সস্তা তেল-গ্যাসের জমানা শেষ। ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে ইউরোপ যে উচ্চাভিলাষী চেষ্টা চালাচ্ছে, তা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সরবরাহকে সংকুচিত করেছে। এটি বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এবং বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটকে প্রকট করে তুলছে। এ কারণেই জ্বালানি শক্তির বিকল্প উৎসগুলো দিন দিন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে এবং সেটি হওয়াই উচিত। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে জলবিদ্যুৎকে বিশেষভাবে আলিঙ্গন করা সামগ্রিক জ্বালানি ব্যবস্থার ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জলবিদ্যুৎ বর্তমানে সর্বাধিক ব্যবহৃত নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ এবং বিশ্বের সবচেয়ে কম-কার্বন নিঃসরণকারী বিদ্যুতের অর্ধেকই উৎপন্ন হয় এই পদ্ধতিতে। জলবিদ্যুতের প্রতি সবার বিশেষ আকর্ষণের পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। কয়েক দশক ধরে, এটি ছিল সবচেয়ে সাশ্রয়ী নবায়নযোগ্য ব্যবস্থা। অনেক জলবিদ্যুৎকেন্দ্র পারমাণবিক, কয়লা এবং প্রাকৃতিক-গ্যাস প্ল্যান্টের তুলনায় অনেক দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে-কমাতে পারে।
বায়ুপ্রবাহ ও সূর্যের আলোর তারতম্যের কারণে বায়ু চালিত এবং সোলার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন ওঠানামা করতে পারে। কিন্তু জলবিদ্যুৎ ব্যবস্থায় নির্ভরযোগ্যভাবে জলাধার ব্যবহার করে একটানা একই গতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে। অবশ্য এ ব্যবস্থায় একটি বাধাও আছে। জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে সাধারণ ধরনটি নদী এবং স্রোতের মুখে বাঁধ তৈরি করে এবং জলবিদ্যুৎ বাঁধগুলো পরিবেশের ওপর একেকটি একটি বড় ও দীর্ঘস্থায়ী দাগ রেখে যায়।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে না বটে; তবে বাঁধ এবং জলাধারগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মিথেন, কার্বন ডাই–অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইড নির্গত করে। কিছু পরিবেশ পরিস্থিতিতে, যেমন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জলবিদ্যুৎ–ব্যবস্থা জীবাশ্ম জ্বালানির বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের চেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি করতে পারে।
জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর বিশ্বের নির্ভরতা কমানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। কিন্তু বিকল্প পথ হিসেবে জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ; বিশেষ করে আমাজন, ব্রহ্মপুত্র, কঙ্গো এবং মেকংয়ের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ নদী অববাহিকায় বাঁধ নির্মাণ কোনো সমাধানের পথ হতে পারে না।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বে যে পরিমাণ মিথেন গ্যাস (মিথেন একটি গ্রিনহাউস গ্যাস যা কার্বন ডাই–অক্সাইডের চেয়ে কমপক্ষে ৩৪ গুণ বেশি শক্তিশালী) নির্গত হয়, তার প্রায় ৮০ শতাংশ নির্গত হয় কৃত্রিম জলাধার থেকে, যদিও বিভিন্ন ধরনের ভৌগোলিক, জলবায়ু, মৌসুমি এবং উদ্ভিদগত কারণ জলাধারের মিথেন নির্গমনকে প্রভাবিত করে থাকে। জলবিদ্যুৎ বাঁধগুলোকে প্রায়ই বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সেচের সহায়ক উপাদান হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু একই সঙ্গে এই বাঁধগুলো নদ-নদীর তাপমাত্রা এবং পানির গুণমান বদলে দেয় এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ পলিপ্রবাহকে বাধা দেয়।
