ছাগল

ছাগল অনেক রকম। বিশ্বব্যাপী বিচিত্র ছাগলামির দৃষ্টান্তও অজস্র। কিন্তু মানুষের জীবন পরিত্যাগ করে ছাগলে পরিণত হওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে এবারই প্রথম। তরুণ ব্রিটিশ গবেষক টমাস থোয়েটস মানুষের জীবন পরিত্যাগ করে ছাগলত্ব বরণ করেন। তবে তা চিরদিনের জন্য নয়, ছয় দিনের জন্য।
ছাগলামির ক্ল্যাসিক দৃষ্টান্ত যদি কেউ স্থাপন করতেই পারেন, বর্তমান বিশ্ব মিডিয়া চুপ করে বসে থাকতে পারে না। টমাস পেশায় ছিলেন কনসেপ্ট ডিজাইনার। বিবিসির টুডে অনুষ্ঠানে গত হপ্তায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর ছাগলত্ব বা ছাগলের জীবন বরণের পটভূমিসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, কিছুদিন তিনি মানসিক অবসাদে ভুগেছেন। তিনি তাঁর ভাতিজির কুকুরটাকে দেখাশোনা করতেন। কুকুরটা মনের সুখে লাফালাফি করত। তাঁর খুব ঈর্ষা হয়। ভাবেন, মানুষ না হয়ে যদি কোনো জন্তু হয়ে জন্মাতেন, জীবনটা কী সুখেরই না হতো! সেই বোধ থেকেই তাঁর ছাগল হওয়া এবং ছাগলত্ব গ্রহণ করা।
ছয় দিনের জন্য ছাগলের জীবন ধারণ করার আগেই টমাসের মধ্যে ছাগলামির পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে। তিনি ভাবেন, জীবজন্তুর মনস্তত্ত্ব ভালোভাবে অধ্যয়ন করতে হলে তাদের জীবনাচরণ রপ্ত করা উচিত। তাদের মতো জীবনযাপন করতে হবে। এ ধরনের গবেষণার জন্য অর্থের প্রয়োজন। ইউরোপ-আমেরিকায় তার অভাব হয় না। আবেদন করা মাত্র ওয়েলকাম ট্রাস্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান তাঁকে কিছু অর্থ বরাদ্দ করে। তিনি দেহ-মন নিয়ে নেমে পড়েন গবেষণায়। এবং মানবত্ব বিসর্জন দিয়ে ছাগলত্ব গ্রহণ করেন।
বিবিসির অ্যাঙ্কর টমাসের কাছে জানতে চান, তা দুনিয়াতে এত পশু থাকতে ছাগলকেই তিনি কেন বেছে নিলেন। টমাস জানান, গবেষণা করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করেছেন, প্রাচীন গুহাচিত্রের অনেকগুলোতেই অর্ধেক মানব আর অর্ধেক পশু। কোনো কোনোটিতে অর্ধেক নর বা নারী এবং অর্ধেক ছাগলের শরীর। তাতে তাঁর ধারণা হয়, মানুষের সঙ্গে ছাগলের সম্পর্ক আদিমকাল থেকেই খুব ঘনিষ্ঠ। সেই কারণে পশুর মধ্যে ছাগলের জীবনই তিনি যাপন করার জন্য বেছে নেন।
তাঁর ভাষায়: ‘আমি চলে যাই সুইজারল্যান্ডের আল্পসের পার্বত্য অঞ্চলে। সেখানকার এক ছাগলের খামারে কিছুদিন কাটাই। আমার ছাগল হওয়ার প্রকল্পকে পূর্ণতা দিতে যারা নকল হাত-পা বানায়, তাদের কাছে যাই। তাদের দিয়ে ছাগলের কৃত্রিম চারটি পা বানাই। পায়ের খুর পর্যন্ত। চার হাতে-পায়ে ভর দিয়ে ছাগলের মতো হাঁটা রপ্ত করি।’
