত তার হারানো জমি ফেরত নেয়।
গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর কাকপক্ষীকে টের পেতে না দিয়ে (পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকেও মোদি অন্ধকারে রেখেছিলেন!) মোদি যখন লাহোর যাওয়া মনস্থির করলেন এবং গেলেনও, আমার মনে তখন কারগিলের কুচিন্তাটাই পাক দিচ্ছিল। কেন যেন মনে হচ্ছিল, এমন কিছু একটা ঘটবে যা মোদি-শরিফের মাখামাখিটাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। হলোও ঠিক তাই। পাঞ্জাবের পাঠানকোটে ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে ঘটে গেল ছয় আত্মঘাতী জঙ্গির হানা। এই আক্রমণ চোখে আঙুল দিয়ে এটা দেখিয়ে দিল, আগাম সতর্কতা জারি সত্ত্বেও ভারতের নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা ঠুনকো।
যে নরেন্দ্র মোদি বছর শেষের দিনগুলোতে ঠিক করে ফেলেছিলেন দ্বিপক্ষীয় আলোচনা নতুনভাবে শুরু করতে কে কবে কোথায় কাদের সঙ্গে কথা বলবেন, সেই মোদিই এই মুহূর্তে ঘরে-বাইরে প্রবল চাপের মুখে পড়ে গেছেন। ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের ইসলামাবাদে বৈঠক করার কথা। সেই বৈঠক বাতিল হবে কি হবে না, তা নিয়ে শুরু হয়ে গেছে চুলচেরা বিচার। মাখামাখি ও গলাগলি ভাবটুকু এই হানায় কর্পূরের মতো উবে গেছে ঠিকই, কিন্তু অতীতের মতো দুই দেশ এখনো পর্যন্ত রণংদেহী ভাব নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েনি। পার্থক্য আপাতত এটুকুই।
সব দেশে সব সময় রাজনীতি ও কূটনীতিতে নরম ও কট্টরপন্থীদের অবস্থান দেখা যায়। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কোন ধরনের নীতি গ্রহণ করা দরকার, কূটনীতিকদের মধ্যে তা নিয়ে কখনো মতৈক্য দেখা যায়নি। বরং মতানৈক্যই সব সময় প্রবলভাবে উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদির রাজনীতিতে নরম-সরম ভাবটা কম দেখা যেত। তাঁর ভাবমূর্তিটাই ছিল কাঠখোট্টা টাইপের। সোজা আঙুলে ঘি উঠছে না? তাহলে আঙুলটা বাঁকাও। যে আদর্শে তিনি দীক্ষিত, সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) পাকিস্তান-নীতিও বরাবর কট্টরবাদী। যে দলের তিনি সদস্য, সেই বিজেপির নীতিও সংঘের মতো। অথচ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ইঙ্গিত মোদি দিলেন, তা কিন্তু সংঘাতের বিপরীত। প্রতিবেশী রাষ্ট্রনেতাদের ডেকে তাঁদের এই বার্তাই তিনি দিতে চেয়েছিলেন যে চলুন, সবাই মিলেমিশে হাত ধরাধরি করে থাকি। আপসে মিটিয়ে নিই যাবতীয় বিভেদ।
পরবর্তীকালে মোদি কিন্তু পাকিস্তান-নীতির ক্ষেত্রে একই অবস্থানে থাকতে পারেননি। হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে পাকিস্তানের হাইকমিশনার কেন কথা বলেছেন, সেই ওজর তুলে তিনি পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করে গোসা ঘরে খিল তুলেছিলেন। কিছুকাল পর ফের আলোচনার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলেও কথাবার্তার ধরন নিয়ে গোঁ ধরে বসে থাকায় বৈঠক বাতিল হয়ে যায়। এ যেন ট্রাফিক সিগন্যালে একই সঙ্গে লাল ও সবুজ আলো জ্বেলে রাখার মতো। শপথ গ্রহণের দিন যে ভাই-ভাই ভাবটা দেখিয়েছিলেন, হঠাৎই তা হাওয়া হয়ে গেল। মোদির ভারত পাকিস্তানকে লাল চোখ দেখাতে শুরু করে। প্যারিসের জলবায়ু বৈঠকের আসরে ফের একবার গদগদ হয়ে গেলেন মোদি। শরিফের সঙ্গে কানে কানে কথার মধ্য দিয়ে ঠিক হয় ব্যাংককে দুই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বৈঠক হবে। অতি গোপন সেই বৈঠক হয়ে যাওয়ার পর সবাই তা জানতে পারল। তার কিছুদিন পরই তাঁর বিস্ময়কর লাহোর যাত্রা।
পাঠানকোট হামলার পর পুরোনো প্রশ্নটা আবার নতুন করে উঠতে শুরু করেছে। ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে এস জয়শঙ্করের ইসলামাবাদ যাওয়া উচিত হবে কি না। কট্টরবাদীরা বেশি সরব। একসময় মোদিরই বলা কথা ‘সন্ত্রাস ও আলোচনা একই সঙ্গে চলতে পারে না’ হাতিয়ার করে তাঁরা বলতে চাইছেন, পাকিস্তানে শরিফ অকিঞ্চিৎকর। আসল ক্ষমতা সেনা ও আইএসআইয়ের হাতে। পাকিস্তান শুধু একটাই ভাষা বোঝে। মার। এই মহলের চিরকালীন বিশ্বাস, এমন পাল্টা মার দাও যাতে তাদের কোমর ভেঙে যায়, যাতে বহুদিন তারা কোমর সোজা করে দাঁড়াতে না পারে। এটাই তাদের একমাত্র দাওয়াই। নরমপন্থীরা এই মতের শরিক অবশ্যই নয়। তারা মনে করে সংঘাত এই উপমহাদেশে বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু বয়ে আনবে না। তা ছাড়া, পোখরান-টু ও চাঘাই-টু এরপর শক্তির তারতম্য ও চরিত্রও বদলে গেছে। পাকিস্তানের মতো এক ব্যর্থ রাষ্ট্রকে সংঘাতের ভয় দেখানো কোনো কাজের কাজ হতে পারে না। মোদি আপাতত এই জাঁতাকল পিষছেন।
এটা ঠিক যে পাকিস্তানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর চরিত্র ভারতের মতো গণতান্ত্রিক নয়। নওয়াজ শরিফ একাই একমেবাদ্বিতীয়ম নন। সেনাকে উপেক্ষা করে কিছু করা তাঁর পক্ষে এখনো কঠিন। কতটা কঠিন সেই অভিজ্ঞতা (কারগিল) তাঁর আছে। এটাও ঠিক, শুধু সেনাই নয়, দেশের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইও নীতিনির্ধারণে এক বড় ভূমিকা সব সময় নিয়ে এসেছে। সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনীর স্বার্থও বহু ক্ষেত্রে এক। এই তিন ক্ষমতার অক্ষের পাশাপাশি ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে জঙ্গি সংগঠনগুলোর উপস্থিতি। জয়েশ-ই-মোহাম্মদ বা লস্কর-ই-তাইয়েবা বা এই ধরনের সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনগুলোর ধর্মভিত্তিক হিংস্র আবেদন অগ্রাহ্য করে এগোতে হলে যতটা শক্তিধর হওয়া প্রয়োজন এবং সেনার ওপর যতখানি দখল থাকা দরকার, নওয়াজ শরিফ এখনো ততটা অর্জন করতে পারেননি। এক কথায়, পাকিস্তানে তিনিই একমাত্র দণ্ডমুণ্ডের কর্তা নন। পাশাপাশি এটাও সত্য, ভারত যেমন সন্ত্রাসী হামলার শিকার, পাকিস্তানও তেমনই।
এই মিল-অমিলের মাঝেই ঠিক করা প্রয়োজন ধারাবাহিক পাকিস্তান-নীতি। সেই ধারাবাহিকতায় মোদি বারবার ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন আলোচনা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। পাঠানকোট হামলার পর সেই ব্যাঘাত আরও একবার ঘটলে দুই দেশের বন্ধুতা যাদের পছন্দ নয়, তাদেরই হাত শক্ত করা হবে। গণতন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে সমর্থন দিয়ে তাঁকে আরও শক্তিশালী করে তাঁকে দিয়ে ভারতের উদ্বেগ নিরসনের চেষ্টাই হওয়া উচিত একমাত্র লক্ষ্য। সে জন্য আলোচনা চালিয়ে যাওয়াই একমাত্র পথ। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যাদের নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারে না, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দেওয়ার খেলাটাও ভারতকে খেলতে হবে। মনে রাখতে হবে, আলোচনা ভেস্তে দিলে সবকিছু আবার নতুনভাবে শুরু করতে হবে। সেই শুরুর সময়েও যে আর একটা পাঠানকোট ঘটবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
পশ্চিম আকাশের নিকষ কালো আঁধার ফিকে হয়ে রংধনুর সাত রঙে রাঙা হতে সময় লাগবে। সে জন্য দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের লক্ষ্য স্থির ও মাথা ঠান্ডা থাকা জরুরি। ভারতের পুব আকাশের উদাহরণ দুই দেশের কাছেই রয়েছে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।