ভাটি অঞ্চলের উর্বরতা কমে যাওয়া মৃত্তিকাকে পুনরায় উর্বর করতে, নদীর ক্ষয় রোধ করতে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে এই ধরনের পলি অপরিহার্য। পাহাড় থেকে প্রবাহিত হয়ে আসা পলিকে যখন বাঁধগুলো আটকে রাখে, তখন ভাটির ব-দ্বীপ এলাকা সংকুচিত হয় এবং ডুবে যায়। এটি সাগরের নোনা পানিকে উপকূলীয় এলাকায় ঢুকতে সুযোগ করে দেয়। এর ফলে উপকূলীয় মোহনা এবং উপহ্রদগুলোতে সংকটাপন্ন প্রজাতির জীব বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাদু পানি এবং নোনা পানির মধ্যকার সূক্ষ্ম ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। এটি ব-দ্বীপকে ঘূর্ণিঝড় ও হারিকেনের পূর্ণ শক্তির মুখে ফেলে দেয়। এশিয়ায় অত্যধিক জনবহুল ব-দ্বীপ অঞ্চল তিয়ানজিন, সাংহাই, গুয়াংজু, ব্যাংকক এবং ঢাকার মতো মেগাসিটি ইতিমধ্যে এর প্রভাব টের পাচ্ছে।
বাঁধগুলোর কারণে সামাজিক ক্ষেত্রেও চড়া মূল্য দিতে হয়। ২০০৭ সালে চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও জানিয়েছিলেন, তাঁরা জলীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভাটি এলাকার ২ কোটি ২৯ লাখ লোককে (বিশ্বের এক শটির বেশি দেশ আছে, যেখানে লোকসংখ্যা এত নয়) সরিয়ে নিয়েছে। ২০১২ সালে চালু হওয়া বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎকেন্দ্র দ্য থ্রি জর্জেস ড্যাম ১৪ লাখের বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। এই সব বন্ধ করার জন্য জলবিদ্যুতের নির্ভরযোগ্যতায় সন্দেহ করার যৌক্তিক কারণ আছে।
নদী ও জলাশয়ে পানির স্তর যদি কমে যায় এবং খোলা জলাধার থেকে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণের পানি যদি বায়ুস্তরে মিলিয়ে যায়, তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদক টারবাইনগুলোকে ঘোরানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানির চাপ কমে যাবে এবং তাতে অনিবার্যভাবে বিদ্যুৎ কম উৎপাদিত হবে। এ অবস্থা মেকং নদীর অববাহিকায় দেখা গেছে।
আরেকটি বিষয় হলো, বাঁধগুলো বানানো ব্যয়বহুল এবং বছরের পর বছর ধরে এর উপযোগিতা একই রকম থাকে না। এ কারণে এই বাঁধ নির্মাণে বিনিয়োগ করার বিচক্ষণতাকে সন্দেহজনক মনে হয়। তারপরও এই বাঁধ বানানোর বিষয়ে আগ্রহের পড়তি দেখা যাচ্ছে না। পৃথিবীর দীর্ঘ নদীগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ইতিমধ্যে মানুষের দ্বারা পরিবর্তিত হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৬০ হাজার বড় বাঁধের অধিকাংশই গত সাত দশকে নির্মিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এ বাঁধ নির্মাণ একটি ভয়ংকর গতিতে চলছে। ২০১৪ সালে কমপক্ষে ৩৭০০টি উল্লেখযোগ্য বাঁধ নির্মাণাধীন বা পরিকল্পনাধীন ছিল। তখন থেকে বাঁধের গর্জন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। উন্নয়নশীল বিশ্ব এখন এ ধরনের বাঁধ নির্মাণের একটি হটস্পট হয়ে উঠেছে।
যদিও বলকান থেকে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণের কর্মকাণ্ড বেশি দেখা যায়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি বাঁধের দেশ এবং সবচেয়ে বড় বাঁধ ‘রপ্তানিকারক’ দেশ হিসেবে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চীন ৩৮টি দেশে চীনা প্রযুক্তিতে মোট ২৭ গিগাওয়াটের বেশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে চার হাজার চার শ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়ও বাঁধ নির্মাণে দ্বিধা করছে না চীন। চীন ভালো করেই জানে তাদের নিজস্ব বিজ্ঞানীরা ২০০৮ সালের ওয়েনচুয়ান ভূমিকম্পের (যার ফলে তিব্বত মালভূমির পূর্বাঞ্চলে ৮৭ হাজারের বেশি লোক মারা গিয়েছিল) সঙ্গে সেই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছে বানানো নতুন জিপিংপু বাঁধের যোগসূত্র থাকার কথা বলেছিলেন।
জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর বিশ্বের নির্ভরতা কমানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। কিন্তু বিকল্প পথ হিসেবে জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ; বিশেষ করে আমাজন, ব্রহ্মপুত্র, কঙ্গো এবং মেকংয়ের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ নদী অববাহিকায় বাঁধ নির্মাণ কোনো সমাধানের পথ হতে পারে না।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক