ছাগল একটি নিরীহ প্রাণী। তা গল্প আছে; একজন অতি আধুনিকা মা তাঁর শিশুপুত্রকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্লে গ্রুপে ভর্তি করে দিয়ে এসেছেন। ক্লাসটিচার শিশুটিকে যতই জিজ্ঞেস করেন তার পিতার নাম কী, সে উত্তর দেয়, ‘ড্যাডি’। অবশেষে মরিয়া হয়ে টিচার ‘তোমার মা তোমার বাবাকে কী বলে ডাকেন জিজ্ঞেস করতেই সে ঝটপট জবাব দিল, ‘ছাগল’। গল্পটির মধ্যে যথেষ্ট হাসির খোরাক থাকলেও একটা নির্মম সত্যও আছে বটে। জগৎ-সংসারে এমন কিছু লোক আছেন, যাঁরা এতটাই নিরীহ প্রকৃতির যে তাঁদের আপনজন তাঁদের স্নেহবশত ‘ছাগল’ আর স্নেহের আধিক্য হলে ‘রামছাগল’ বলে অভিহিত করতে কার্পণ্য করেন না।
সে যা হোক, আমাদের মাতৃভাষায় একটি প্রবচন আছে: পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়! এ প্রসঙ্গে দুটি মজার চটি গল্পও আছে: হলিউডের একটি স্টুডিওর পেছনে দুই ছাগল একটি বই থেকে নির্মিত চলচ্চিত্রের ফিল্ম চিবিয়ে খাচ্ছিল। তাদের মধ্যে একটি হঠাৎ ‘আহ, বেশ মজার’ বলতেই অপরটি বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, তবে বইটার মতো অত মজার নয়।’ আর সরদার খুশবন্ত সিংয়ের লেখায় পড়েছিলাম—ইন্ডিয়ার একটি ডাকবাংলোর পরিদর্শন বইয়ে পিডব্লিউডির ইঞ্জিনিয়ার লিখেছিলেন, ‘ডাকবাংলোর চতুর্দিকে বেড়া দেওয়া দরকার। বেড়া না থাকায় বারান্দায় রাখা পূর্ব কাজের প্রাক্কলনের অর্ধেক আমার কয়েক মিনিটের অনুপস্থিতিতে ছাগলে খেয়ে ফেলেছে। সেটার নিচে আরেকজন লিখেছেন, ‘পিডব্লিউডির প্রাক্কলনগুলোর গুণগত মান এমনই যে ছাগলও পুরোটা খেতে অনীহা প্রকাশ করেছে।’
হ্যাঁ, ছাগল আমাদের দেশের অতিপরিচিত গৃহপালিত পশু। পরিসংখ্যান অনুসারে, পৃথিবীতে ছাগল উৎপাদনের দিক থেকে আমরা চতুর্থ এবং এই উৎপাদনের সিংহভাগ কিন্তু আসে গ্রামের গরিব জনসাধারণ, বিশেষত যেসব নারীকে আমরা ‘বেওয়া’ বলে অভিহিত করে থাকি, তাদের থেকে। তাই এদের সাহায্যার্থে এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছাগল প্রদান প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু এ দেশে নিন্দুকের অভাব নেই। প্রকল্পটিও আর বেশি দূর এগোল না।
ছাগলের চামড়া অধিক মূল্যবান আর দুধও খুব উপকারী। মহাত্মা গান্ধী সব সময় ছাগদুগ্ধ খেতেন এবং এতদুদ্দেশ্যে তাঁর দুটি ছাগল সদা সঙ্গী থাকত। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের পর সাম্প্রদায়িক বিবাদের কারণে তিনি ছাগল দুটিসমেত আমাদের নোয়াখালীতে এসেছিলেন। দুষ্ট লোক সব জায়গায়ই আছে, কিছু দুষ্ট লোক তাঁর ছাগলগুলো চুরি করে নিয়ে খেয়ে ফেলেছিল।
তা নোয়াখালী বলতে মনে পড়ে গেল, ওখানে দুটি জায়গার নাম ছাগলনাইয়া ও পরশুরাম। একবার হয়েছে কি, ওই দুই জায়গায় আমাদেরডাকঘরের দুই কর্মচারী একটি পত্রের বিলি প্রসঙ্গে অনেক চিঠি চালাচালির পর একজন অপরজনের উদ্দেশে নাকি লিখেছিল, ‘আমি ছাগলনাইয়ার ছাগল আর তুমি পরশুরামের পশু, এবারে ক্ষ্যান্ত দেই।’