টমাস আর যে কাজটি করেন তা আরও চমকপ্রদ। শুধু ছাগলের পালের সঙ্গে চার পায়ে হাঁটা নয়, ছাগলের মতো ঘাস খাওয়া শুরু করেন। ‘সে জন্য সেলুলোজ হজম করতে আমাকে শরীরে আলাদা একটি পাকস্থলীও সংযোজন করতে হলো।’ তিনি জানান, ছাগলের অ্যানাটমি ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেন। ছাগল হওয়ার প্র্যাকটিক্যাল সাধনা শুরু হয়। ছাগলদের ঘরে থাকা, খাওয়া, একসঙ্গে ঘুমানো, অর্থাৎ ছাগলরা যা যা করে, তার সবই। ‘আমি কয়েক দিনের জন্য একেবারেই ছাগল হয়ে যাই’, বলেন টমাস।
টমাস ঘোষণা দিয়ে ছাগল হলেও পৃথিবীর কোনো কোনো দেশের বহু মানুষ আপনাআপনিই ছাগলে পরিণত হয়। তাদের ছাগলের নকল পা লাগানোর প্রয়োজন হয় না। ঘাস ও কাঁঠালের পাতা খেয়ে হজম করার জন্য পৃথক পাকস্থলীরও প্রয়োজন নেই। তারা ছাগলের খাসির রোস্ট ও কাচ্চি বিরিয়ানিই পছন্দ করে। তারা দুই পায়েই হাঁটে। মানুষের মতোই কথা বলে। গণপরিবহনে গিয়ে অফিস-আদালত করে, কাজও করে, ঘুষও খায়, পাজেরো চালায়, নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জনপ্রতিনিধিও হয়, পত্রিকায় লেখালেখি করে, গোলটেবিলে ও বক্তৃতার মঞ্চে বক্তৃতা দেয়, কিন্তু তাদের কাজকর্মে প্রকাশ পায় ছাগলামি বা ছাগলত্ব।
নিরীহ ছাগলকে মানুষ যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক, পৃথিবীতে বাংলাদেশই শুধু দিয়েছে ছাগলকে সর্বোচ্চ মর্যাদা। বিএনপি-জামায়াত জোটের সময় প্রধানমন্ত্রীর এক প্রাজ্ঞ মুখ্য সচিবকে এ ব্যাপারে ধন্যবাদ জানাতে হয়। তিনি ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট বা বঙ্গীয় কালো বকরিকে জাতীয় পশুর মর্যাদা না দিলেও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পরে ডেপুটি জাতীয় পশুর মর্যাদা দেন। তখন ছাগলের সৌভাগ্য হয়েছিল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পাজেরোতে এক উপজেলা কমপ্লেক্স থেকে আরেক উপজেলা সদরে সফর করার। প্রমোশন পাওয়ার আশায় অনেক কর্মকর্তা ছাগলের সঙ্গে গ্রুপ ছবি তুলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়েছেন।
একটি বিষয়ে টমাস সম্ভবত সঠিক। একটি সময় তিনি ছিলেন বিষাদগ্রস্ত। মনমেজাজ ছিল খারাপ। তখনই তাঁর নির্বোধ প্রাণী ছাগলের জীবন গ্রহণ করার বাসনা হয়। কিন্তু কোথাও যদি সমগ্র জাতিই হতাশায় বিষাদগ্রস্ত হয়, সেখানে কী উপায়? পুরো জাতির পক্ষে তো নকল পা ও পাকস্থলী লাগিয়ে ছাগলে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়।
ছাগল সব সমাজেই আছে। তবে যে সমাজে ছাগলের সংখ্যা যত কম, সে সমাজই সবচেয়ে ভালো সমাজ। আসলে ছাগলামি বা ছাগলত্ব নয়, মানুষের জন্য মনুষ্যত্বই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা সাধনাসাপেক্ষ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।