অতি নিন্দুকও স্বীকার করবে যে বাংলাদেশে এখন উন্নয়নযজ্ঞ চলছে। পদ্মা সেতু, ঢাকায় কয়েকটি বড় আকারের ফ্লাইওভার, বিভিন্ন জেলায় প্রাইভেট সেক্টরে বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাথমিক কাজকর্ম, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, কয়েকটি সেনানিবাস, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের রাস্তা, ডবলমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল, ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেনের রাস্তা, বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটান ট্রানজিটের জন্য ছোট-বড় নানা অবকাঠামো নির্মাণ, এমনই ছোট-বড় আরও বহু প্রকল্প এখন বাংলাদেশে বাস্তবায়ন হতে চলেছে। এগুলোকে ‘উন্নয়ন’ না বললে কাকে উন্নয়ন বলব?
নানা রকম উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য আমরা বর্তমান সরকারকে সাধুবাদ জানাই। বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ‘মধ্য আয়ের দেশ’ হতে চলেছে। বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে পড়া দেশের জন্য এটা যে কত বড় সুখবর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ একটি দৃষ্টান্ত বলে বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের প্রশংসা করছে, তা সরকার প্রায়ই দাবি করে। জাতিসংঘের এমডিজির অনেকগুলো লক্ষ্য বাংলাদেশ পূরণ করে ফেলেছে। যদিও সিপিডির গবেষণায় দাবি করা হয়েছে: ‘কয়েকটি লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে।’ এমডিজির এসব লক্ষ্য অর্জন শুধু সরকারের কর্মসূচিতে হচ্ছে না, অসংখ্য এনজিও এসব কর্মসূচি নিয়ে বহু বছর যাবৎ কাজ করছে। সরকারের কোনো মন্ত্রীর বক্তৃতায় এনজিওগুলোর এই অবদানের কথা স্বীকার করা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ জানে কারা কোন ইস্যু নিয়ে কত বছর যাবৎ কাজ করছে।
>সরকারের হয়তো ধারণা, ঢাকার সব ফ্লাইওভার নির্মিত হলে যানজট স্বাভাবিক নিয়মেই কমে আসবে। কিন্তু নগর ও যানবাহন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ফ্লাইওভার যানজটকে তেমনভাবে কমাতে পারবে না
একদিকে আমরা দেখছি, বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হতে চলেছে। অপরদিকে দেখছি, বাংলাদেশে কতগুলো সাধারণ কাজ সরকার বাস্তবায়ন করতে পারছে না। অথচ একই সরকার অনেক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ছোট ছোট কাজ করার ব্যাপারে সরকারের দুর্বলতা কোথায়, তা আমাদের চিন্তায় আসেনি। সরকারের কোনো প্রতিনিধি বিষয়টা খোলাসা করবেন কি?
একটি আধুনিক দেশ বা শহরের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ব্যবস্থা থাকা দরকার। শুধু মধ্য আয়ের দেশ নয়, গরিব দেশেও এসব ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। বর্তমান সরকার কী কী ছোট বিষয়ে (মেগা প্রকল্পের তুলনায়) মনোযোগ দেয়নি বা সফল হয়নি, তা এই কলামে তুলে ধরতে চাই।
১. সরকার ঢাকা বা চট্টগ্রাম শহরে একটি আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। যাতে মানুষ স্বল্প খরচে ও সহজে যাতায়াত করতে পারে। যেকোনো বড় শহরের এটা প্রধান শর্ত। সরকার নিজে যদি গণপরিবহন ব্যবসা করতে না চায় (না করাই উচিত), তাহলে উপযুক্ত নীতি, পরিকল্পনা ও প্রণোদনা দিয়ে প্রাইভেট সেক্টরকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে পারত। সরকার তা করেনি। আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী পদ্মা সেতু, চার লেনের রাস্তা, কর্ণফুলী টানেল ইত্যাদি নিয়ে যত কথা বলেন, গণপরিবহন নিয়ে তার ১ শতাংশ কথাও বলেন না। এর রহস্য কী? ঢাকা ও চট্টগ্রামে আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারা সরকারের একটা বড় ব্যর্থতা। ঢাকায় একটা মডেল প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যান্য শহরেও পরে তা বাস্তবায়ন করা যায়।
২. রেল সার্ভিসও একটি নির্ভরযোগ্য গণপরিবহন হতে পারত। বড়, মাঝারি ও ছোট দূরত্বে রেল আরও বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস দিতে পারত। এখন দু-একটা নতুন সার্ভিস হয়েছে। তবে তা আরও বেশি পরিমাণে হতে পারত। পুরোনো রেল সার্ভিসের তেমন আধুনিকায়ন হয়নি; বরং অনেক ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। গরিব ও মধ্যবিত্তের জন্য রেল একটি নির্ভরযোগ্য যানবাহন। অথচ সরকার রেলের ব্যাপারে তেমন মনোযোগ দেয়নি। রেলের রাস্তা বাড়েনি, বগি বাড়েনি, অন্তত দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায়। অথচ প্রাইভেট সেক্টরে আন্তজেলা আধুনিক বাস সার্ভিস বিকশিত হয়েছে। এতে সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই। অভিযোগ আছে, সেই বাস সার্ভিসকে জনপ্রিয় করতেই রেলের কর্মকর্তারা ইচ্ছে করে রেলকে দুর্বল করে রেখেছেন। রেলের ‘কালোবিড়াল তত্ত্ব’ তো এক রেলমন্ত্রীই ফাঁস করে গেছেন। সেই কালোবিড়াল কিন্তু এখনো ধরা হয়নি।
৩. ফুটপাত প্রধানত পথচারীদের জন্য। কিন্তু ঢাকা ও অন্যান্য শহরের অন্তত ৫০ শতাংশ ফুটপাত হকারদের দখলে। কোনো মেয়র, জেলা প্রশাসন বা মন্ত্রণালয় ফুটপাত হকারমুক্ত করতে পারেনি। হকারদের বিকল্প জায়গার ব্যবস্থা করতেও পারেনি। সব হকারকে বিকল্প জায়গা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব হতে পারে না। সরকার কয়েকটা হকার মার্কেটের জায়গা দিতে পারে। যেখানে নিয়মকানুনের ভিত্তিতে হকাররা ব্যবসা করতে পারে। এ ছাড়া নাইট মার্কেট, সান্ধ্য বাজার, উইকেন্ড মার্কেট ইত্যাদি নামে নানা কিছু হতে পারে। কিন্তু ফুটপাত হকারের জায়গা নয়, এটা পথচারীর জন্য। যারা শহরে এতগুলো ফ্লাইওভার বানাতে পারে, তারা ফুটপাত হকারমুক্ত করতে পারে না? অনেকে বলেন, এর জন্য আমাদের রুগ্ণ রাজনীতি, পুলিশের দুর্নীতি ও সরকারি নানা স্তরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতিই বড় বাধা। ফুটপাত যদি পথচারীরা ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারত, তাহলে বহু মানুষ স্বল্প দূরত্বে রিকশা, ট্যাক্সি বা বাসে চড়ত না, হেঁটেই যেত। ফুটপাতের হকারদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা কঠিন কিছু নয়।
৪. নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নাগরিকদের জন্য কোনো ব্যাপক আবাসন পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করতে পারেনি। রাজউক বেশি মনোযোগ দিয়েছে উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের জমির জন্য, যা সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত হয়নি। প্রতিটি বড় শহরে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে ছোট, মাঝারি ও বড় মাপের আবাসন প্রকল্প নেওয়ার সুযোগ ছিল।
৫. ঢাকার যানজট এখন দেশের প্রধান সমস্যা হয়ে উঠেছে। সরকার সেদিকে তেমন মনোযোগ দিচ্ছে না। সরকারের হয়তো ধারণা, ঢাকার সব ফ্লাইওভার নির্মিত হলে যানজট স্বাভাবিক নিয়মেই কমে আসবে। কিন্তু নগর ও যানবাহন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ফ্লাইওভার যানজটকে তেমনভাবে কমাতে পারবে না। কাজেই দেখা যাচ্ছে, কার্যকরভাবে যানজট কমাতে ও ঢাকা শহরে স্বাভাবিক চলাচলের নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য সরকার কোনো পরিকল্পনা এখনো করছে না। যানজট এ অবস্থায় থাকলে আর পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকায় চলাচলের জন্য ‘হেলিকপ্টার সার্ভিস’ গড়ে তুলতে হবে।
আমরা সবাই চাই, বাংলাদেশ যত দ্রুত সম্ভব মধ্য আয়ের দেশ হয়ে উঠুক। সরকার যেসব মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে, তাও নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হোক। সরকার আরও কিছু মেগা প্রকল্প গ্রহণ করুক। কিন্তু যেসব প্রকল্পে সাধারণ মানুষ বেশি উপকৃত হবে, সরকার সেসব প্রকল্প কেন অগ্রাধিকার পাবে না?
আমরা চাই, এই নিবন্ধে উল্লিখিত কয়েকটি ছোট কাজে (মেগা প্রকল্পের তুলনায়) যেন সরকার মনোযোগ দেয়। এর ফলে জনগণ উপকৃত হবে, সরকারও জনপ্রিয় হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।