আর পাঁঠা বলতেও মনে পড়ে গেল, পাঁঠার গায়ে কিন্তু অনেক গন্ধ। কিন্তু পাঠানেরা কদাচিৎ গোসল করে বিধায় তাদের গায়ের গন্ধ নাকি পাঁঠার গায়ের গন্ধকেও ছাড়িয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে গল্প শোনা যেত: একজন বাঙালি, একজন পাঞ্জাবি ও একজন পাঠান বাজি রেখে পাঁঠার সঙ্গে পরপর ঘুমাতে গিয়ে বাঙালি ১০ মিনিট ও পাঞ্জাবি ১৫ মিনিট পরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু পাঠানের প্রবেশের পর আধা ঘণ্টার মাথায় পাঁঠাই বেরিয়ে এল। তা গল্প গল্পই।
ছাগলের বাচ্চা হয় সাধারণত দুটি, কখনো–বা তিনটিও হয়। সে ক্ষেত্রে দুটি ছাগশিশু যখন মায়ের দুই স্তনের বোঁটায় মুখ লাগিয়ে দুধ পান করতে থাকে, তখন তৃতীয়টি কেবলই লাফায়। আর এ থেকেই বাংলা ভাষায় ‘ছাগলের তিন নম্বর ছানাটির মতো লাফানো’ উপমাটির উৎপত্তি।
ঈশপের নীতি গল্পেও ছাগলের দেখা মেলে: পাহাড়ের এপারে এক উঁচু জায়গায় একটি ছাগল চরছিল। তাকে দেখে এক বাঘের খুব লোভ হলো। কিন্তু বাঘের পক্ষে অত উঁচুতে ওঠা সম্ভব নয়। তাই সে নিচ থেকে ছাগলকে উদ্দেশ করে উচ্চ স্বরে বলে উঠল, ‘ভাই ছাগল, অত উঁচুতে উঠে কেন? যদি পড়ে যাও, তাহলে তো নির্ঘাত মারা যাবে। তা ছাড়া ওখানকার ঘাসও তো ভালো নয়, এখানকার ঘাস ভালো। তাই নিচে নেমে এসো।’ ছাগল তখন সবিনয়ে প্রত্যুত্তর করল, ‘আমি নিচে নামতে পারব না। কারণ, আমার বুঝতে বাকি নেই যে আমার আহারের জন্য নয়, বরং তোমার আহারের জন্য আমায় নিচে আসতে বলছ।’ ছাগল তাই অত বোকা নয়।
পরিশেষে শৈশবে শিক্ষকের কাছ থেকে শোনা আমার প্রিয় চটি গল্পটি, যেটা ছাগলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত: গাঁয়ের একটি বিয়ের মজলিশে তিনজন লোক এসেছেন—তাঁদের একজনের বাঁ হাতের আঙুলে হিরের আংটি, আরেকজনের সামনের একটি দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো এবং অপরজনের মাথায় মলমলের সুন্দর পাগড়ি। যাঁর যা কিছু দ্রষ্টব্য, তা দেখাতে হবে তো! তাই প্রথমজন হঠাৎ বাঁ হাত দিয়ে মাটি থেকে প্রায় তিন ফুট উচ্চতা নির্দেশ করে সবার উদ্দেশে বলে উঠলেন, ‘আচ্ছা বলুন তো, এই পরিমাণ বকরির দাম কত হতে পারে?’ সবাই তাঁর হিরের আংটি দেখে নিল। তখনকার সময়ে ছাগলের দাম ছিল ২০-২৫ টাকা। অতএব, যাঁর দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো, তিনি দন্ত যতটা সম্ভব বিকশিত করে বলে উঠলেন, ‘বিশ বা পঁচিশ টাকা হবে।’ যিনি মলমলের পাগড়ি পরিহিত, তিনি ভাবলেন, এই তো মোক্ষম সময়। অতএব, তিনি মস্তক যতটা সম্ভব আন্দোলিত করে বললেন, ‘হাঁ-হাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন।’
আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