চীনকে ভাতে মারার যুদ্ধ
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বলতে ফেসবুক ও টুইটারই প্রধান। ফলে, চীনের টুইটার ‘ওয়েইবো’তে এমুহূর্তে কী ঘটছে, তা এখানে বসে আঁচ পাওয়া দুরূহ। যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী উত্তেজনায় ওয়েইবো রীতিমতো রণক্ষেত্র এ মুহূর্তে। কিছুদিন আগে ভারতে চীনের পণ্য বয়কট আন্দোলন নিয়ে ওয়েইবোতে হাসাহাসি হলেও এখন তারাই যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বয়কটের ডাক দিচ্ছে।
চীনের প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে ট্রাম্প বিধিনিষেধ আরোপ করায় খেপেছে দেশটির নাগরিকেরা। তারা বয়কট করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপলকে। অনেকে অ্যাপলের আইফোন ভেঙে ফেলার ভিডিও আপলোড করছে আইডিতে। কোনো কোনো ভিডিওতে দেখানো হচ্ছে, বিভিন্ন সংস্থায় কর্মকর্তারা কর্মচারীদের ডেকে বলছেন, আইফোনের বদলে হুয়াওয়ের ফোন ব্যবহার করলে বোনাস দেওয়া হবে।
আপাতত ফোনযুদ্ধ মনে হলেও কার্যত এটা সর্বাত্মক এক যুদ্ধের খণ্ডাংশ মাত্র। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবিকাশমান মহাসংঘাত যে বিশ্ব ইতিহাসের অতীত সব যুদ্ধের চেয়ে কলাকৌশল ও উপাদানে ভিন্ন কিছু হবে, তারই লক্ষণ হলো অ্যাপল বনাম হুয়াওয়ের প্রতীকী ভাঙাভাঙি।
যুক্তরাষ্ট্রের খোলামেলা আক্রমণ
হুয়াওয়ের চীনের সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি নয়; যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তারা চীনের উত্থানের প্রতীক। এটা হয়তো কেবল এই কারণে নয় যে কোম্পানিটির এখনকার সিইও রেন ঝেংফেই একসময় পিপলস লিবারেশন আর্মিতে কাজ করতেন। বরং হুয়াওয়ের বিরোধিতা বিশ্বপ্রভুত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদিনকার সংগ্রামেরই নতুন অধ্যায় মাত্র।
খ্যাতনামা ফোন ব্রান্ড হলেও হুয়াওয়ের শুধু স্মার্টফোন বানায় না; যোগাযোগপ্রযুক্তির নানান যন্ত্রপাতি তৈরিতে তারা অন্যতম বিশ্বসেরা। ফোন ব্যবসায় যদিও তারা এখনো স্যামসাংয়ের চেয়ে পিছিয়ে, কিন্তু ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল হয়ে গেছে। গত বছর অ্যাপলকে হারিয়ে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে তারা।
হুয়াওয়ের পাশাপাশি চীনের জেডটিইকেও যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার নীতিনির্ধারকেরা নিজেদের ‘নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ গণ্য করছেন এবং তাদের সঙ্গে ব্যবসা না করার জন্য নিজ দেশের কোম্পানিগুলোকে বলছেন। সরাসরি নাম না নিয়েই ১৫ মে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে চীনের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রযুক্তি ব্যবসায় যুক্তরাষ্ট্রের অফিস-আদালতের প্রতি একরূপ নিষেধাজ্ঞাই জারি করেছেন। এটাকে ‘জরুরি অবস্থা’র সঙ্গে তুলনা দিয়েছেন ট্রাম্প। ফলে, হুয়াওয়ের মতো চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিপসহ কোনো প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার আমদানি করতে পারবে না। সমস্যায় পড়বে সফটওয়্যার নিয়েও।
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই মর্মে প্রচার চালানো হচ্ছে যে হুয়াওয়ের প্রযুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি চালাচ্ছে চীন। অনুমাননির্ভর এই প্রচারণার সপক্ষে কখনো কোনো চূড়ান্ত প্রমাণ হাজির করতে পারেনি ট্রাম্প প্রশাসন। এরূপ অভিযোগ হাস্যকরও বটে। কারণ, চীনের নজরদারি কথা বলে সাধারণ নাগরিকদেরও এই যুদ্ধে জড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। অথচ কে না জানে যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকদের ওপর নানাভাবেই ব্যাপক নজরদারি করে চলেছে।
মূলত, রাজনৈতিক স্বার্থে চীনের পণ্য সম্পর্কে নগ্নভাবেই ভীতি ছড়াচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। চীনের অর্থনৈতিক উত্থান থামাতেই যে এসব পদক্ষেপ, সেটা গোপন নেই আর। যুক্তরাষ্ট্রের এরূপ প্রচারণার ফল হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড তাদের ফাইভজি নেটওয়ার্ককে হুয়াওয়ে ও জেডটিইমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডিসেম্বরে কানাডায় হুয়াওয়ের বড় এক কর্মকর্তার আটক হওয়াও যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী বাণিজ্যযুদ্ধেরই পরোক্ষ বৈশ্বিক বহিঃপ্রকাশ ছিল। হুয়াওয়ে ইরান অবরোধ লঙ্ঘন করছে—এই অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র কানাডাকে বাধ্য করেছিল ওই আটকে। এখন ব্রিটেন থেকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মতো কানাডা থেকে হুয়াওয়ের মেং ওয়ানঝুকে নিজের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য লড়ছে ওয়াশিংটন। ট্রাম্পের চাপে হুয়াওয়ের অ্যান্ড্রয়েড লাইসেন্সও টেনে ধরেছে গুগল। মাইক্রোসফট উইনডোজ লাইসেন্স নিয়ে নেয় কি না, তা নিয়েও শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। যুক্তরাষ্ট্র তার ঘনিষ্ঠ সব মিত্রকে বলছে চীনের কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে।
সোভিয়েত ইউনয়ন ভেঙে পড়ার ৩০ বছর পর এভাবেই নিজের এত দিনকার একচেটিয়াত্ব রক্ষায় নতুন এক রেষারেষিতে নেমেছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্র বহুকাল থেকে মুক্তবাণিজ্যের কথা বললেও নিজের ক্রেতাদের পছন্দের স্বাধীনতাই সর্বাগ্রে হরণ করেছে। ব্যবসায়ে প্রতিযোগিতার ধারণারও বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে দেশটির বর্তমান নেতৃত্ব। এটা অবশ্য মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কারণ, ‘প্রেম এবং যুদ্ধে যেকোনো কৌশলই গ্রহণযোগ্য!’
চীনের অবস্থান রক্ষণাত্মক
চীন এই যুদ্ধ শুরু করেনি। সেখানে ঘিও ঢালতে চাইছে না তারা। এটা অস্বাভাবিক নয়। অভ্যন্তরীণ বাজারের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপই চীনের প্রযুক্তিপণ্যের বড় বাজার। যেকোনো মূল্যে চীন তা রক্ষা করতে চাইছে। ট্রাম্প যখন একের পর এক আক্রমণ করে চীনকে প্রায় দেয়ালে চেপে ধরেছেন, তখনো দেশটি ঘোষণা দিয়ে এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না, যা উত্তেজনায় জ্বালানি সরবরাহ করবে। এ ক্ষেত্রে তাদের বিকল্প বাজার নিশ্চিত করতে হবে আগে। গণচীন ঠিক তা-ই করছে। তবে চীনের ক্রোধ গোপন নেই। তাদের এক কূটনীতিবিদ (ঝাও লিজিয়ান, পাকিস্তান) টুইটারে এও বলে ফেলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হুয়াওয়ের লোগো ভালো করে দেখা। অ্যাপলকে ঠিক এভাবেই টুকরো টুকরো করা হবে। কাকতালীয় হলেও সত্য, হুয়াওয়ের লোগোকে মনে হয় অ্যাপলের লেগোর কয়েকটি খণ্ডাংশ।
কিন্তু ট্রাম্পের এই যুদ্ধকৌশল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কতটা সফল হতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা কি সত্যি সত্যি চীনের প্রযুক্তিপণ্য ক্রয় বন্ধ করে দেবে? কিংবা চীন-যুক্তরাষ্ট্র ব্যবসা-বাণিজ্যও কি বন্ধ হতে চলেছে?
চীন-যুক্তরাষ্ট্র ব্যবসায়ের পরিমাণ বছরে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রই বেশি আমদানি করে, কিন্তু অন্তত ১৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য চীনে রপ্তানিও করে তারা। ফলে, চীনবিরোধী বাণিজ্যযুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিকদের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা অসম্ভব করে ফেলা হলেও বিশ্বের প্রায় সর্বত্র ইলেকট্রনিকস যন্ত্রাংশ তৈরির প্রক্রিয়ায় চীন এখন অনিবার্য এক অংশীদার। স্মার্টফোন থেকে মেডিকেল ডিভাইস, সব সামগ্রীর খুচরা যন্ত্রাংশেরও একই অবস্থা। অন্য দেশের অনেক ব্রান্ডই কার্যত চীন থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ নেয়। ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর পুরো সাপ্লাই চেইনের অনেকখানি চীনের নিয়ন্ত্রণে। সুতরাং হুয়াওয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি নতজানু করা প্রায় অসম্ভব। ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা চীনকে চিপ, সফটওয়্যার এবং অপারেটিং সিস্টেমের ক্ষেত্রে আরও গবেষণায় বিনিয়োগে বাধ্য করবে। তার ফল দীর্ঘ মেয়াদে ভালো হলেও আপাতত হুয়াওয়ের মতো কোম্পানিগুলোর প্রবৃদ্ধির গতিধীর হতে বাধ্য। এর মাধ্যমে চীনের বৈশ্বিক সামরিক ও ভূকৌশলগত বিস্তারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হয়তো এটাই কেবল স্বস্তির বিষয়।
ট্রাম্প আসলে কার পক্ষে খেলছেন?
যুক্তরাষ্ট্রের জারি করা এই বাণিজ্যযুদ্ধে নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব বাণিজ্যের খারাপ দৃষ্টান্ত। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনা চলা অবস্থায় একতরফা এরূপ পদক্ষেপ আলোচনার প্রক্রিয়াকে স্যাবোটাজের মতো। হুয়াওয়ের বা চীনের কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেসব অভিযোগ আনছে, তার তদন্তে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো তৃতীয় শক্তিকে নিয়োগ করাই যথার্থ হতো। তা করা হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসনের এই অযৌক্তিক ও একরোখা অবস্থানই চীনের নাগরিকদের ক্ষুব্ধ করেছে এবং চীনজুড়ে জাতীয়তাবাদী আবেগের এক ঢেউ বইয়েছে, যার প্রকাশ ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডগুলোর ভাঙচুরের ছবির মধ্য দিয়ে।
এরূপ বাণিজ্যযুদ্ধের আরেক পরোক্ষ বলি তিব্বতের বৌদ্ধ ও জিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলমানদের স্বার্থ। চীন সরকারের বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের মুখে এই উভয় সম্প্রদায়ের সপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এত দিন যে ন্যায্য মানবিক সমর্থন ছিল, তা চীনে বিশেষ মনোযোগ পেত। বাণিজ্যঘৃণার মুখে এখন তার কার্যকারিতা অনেক কমে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ভূমিকা তিব্বত ও জিনজিয়াংয়ে নিয়ন্ত্রণ আরও নির্মম করতে চীনকে সহায়তা দেবে। একই সঙ্গে এই বাণিজ্যযুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কম দামে পণ্য পাওয়ার সুযোগও কমাবে, যা পরোক্ষে তাদের দেশের বড় কোম্পানিগুলোর স্বার্থের পক্ষে যাবে। তাদের একচেটিয়াত্ব বাড়াবে। ট্রাম্প যদিও বাহ্যিকভাবে আমেরিকার স্বার্থ দেখছেন বলে বোঝাতে চান, কার্যত তিনি বৃহৎ করপোরেটদের হয়েই খেলছেন।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক