পৃথিবীর ক্রীড়াজগতে প্রতিযোগিতার জন্য একটি নতুন বিষয় যোগ হলো গত হপ্তায়। মুষ্টিযুদ্ধ প্রতিযোগিতা আমরা উপভোগ করেছি। মল্লগীর মোহাম্মদ আলী ঘুরে গেছেন বাংলাদেশ। কুস্তি প্রতিযোগিতা শিশু-কিশোরদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। বক্সিং মূলত ঘুষির খেলা। চড়-থাপ্পড়েরও যে প্রতিযোগিতা হতে পারে, তা আগে মানুষের মাথায় আসেনি। তা এলে চড়-থাপ্পড় প্রতিযোগিতাও অলিম্পিকের একটি আইটেম হতো।
রাশিয়ায় সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম চড় প্রতিযোগিতা হয়ে গেল সেদিন। কে কত জোরে চড় মারতে পারে এবং তা সহ্য করার ক্ষমতার ওপর এক প্রতিযোগিতার আয়োজন হয় সে দেশে। সেই চড়-থাপ্পড় প্রতিযোগিতার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। রুশ দেশের বিয়ারস নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ওই ভিডিওটি প্রচারিত হয়। চড়ের ঠাস ঠাস শব্দ যে দর্শকেরা খুবই উপভোগ করছে, তা ভিডিওতে দেখা যায়। এই নতুন খেলায় প্রথমে এক প্রতিযোগী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে সর্বশক্তি দিয়ে একটি চড় মারেন। চপেটাঘাতপ্রাপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রত্যুত্তরে তাঁকে মারেন আরেক চড় কষে। চলছে সশব্দে চড় মারামারি। প্রতিযোগিতায় একপর্যায়ে একজনকে হার মানতেই হয়। কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল পার হয়ে ফাইনালে একজন শিরোপা পান। তিনি দেন চপেটাঘাত সইবার অপার সহ্যশক্তির পরিচয়।
পৃথিবীতে এমন অনেক ভূখণ্ড আছে, যেখানে চড়-থাপ্পড় প্রতিযোগিতা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সেখানে জন্মের পরে অনেক শিশু হাসপাতালের দোলনায় শুয়ে প্রথম যে শব্দ শোনে, তা চড়-থাপ্পড়ের ঠাস ঠাস আওয়াজ। সেখানে অনেকের মৃত্যুর পরেও যদি চেতনা থাকত, তাহলে শুনতে পেত তার মৃত্যুকে ঘিরে চলছে চড় প্রতিযোগিতা। সেই দেশে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ চড়।
চড় অনেক প্রকার। মায়ের হাতের চড় এক জিনিস। স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকার হাতে চড় আরেক জিনিস। পুলিশের হাতের তালুর পরশ সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। জনপ্রতিনিধির চপেটাঘাত আরেক জিনিস। ছাত্র-যুবনেতার চড়ের স্বাদ আলাদা। কিন্তু প্রেমিকার হাতের চড় অতি মিষ্টি। স্বামীর হাতের চড় যে একেবারেই তা নয়, তা বাঙালি নারীর চেয়ে আমেরিকার নারী যে কম জানে, তা নয়।
কিছু চড়ের স্মৃতি বাঙালি পুরুষ আমৃত্যু ভুলতে পারে না। কোনো নির্জন জায়গায় কোনো তরুণীকে একাকী পেয়ে অযাচিত প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে যুবতীর হাতের চপেটাঘাত কাকপক্ষীটি না দেখলেও তার ব্যথা যতটা নয়, সে চড়ের জ্বালা তুষের আগুনের মতো বুকে জ্বলতে থাকে।
গণতন্ত্রের যেমন অনেক সূচক আছে, চড়ের ক্ষেত্রেও সে রকম। মধুর চড়ও আছে। বিশেষ মুহূর্তে ‘দুষ্টু কোথাকার’ বলে প্রেমিকা যখন ছেলেটির গালে চড় দেয়, তা বড়ই মিষ্টি। চপেটাঘাত সাধারণত গালেই দেওয়া হয়, তা সে চড় প্রেমিকার হোক বা কোনো মাননীয় নেতার হাতেরই হোক।
বাঙালি চড়-থাপ্পড়কে খুবই গুরুত্ব দেয়। কারও ওপর রেগে গেলে বলে, ‘এক চড় মেরে বত্রিশ পাটি দাঁত ফেলে দেব।’ তবে চড় খেয়ে দাঁত খোয়া গেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল, কিন্তু কানের বারোটা বেজেছে বহু মানুষের। একজন শিক্ষক এক যুবনেতার থাপ্পড় খেয়েছেন। তারপর থেকে তিনি বাঁ কানে শুধু শো শো আওয়াজ শোনেন, অন্য কোনো শব্দ নয়।
কয়েক মাস আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত এক রোগীকে দেখতে গিয়েছিলাম। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও গিয়েছিলেন। কান ধরে ওঠবসের আগে অত্যন্ত বলিষ্ঠ তালুর একটি চড়ও তিনি সহ্য করেন। তিনি একজন শিক্ষক। যিনি থাপ্পড় মারেন তিনি একজন মাননীয় জনপ্রতিনিধি।
বঙ্গসমাজে চড়-থাপ্পড় নেই কোথায়? অফিস-আদালত, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, লঞ্চ-টার্মিনাল, হাসপাতাল, নির্বাচন কেন্দ্র—সর্বত্র আছে। হিজরি রমজান সংযমের মাস। এই তো পয়লা রমজানেই ইফতার পার্টির আয়োজনটি বাগ্বিতণ্ডার পরে হাতাহাতি ও চড়-থাপ্পড়ের ভেতর দিয়ে সমাপ্তি ঘটে। কোথায় শরবতের গ্লাস আর কোথায় ছোলা, পেঁয়াজি, শসা, বেগুনি?
হাসপাতালে হাতাহাতি থেকে চড় প্রতিযোগিতা আজকাল হামেশাই ঘটছে। রোগীর স্বজনদের সঙ্গে হাসপাতালের বা ক্লিনিকের কর্মচারী ও ডাক্তারদের চড় বিনিময়। তার অনিবার্য পরিণাম আকস্মিক ধর্মঘট। তাতে বিনা চিকিৎসায় রোগী ছটফট করুক বা মরে তো মরুক। চড়-থাপ্পড়ের জন্য উপলক্ষের অভাব নেই। জন্ম ও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জন্মের পর ডাক্তারের চেষ্টা সত্ত্বেও অথবা অবহেলায় বাচ্চা মারা গেছে, শুরু হয়ে যায় চড় মারামারি। অনেকের বিশ্বাস হাসপাতালের বারান্দা পর্যন্ত নেওয়ার পর অথবা ভর্তি হওয়ার পর মানুষ মারা যাবে কেন? রোগীর অন্তিম যাত্রার পর তার সঙ্গের যারা ইহজগতে রয়ে গেল, তারা তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আয়োজন করার আগে শোকবিহ্বল অবস্থায় চড় প্রতিযোগিতায় শরিক হন। মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চড় দিয়ে শুরু, তারপর জানাজা, দাফন ও কুলখানি।
বাংলার মাটিতে সবচেয়ে বেশি চড়-থাপ্পড় এস্তেমাল হয় নির্বাচনের সময়। দলের বিদ্রোহীদের মধ্যে এবং প্রতিপক্ষের নেতা ও ক্যাডারদের মধ্যে। তবে মানবজীবনে যত রকম নিষ্ঠুর কর্ম আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কম মাত্রার নিষ্ঠুরতা চড়-থাপ্পড়। আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে হাতের তালু অনেক নিরাপদ।
বাঙালি আজন্ম চড়-থাপ্পড়ে এতটাই অভ্যস্ত যে কোনো দিন যদি বিনোদনের জন্য চড় প্রতিযোগিতা চালু হয় (অনুকরণপ্রিয় বাঙালি তা করবেই), বঙ্গীয় প্রতিযোগিতাকারীদের তালিম দেওয়ার জন্য রাশিয়া থেকে কোচ আনার প্রয়োজন হবে না। বরং এ দেশ থেকে রুশরা কোচ ভাড়া নিতে পারে।
একটি সভ্যসমাজে—বিশেষ করে যে দেশ প্রায়োন্নয়নশীল, সেখানে অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত্রতত্র চড়-থাপ্পড়ের দৃশ্য অতিশয় লজ্জার। চড়-থাপ্পড় জব্বারের বলীখেলার মতো বিনোদনের জন্য প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ভালো, তার বাইরে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমাজ্জীবনে থাকাটা সুখকর নয়।
মায়ের হাতের চড় ছাড়া আর যেকোনো হাতের চড়-থাপ্পড় নিষিদ্ধঘোষিত হওয়া উচিত।
সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক