চীনের ‘দ্বিতীয় সমাজতন্ত্র’ কি গণতন্ত্রের বিকল্প হতে যাচ্ছে

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নানা সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রভাব বাড়ছে চীনা সমাজতন্ত্রের
ছবি: এএফপি

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর বর্তমানে বিশ্বে পাঁচটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রয়েছে। এগুলো হলো চীন, কিউবা, লাওস, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনাম। আনুষ্ঠানিকভাবে মতাদর্শ গ্রহণ না করলেও বেলারুশ ও ভেনেজুয়েলা অনেকাংশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রই।

পুঁজিবাদ এখন চীনের অর্থনৈতিক ইঞ্জিনের চালক। এখন প্রশ্নটি হলো আজকের দিনের সমাজতন্ত্রের রূপটা কেমন? নিকট ভবিষ্যতে বিশ্বে যদি সমাজতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা বেড়ে যায়, তাহলে গণতন্ত্রের জন্য সেটার মানে কী দাঁড়াবে?

কর্তৃত্ববাদের নেতৃত্বে চীন

সোভিয়েত ঘরানার সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পতনের পর তাদের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা অন্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও ধসে পড়ে। এর মধ্যে ইথিওপিয়া, আফগানিস্তান ও দক্ষিণ ইয়েমেন ছিল। সমাজতান্ত্রিক কিউবাই শুধু তখন ওই স্রোতের বাইরে ছিল।

বর্তমান বিশ্বে সমাজতন্ত্রের নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ১৯৪৯ সালে চীনে সমাজতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এখন তারা যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিচ্ছে। নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্র এখন সংকুচিত হতে থাকা গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে। যদিও ২০১০ সালের পর বিশ্বে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে পৃথক হওয়া দেশের সংখ্যা বাড়ছেই।

গণহত্যা-পরবর্তী রুয়ান্ডায় গণতন্ত্র দ্রুত পথ হারায়। গৃহযুদ্ধের পর ইথিওপিয়ায় একই ঘটনা ঘটে। আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র পিষ্ট হয়। ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ায় নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। বুলগেরিয়া (২০০৯), হাঙ্গেরি (২০১০), সার্বিয়া (২০১৪), তুরস্ক (২০১৫), পোল্যান্ড (২০১৬) এবং স্লোভেনিয়া (২০২০) একই পথ অনুসরণ করেছে।

চীনের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি। এর মানে হচ্ছে সমগ্র বিশ্বের পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষ সমাজতান্ত্রিক শাসনে রয়েছে। লাওস, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনাম—তিনটি দেশই চীনের সীমান্ত লাগোয়া। বলা চলে চীন প্রভাবিত সমাজতান্ত্রিক শিবির। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের দুই দশক পর পুঁজিবাদকে আলিঙ্গন করে আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে চীনা ধরনের সমাজতন্ত্র-২ (দ্বিতীয় সমাজতন্ত্র)। আগামী বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ কি তাদের হাতেই?

বিভিন্ন আর্থসামাজিক সংকট যেমন বেকারত্ব বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান পড়ে যাওয়া, আয় কমে যাওয়া, চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো বিষয়গুলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমাধান করতে পারছে না। এ বাস্তবতায় চীনের সমাজতন্ত্র-২ জয়ী হতে চলেছে। সামনের দিনগুলোতে সমাজতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা বাড়বেই, তাতে করে মানুষের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারিয়ে যাবে।

প্রযুক্তিগত কর্তৃত্ববাদ

চীনে কর্তৃত্ববাদের প্রসঙ্গ এলে সবার আগে আসবে উচ্চপ্রযুক্তি এবং নজরদারিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটা ব্যবস্থার ছবি। সমাজতন্ত্র-২–এ জনগণের ওপর পুরো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। রক্তপাতহীন এ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় প্রতিটি ব্যক্তি যেন একদলীয় বিধিবিধানের ওপর অনুগত থাকে। সামরিক নজরদারি শিল্প এই সম্মতি উৎপাদনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। সমাজতান্ত্রিক-পুঁজিবাদ সফল করার মূলমন্ত্র এটি। এ ব্যবস্থায় যত বেশি নিয়ন্ত্রণ, তত বেশি চাকরির সুযোগ। সরাসরি অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে নিপীড়ন হচ্ছে অর্থনীতির ইঞ্জিন সচল রাখার উপায়। অনেকের সমৃদ্ধি এতে নিশ্চিত হয়, কিন্তু সবার নয়। ভারী শিল্পনির্ভর সোভিয়েত মডেলের সমাজতন্ত্র-১ থেকে চীনের সর্বাত্মক সমাজতন্ত্র-২-এ উত্তরণের ঝাঁকুনি দেওয়া এ ঘটনা বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে।

উত্তর কোরিয়া এখনো ধরনের দিক থেকে সমাজতন্ত্র-১-এ রয়ে গেছে। পিয়ংইয়ং সমাজতন্ত্র-২–এর পথ গ্রহণ করেনি, যদিও বেইজিং তাদের সামনে চলার পথ বাতলে দিচ্ছে। কিউবাও ধরনের দিক থেকে সমাজতন্ত্র-১–এর কাছাকাছি। অপ্রয়োগযোগ্য আদর্শ ও মতাদর্শে আটকে আছে। এর বিপরীতে বেলারুশ, লাওস ও ভিয়েতনাম অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য যা করার দরকার তাই করছে। দেশগুলোর উৎপাদন ও মুনাফার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীন শাসক দলের হাতেই রয়েছে। তারা চীনের একান্ত বাধ্যগত, সমাজতন্ত্র-২–এর প্রতি অনুগত।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প

বিভিন্ন আর্থসামাজিক সংকট যেমন বেকারত্ব বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান পড়ে যাওয়া, আয় কমে যাওয়া, চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো বিষয়গুলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমাধান করতে পারছে না। এ বাস্তবতায় সমাজতন্ত্র-২ জয়ী হতে চলেছে। সামনের দিনগুলোতে সমাজতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা বাড়বেই, তাতে করে মানুষের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারিয়ে যাবে।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকাঠামো (বিআরআই) প্রকল্পের মতো উচ্চাভিলাষী কোনো প্রকল্প এ মুহূর্তে গণতান্ত্রিক বিশ্বের হাতে নেই। সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথকে একই করিডরের আওতায় আনা হচ্ছে এ প্রকল্পে। আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপে চীনের পণ্যের সরাসরি রপ্তানি এবং সেসব দেশ থেকে কাঁচামালের নিরবচ্ছিন্ন আমদানি নিশ্চিত হবে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে। এই সংযোগ সমাজতন্ত্র-২–এর বৈশ্বিক বিস্তারের পথ।

চীনের এ সমাজতন্ত্র-২ মডেলে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার মধ্যেই কল্যাণ রাষ্ট্রীয় নীতি এবং একদলীয় শাসনের অধীন সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করা—এ দুটি বিষয়ই রয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে ইউরোপের বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও সার্বিয়ায় এ মডেলের শাসন দেখা যাচ্ছে। এসব দেশের কর্তৃত্ববাদী নেতারা চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সফলতায় মোহিত। সমাজতান্ত্রিক এ পরাশক্তির সঙ্গে সহযোগিতা ও সম্পর্ক স্থাপনে তারা আশাবাদী। আমার ধারণা, সমাজতন্ত্র-২–এর নাগপাশে বন্দী হওয়ার কাতারে ইউরোপে এগুলোই শেষ দেশ হবে না।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ

টমাস কামাসেলা স্কটল্যান্ডের সেইন্ট অ্যান্ড্রুস বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইতিহাসের রিডার