হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক বিপজ্জনক। আর মোটরবাইক ছাড়া হেলমেট ভয়াবহ। এই কথাটা ফেসবুকে মিম হয়েছে। হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক বিপজ্জনক আরোহীর নিজের জন্য।
আর মোটরবাইক ছাড়া হেলমেট? সেটাও নিজের ভালোর জন্যই। এতে আপনি প্রাগৈতিহাসিক যুদ্ধে, প্রস্তরযুগের রণক্ষেত্রে ভালো করবেন। মনের সুখে পাথর ছুড়ে মারবেন। ইষ্টক বর্ষণ করবেন। কিন্তু অপর পক্ষের ছোড়া ঢিল আপনার মাথায় আঘাত করতে পারবে না। কী সুখ! কী আনন্দ!
প্রাগৈতিহাসিক কাল চলে গেল। প্রস্তরযুগের পরে এল লৌহযুগ। আবিষ্কৃত হলো তরবারি। চাপাতি। কিরিচ। এবার আপনি হেলমেট চাপালেন মাথায়। হাতে নিলেন নাঙ্গা তরোয়াল। ছুটে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। এবার কিন্তু আপনাকে একটা সিস্টেমের অধীন আসতে হবে। আপনার সেনাপতি থাকবে। আপনি একটা বাহিনীর সদস্য। সেনাপতি হুকুম দেবেন, হাতিয়ার তোল। অমনি আপনি হাতে কিরিচ নিয়ে নেবেন। মাথায় হেলমেট। তারপর তিনি বলবেন, দল, ডাবল মার্চ। আপনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে অংশ নেবেন। সামনে কিশোর-বিদ্রোহীরা। স্কুলের বাচ্চা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছে। আপনারা হামলে পড়লেন। লাঠিসোঁটা নিয়ে। কিংবা ওই একদল সাংবাদিক এসেছে ঘটনাস্থলে। হুকুমদাতার, অর্থাৎ দেশ ও দশের তারা প্রধান শত্রু, যেমন জ্বরের রোগীর প্রধান শত্রু থার্মোমিটার। থার্মোমিটার আছে বলেই জ্বর আসে। জ্বর কত তা জনতা জেনে যায়। কাজেই জ্বর সারাতে হলে ভেঙে ফেলতে হবে রাজ্যের সব থার্মোমিটার। তেমনি শহরের জ্বর কমাতে হলে ভাঙতে হবে সাংবাদিকদের কোমর। পেটাও।
হেলমেট বাহিনীর জয়জয়কারে ধ্বনিত আকাশ-বাতাস। সাংবাদিকনেতারা চিঁচিঁ করছেন। এই হেলমেট বাহিনীর পরিচয় ফাঁস করতে হবে। এদের ধরতে হবে। এদের বিচার করতে হবে। হেলমেট খুলে ফেলে রাতের বেলা আপনি উল্লাস করবেন। আপনিও গলা মেলাতে পারেন সাংবাদিকনেতাদের সঙ্গে, ধরো ধরো এই হেলমেট বাহিনীকে। ধরে ধরে বিচার করো। তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে পারেন। কে ধরবে আপনাকে? তুমি চোরেরে কও চুরি করো গৃহস্থে কও ধরো ধরো...তবে আজকের অবস্থা আরও খারাপ। চোরকে চুরি করতে যিনি বলেন, তিনি আর গৃহস্থকে ধরতে বলেন না। তিনি বলেন, না, কোথাও চুরি হয়নি তো। আর চোরকে ধরবই-বা কী করে। কারণ, চোরের মাথায় তো ছিল হেলমেট।
আমাদের আদরের সন্তানদের আমরা কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাই মানুষ হওয়ার জন্য। হেলমেট বাহিনীর সদস্য হওয়ার জন্য নয়। আমাদের সন্তানদের হাতে থাকবে বই, হাতে থাকবে কলম, হাতে থাকবে শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উপকরণ, ঈদের উপহার। তার বদলে তাদের হাতে কিরিচ। তাদের হাতে তরবারি। আমরা যখন তাদের কলেজে পাঠিয়েছিলাম, আমাদের স্বপ্ন ছিল, তাদের মাথায় উঠবে কনভোকেশন বা গ্র্যাজুয়েশনের সেই টুপিটা। তার বদলে তাদের মাথায় উঠল হেলমেট!
আপনি একবার কিশোরদের পেটাবেন। আরেকবার পেটাবেন কোটাবিরোধীদের। বারবার পেটাবেন সাংবাদিকদের। তো মাঝখানের দিনগুলোতে আপনি কী করবেন? ঘরে বসে থেকে আঙুল চুষবেন? নাকি বসে বসে ফিজিকস-কেমিস্ট্রি পড়বেন, ইন্টেগ্রাল ক্যালকুলাস ডিফরেনশিয়াল ক্যালকুলাস করবেন? ও! আপনি সুবোধ বালক! তা তো হয় না। কাজেই আপনি বেরিয়ে পড়বেন। হকার বসাবেন। হকার তুলবেন। চাঁদা খাবেন। মার্কেটে মহড়া দেবেন। প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। সাংবাদিক পেটানোর সময় আপনাকে ‘ব্যবহার’ করা হবে বছরে একবার, বাকি সময় আপনি বসে বসে নিউটনের তৃতীয় সূত্র পাঠ করবেন, প্রয়োগ করবেন না? প্রথম সূত্র প্রয়োগ করবেন না? বাহির হইতে বল প্রয়োগ না করিলে স্থির বস্তু স্থির থাকিবে, গতিশীল বস্তুর গতির কোনো পরিবর্তন হইবে না। বাহির হইতে বল প্রয়োগ হইল না, বরং উৎসাহ আসিল—হেলমেট মাথায় লাঠি হাতে আপনি একবার গতিশীল হয়ে গেছেন, আর আপনি থামবেন কী প্রকারে? কাজেই চলো, নিউমার্কেটে দুই দোকানির বচসা হয়েছে, থামাতে যাই। লেগে গেছে লড়াই। চলো চলো। ঢাকায় এত ইটও ছিল, নিউমার্কেট লড়াইয়ের আগে কে জানত? শুধু ইষ্টকে কুলাচ্ছে না। হেলমেট বাহিনী, তৈরি হও। হাতে তুলে নিলেন কিরিচ। হাতে তুলে নিলেন তরবারি। আক্রমণ করো। চলল আক্রমণ।
যাকে আপনি কোপাচ্ছেন, তাকে আপনি চেনেন না। সে আপনার কোনো দিনও শত্রু ছিল না। আপনার বাড়া ভাতে ছাই তো দেয়নি, সে নিউমার্কেট এলাকার কর্মচারীই নয়, সে একজন কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যান। বাইরে থেকে এসেছে। হয়তো কোনো পার্সেল সে আপনাকেই পৌঁছে দেবে বলে রওনা দিয়েছে। কোপাও কোপাও। আহা, নাহিদ। তাঁর স্ত্রীর হাতে মেহেদি। তঁাদের বিয়ে হয়েছে সাড়ে ছয় মাস হলো। তাঁর স্ত্রীর হাতে লেখা—আই লাভ ইউ নাহিদ। আপনি নাহিদকে কোপাচ্ছেন। কেন? কীভাবে সম্ভব? আপনাকে কি মাতৃগর্ভে দশ মাস থাকতে হয়নি? আপনার জন্মের পর বাবা কি আজান দেননি? আপনি কি ছোট ভাইবোনকে আদর করেননি? আপনি কি ‘আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা’ আবৃত্তি শোনেননি? আপনি কি মানুষ না? অবশ্যই আপনি মানুষ ছিলেন। কিন্তু ওই আক্রমণের মুহূর্তে আপনি হেলমেট বাহিনী। আপনার কাজ কোপানো। নাহিদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত শুধুই কোপ আর কোপ! সার্কাসের খাঁচা থেকে বাঘ বেরিয়ে গেছে। একবার সে রক্তের স্বাদ পেয়েছে, এবার সে কার কথা শুনবে!
আপনাকে কি গ্রেপ্তার করা হবে? বিচারের মুখোমুখি করা হবে? হতে পারে, কারণ খাঁচার বাঘ জনপদে ঢুকে মানুষ মারতে শুরু করলে সার্কাসের রিংমাস্টার তাকে আটকানোর চেষ্টা করবেন।
কিন্তু আমরা কী করব? আমাদের আদরের সন্তানদের আমরা কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাই মানুষ হওয়ার জন্য। হেলমেট বাহিনীর সদস্য হওয়ার জন্য নয়। আমাদের সন্তানদের হাতে থাকবে বই, হাতে থাকবে কলম, হাতে থাকবে শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উপকরণ, ঈদের উপহার। তার বদলে তাদের হাতে কিরিচ। তাদের হাতে তরবারি। আমরা যখন তাদের কলেজে পাঠিয়েছিলাম, আমাদের স্বপ্ন ছিল, তাদের মাথায় উঠবে কনভোকেশন বা গ্র্যাজুয়েশনের সেই টুপিটা। তার বদলে তাদের মাথায় উঠল হেলমেট!
ও আমার দেশ, ও আমার ক্ষমতা, ও আমার নেতা, ও আমার সমাজপতি, ও আমার দল-গোষ্ঠী-লীগ, আমার নিষ্পাপ তরুণদের ফিরিয়ে দাও।
● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক