চীন সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত নিভৃতি আইন (ডেটা প্রাইভেসি ল) পাশ করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাধারণ উপাত্ত সুরক্ষা প্রবিধান (জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন) দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা চীনের এই ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন (পার্সোনাল ইনফরমেশন প্রোটেকশন ল, সংক্ষেপে পিআইপিএল) একগুচ্ছ দূরদর্শী বিধি অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কীভাবে তাদের সেবাগ্রহীতাদের ব্যক্তিগত তথ্য উপাত্ত রক্ষণাবেক্ষণ করবে তা এসব বিধিতে বাতলে দেওয়া হয়েছে।
দৃশ্যত এটি খুব কড়া আইন। পিআইপিএল নামক আইনকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ‘বিশ্বের অন্যতম কঠোর উপাত্ত নিভৃতি আইন’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তবে চীনের নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় এই আইন যতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে অনেকে প্রত্যাশা করছেন, সম্ভবত এটা ততখানি সুরক্ষা নিশ্চিত করবে না। এটি নিশ্চিত, পিআইপিএল চীনা নাগরিকদের গোপনীয়তা রক্ষার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপের প্রতিনিধিত্ব করে।
এই আইন প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রকদের হাতে চীনের শক্তিশালী প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এক গুচ্ছ নতুন অস্ত্র দিয়েছে। এই আইন দিয়ে অ্যালগরিদমের মাধ্যমে মূল্য বৈষম্য সৃষ্টি করা কোম্পানিগুলোর ক্ষমতা সীমিত করা যাবে; সীমান্তবর্তী তথ্য স্থানান্তরের নিয়ম কঠোর করা যাবে এবং যে বৃহৎ কারিগরি সংস্থাগুলোকে প্রযুক্তি জগতের ‘দারোয়ান’ বলে মনে করা হয় তাদের জন্য অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু পিআইপিএল-এর দিকে নিবিড়ভাবে নজর দিলে এর বড় বড় দুর্বলতা ধরা পড়বে।
ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থাগুলো কারও ব্যক্তিগত তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে চাইলে তাদের সম্মতি নিতে হবে—আইনটিতে এমন কথা বলা থাকলেও কোনো ব্যক্তির তথ্য নেওয়ার ক্ষেত্রে যদি ‘সংবিধিবদ্ধ ভিত্তি’ থাকে, তাহলে তার তথ্য গ্রহণ ও প্রক্রিয়াকরণে সংস্থাগুলো ছাড় পাবে। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে সংস্থাগুলোকে ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে না। কিন্তু সেই বিধি কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে তা এই আইনে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় ফেলা হয়নি। চীনের কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকারগুলোসহ দেশটির অনেক সরকারি কর্তৃপক্ষের হাতে এই আইনি ক্ষমতা দেওয়া আছে। ফলে পিআইপিএল-এর বাধ্যবাধকতা এড়ানোর জন্য নিম্ন স্তরের আইন-কানুনের একটি বিস্তৃত পরিসরকে ব্যবহার করার জোরালো আশঙ্কা থেকে যায়।
সংস্থাগুলোর এই ছাড়প্রাপ্তি চীনের বিতর্কিত সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেমকে (এই ব্যবস্থার আওতায় প্রত্যেক নাগরিককে ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় এবং মূল্যায়ন হিসেবে তার নামে পয়েন্ট যুক্ত হয়। নাগরিক হিসেবে যার পয়েন্ট ভালো তাকে সরকার থেকে পুরস্কার হিসেবে নানা ধরনের নাগরিক সুবিধা দেওয়া হয় আর অপরাধমূলক কাজের জন্য কম পয়েন্ট পেলে শাস্তি হিসেবে প্লেন বা ট্রেনে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়) প্রভাবিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্য পিপল’স ব্যাংক অব চায়না একটি ক্রেডিট-ইনফরমেশন গাইডলাইন শীর্ষক একটি নির্দেশিকা তৈরি করছে যাতে বিপুলসংখ্যক অনলাইন ভোক্তার তথ্য উপাত্ত সংযোজন করা হচ্ছে।
গণপরিবহন, বিমান, আবাসন এবং বিভিন্ন ব্যাংকের মতো অনেক প্রতিষ্ঠানে এই তথ্য তারা সরবরাহ করে থাকে। যে ব্যক্তির ক্রেডিট পয়েন্ট ভালো এসব ক্ষেত্রে পরিষেবা নিতে গেলে তাদের পুরস্কার হিসেবে ছাড় দেওয়া হয় এবং খারাপ পয়েন্ট থাকলে শাস্তি হিসেবে নানা ধরনের আর্থিক জরিমানা করা হয়।
এখন কথা হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম থেকে ব্যক্তির নেতিবাচক ক্রেডিট ইনফরমেশন নিতে বেশি আগ্রহী থাকে। যেমন কোনো ব্যক্তি আর্থিকভাবে খেলাপি কিনা বা তাঁর বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের রেকর্ড আছে কিনা—এসব বিষয় তাঁরা দেখতে চায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশিকা প্রণয়ন নিয়ে চীনে তুমুল বিতর্ক হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এই নির্দেশিকা তৈরি করা ব্যক্তির একান্ত নিভৃতির মারাত্মক লঙ্ঘন।আসলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি দেশব্যাপী ক্রেডিট পয়েন্টের উপাত্ত ভিত্তি তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে।
এই উদ্যোগটি জ্যাক মার প্রতিষ্ঠিত অ্যান্ট গ্রুপের মতো বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে তাদের গ্রাহকদের তথ্য উপাত্ত সরকারের মহাফেজখানায় হস্তান্তর করতে চাপ দিতে সহায়তা করবে। কিন্তু চীনের বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক যুদ্ধ, বিশেষ করে অ্যান্ট গ্রুপের পাবলিক শেয়ার ছাড়ায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতকে নিঃসন্দেহে শক্তিশালী করেছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দোহাই দিয়ে আগ্রাসীভাবে তার ক্রেডিট ডেটাবেইস প্ল্যান বাস্তবায়ন করছে।
অন্যদিক দিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তারা নিজেরা নতুন একটি স্বাধীন উপাত্ত সুরক্ষা সংস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। এই কাজটি করবে সাইবার স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব চায়না। নতুন এই আইনের কারণে নতুন ও ছোট ছোট প্রযুক্তি কোম্পানির পাশাপাশি বড় বড় কোম্পানিও চাপে পড়বে। যেমন বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সের কথা বিবেচনা করুন। এই কোম্পানির সূচকের বৃদ্ধির কারণ তার অ্যালগরিদমের প্রয়োগ। অ্যালগরিদমের সাহায্যে তারা ভোক্তাদের পছন্দগুলো নির্ধারণ করতে পারে এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু এবং বিজ্ঞাপনগুলো ভোক্তাদের সুপারিশ করে।
এই কঠোর আইনের কারণে বাইটড্যান্স-এর পক্ষে ভোক্তাদের ব্যক্তিগত তথ্য উপাত্তের একটা বড় অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারিশে বন্ধ করে দেওয়া হবে। সে তথ্য তখন বাইটড্যান্স পাবে না। ফলে অ্যালগরিদমের সহায়তায় তারা ভোক্তাদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয় নির্ধারণ করতে পারবে না। তখন বাধ্য হয়ে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যাবতীয় শর্ত মেনে সেসব তথ্য নিতে হবে। এতে দিন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা সরকার একদিকে বেশি রাজস্ব আয় করবে, অন্যদিকে বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অ্যাঞ্জেলা হুইয়ু ঝ্যাং একজন আইনের অধ্যাপক এবং ইউনিভার্সিটি অব হংকং-এর সেন্টার ফর চাইনিজ ল-এর পরিচালক