চীন এটা অস্বীকার করে যে তারা ব্যবসার সঙ্গে রাজনীতি মেশায় না, যদিও তারা দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্য দিয়ে অন্য দেশকে শাস্তি দিচ্ছে, যারা তার পথে আসতে চায় না। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া থাড ক্ষেপণাস্ত্র–ব্যবস্থা স্থাপন করার পর চীন দেশটির ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। এতে বোঝা যায়, চীনা কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। চীনা সরকার প্রথমে বিভিন্ন দেশকে তার ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল হতে উৎসাহিত করে। এরপর তারা সেটা কাজে লাগিয়ে ওই দেশকে তার পররাষ্ট্রনীতির প্রতি সমর্থন জানাতে বাধ্য করে। অর্থনৈতিক শাস্তি হিসেবে তারা যেমন সে দেশে আমদানি সীমিত করে দেয়, তেমনি কোনো দেশের পণ্যও বর্জন করে। একই সঙ্গে কৌশলগত রপ্তানি (বিরল খনিজ) বন্ধ করে দেয় এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ প্রতিবাদ উসকে দেয়। এখানেই শেষ নয়, তার হাতে আরও অস্ত্র আছে, যার মধ্যে পর্যটকদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও মাছ ধরার সুযোগ বন্ধ করা অন্যতম। এসব কিছু আবার সতর্কভাবে ব্যবহার করা হয়, অর্থাৎ এমন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে, যাতে চীনের ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। গত নভেম্বর মাসে দালাই লামাকে ডেকে এনে মঙ্গোলিয়া এ ধরনের ভূ–অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়েছে, যেটাকে চীনের এসব কর্মকাণ্ডের ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত বলা যায়। মঙ্গোলিয়ার রপ্তানির ৯০ শতাংশই চীনে যায়, এই সুযোগে চীন তাকে শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মঙ্গোলিয়ার পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক জরিমানা আরোপ করে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, ‘আশা করি, মঙ্গোলিয়া এই শিক্ষা আমলে নিয়েছে এবং তারা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে এই প্রতিশ্রুতি মেনে চলবে যে তিব্বতের এই ধর্মীয় নেতাকে তারা আর ডাকবে না।’
চীনের বাণিজ্য প্রতিশোধের আরেকটি বিখ্যাত উদাহরণ দিই। ২০১০ সালে কারান্তরীণ (সদ্য প্রয়াত–অনুবাদক) চীনা লেখক লিউ শিয়াওবোকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। ফলস্বরূপ, চীনে নরওয়ের স্যামন রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সালে চীন আরেক কাণ্ড করে। এক বিরল খনিজ উপাদানের ব্যবসায় চীনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। তো জাপান ও পাশ্চাত্যকে কষ্ট দেওয়ার জন্য তারা ঘোষণা ছাড়াই এই পণ্যের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ২০১২ সালে সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে জাপানের সঙ্গে চীনের বিবাদ নতুন করে শুরু হলে তারা আবারও বাণিজ্য অস্ত্র প্রয়োগ করে। ফলে জাপানের শত শত কোটি ডলারের ক্ষতি হয়। একইভাবে ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত স্কারবারো নামক বালুচরে এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চীন নজরদারি জাহাজ পাঠিয়ে শুধু ফিলিপাইনকে বাধ্যই করেনি, তারা সেখানে ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করে। এরপর হঠাৎ করেই কলা আমদানি নিষিদ্ধ করে। এতে ফিলিপাইনের হাজার হাজার কলাচাষি নিঃস্ব হয়ে যান। এরপর আন্তর্জাতিক সমাজ বাণিজ্য বাধা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে চীন চুপি চুপি চরটি দখল করে নেয়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় থাড ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের বিরুদ্ধে চীন যে বাণিজ্য–বাধা আরোপ করেছে, সেটাকে এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে। কিন্তু যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র সেখানে স্থাপন করা হলো, তার বিরুদ্ধে চীন কিছু করল না। এটাই প্রথমবার নয়। ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়া যখন বিপুল রসুন আমদানির পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকদের বাঁচাতে আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দিল, তখন চীন দক্ষিণ কোরিয়ার সেলফোন ও পলিইথিলিন আমদানি বন্ধ করে দিল। এভাবে সম্পর্কবিহীন পণ্যের ওপর গয়রহভাবে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়ে যে প্রতিশোধ নেওয়া হলো, তার লক্ষ্য হচ্ছে চীনা শিল্প এগিয়ে নেওয়া। শুধু তা–ই নয়, এটাও নিশ্চিত করা যে দক্ষিণ কোরিয়ার যেন চীনের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়। তবে চীনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে কিন্তু তারা এই নিষেধাজ্ঞার খেলায় নামবে না। সম্প্রতি দোকালামে যে চীনা ও ভারতীয় সৈন্যরা মুখোমুখি হলো, তারপর কিন্তু তারা সেটা করেনি। কারণ, ভারতে চীনের রপ্তানি সেখান থেকে তার আমদানির পাঁচ গুণ। এটাও কৌশল, প্রতিদ্বন্দ্বীর উৎপাদন খাত বাড়তে না দিয়েও বিপুল মুনাফা করে নেওয়া। সে কারণে সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ না করে চীন তিব্বতে ভারতীয় পুণ্যার্থীদের গমন বন্ধ করে দিয়েছে। ওতে ভারত অর্থনৈতিক প্রতিশোধ নিতে পারত।
কিন্তু সুযোগ পেলেই তারা সেটা করে। ২০১০ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, যেসব দেশের নেতারা দালাই লামার সঙ্গে দেখা করেছেন, চীনে সেসব দেশের রপ্তানি ৮ দশমিক ১ থেকে ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ কমেছে, যে ক্ষেত্রে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। সাধারণভাবে চীন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তারা বিদেশি প্রতিযোগীদের দূরে রাখার জন্য অশুল্ক বাধা আরোপ করে এবং রপ্তানিতে ভর্তুকি দেয় ও অভ্যন্তরীণ বাজারকে চীনা কোম্পানির অনুকূলে রাখতে নানা কায়দা করে।
পরিহাসের ব্যাপার হলো, চীন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় এই বাণিজ্য শক্তি গড়ে তুলেছে। চীনের উত্থানে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তারা যেমন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে, তেমনি তাকে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ধারণা করা হয়েছিল, ট্রাম্প চীনের এই উত্থান রুখবেন। কিন্তু এর বদলে ট্রাম্প চীনকে আবারও মহান বানানোর চেষ্টা করছেন, যদিও তিনি চীনকে বাণিজ্যের ঠগ বলতেন। তিনি টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন এবং এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস করেছেন। এতে বরং চীনের সুবিধাই হচ্ছে।
জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে টিপিপির পুনরুত্থান ঘটাতে চাচ্ছেন। এতে বাজারবান্ধব ও নিয়মভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার মাধ্যমে চীনের এই অনুশোচনাহীন বাজারি আচরণের রাশ টেনে ধরা যেতে পারে। কিন্তু একে কার্যকর করতে হলে ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। চীনের এই বাণিজ্য শস্ত্রীকরণ এত দিন বিনা বাধায় চলে এসেছে। শুধু সমন্বিত আন্তর্জাতিক কৌশলের মধ্য দিয়েই কেবল চীনের রাশ টেনে ধরা সম্ভব, সঙ্গে নবায়িত টিপিপিরও প্রয়োজন আছে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক।